মতামত

জাতীয় স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দর ইজারা নয়, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণেই থাকা চাই

-ফজলুল কবির মিন্টু

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি এই বন্দর দিয়েই সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নির্ভর করে এই বন্দর ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও স্থিতিশীলতার ওপর। তাই এই কৌশলগত স্থাপনার পরিচালনা, নিরাপত্তা ও নীতিনির্ধারণের প্রশ্নে রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সরকার সম্প্রতি নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশি প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে—যা কেবল বন্দর পরিচালনার প্রশ্ন নয়, বরং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার বিষয়।

১. প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা: শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা

গত ৯ অক্টোবর ২০২৫ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন, যেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে—বারেক বিল্ডিং মোড়, নিমতলা, ৩ নম্বর জেটি গেট, কাস্টমস মোড়, সল্টগোলা ক্রসিংসহ এলাকায় যেকোনো সভা-সমাবেশ, মিছিল বা মানববন্ধন ৩০ দিনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, “বন্দরের কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে”।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই সিদ্ধান্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করার অপচেষ্টা। শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদসহ বন্দর সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো বহুদিন ধরে গণতান্ত্রিক উপায়ে এই ইজারার বিরোধিতা করে আসছে। সরকারের এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ২০২৪ সালের গণজাগরণের মূল্যবোধের পরিপন্থী—কারণ এটি জনগণের সংবিধানস্বীকৃত মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে।

২. এনসিটি: জাতীয় বিনিয়োগে গড়া আধুনিক টার্মিনাল

নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এবং দেশীয় ব্যবস্থাপনায় লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
সরকারের দাবি—বিদেশি অপারেটর এলে “দক্ষতা ও রাজস্ব” বাড়বে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এনসিটি ইতিমধ্যেই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও লাভজনক। গত কয়েক বছরে এই টার্মিনালের মাধ্যমে রাজস্ব আয় ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশি অপারেটর আনার মানে হলো জাতীয় সম্পদকে বিদেশি কোম্পানির মুনাফার জন্য ছেড়ে দেয়া।
ডিপি ওয়ার্ল্ডের মতো বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ইজারা দিলে বাংলাদেশের বন্দর প্রশাসন, শ্রমিক অংশগ্রহণ, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সীমিত হয়ে যাবে।

৩. বিদেশি ইজারার বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা: সতর্কবার্তা

বিশ্বের বহু দেশই কৌশলগত অবকাঠামো বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দিয়ে পরবর্তীতে ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছে।

  • জিবুতি ২০০৬ সালে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ডোরালে কনটেইনার টার্মিনাল ইজারা দেয়। শুরুতে উন্নয়নের আশ্বাস থাকলেও, সময়ের সঙ্গে দেখা যায়—বিদেশি কোম্পানি রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করছে। অবশেষে ২০১৮ সালে জিবুতি সরকার চুক্তি বাতিল করে।

  • কেনিয়ার মোম্বাসা বন্দর চীনা কোম্পানিকে ইজারা দেয়ার পর দেখা যায়, স্থানীয় শ্রমিকদের সুযোগ কমে গেছে, কারণ প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব শ্রমিক ও সরবরাহব্যবস্থা ব্যবহার করছিল।

  • শ্রীলঙ্কা তার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের হাতে দিয়ে এখন “ঋণফাঁদে” পড়েছে—যা আজ বিশ্বব্যাপী আলোচিত এক সতর্কবার্তা।

বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, পিপিপি বা বেসরকারীকৃত বন্দরের ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রকে শেষ পর্যন্ত আর্থিক দায় বহন করতে হয়েছে। ফলে বিদেশি ইজারা কেবল অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নির্ভরতার ঝুঁকি তৈরি করে।

৪. জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি

চট্টগ্রাম বন্দর কেবল অর্থনৈতিক কেন্দ্র নয়, এটি একটি কৌশলগত সামরিক এলাকা। এখানেই রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদর দপ্তর, ইস্টার্ন রিফাইনারি, যমুনা-পদ্মা-মেঘনা অয়েল কোম্পানির তেল সংরক্ষণাগারসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
এমন এলাকায় বিদেশি অপারেটরের কার্যক্রম রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হতে পারে। বন্দর তথ্য, চলাচল ও পণ্য তদারকির মাধ্যমে একটি বিদেশি কোম্পানি সহজেই জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য জানার সুযোগ পেতে পারে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হলে তা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ও সামরিক সংকটে রূপ নিতে পারে।

৫. শ্রমিক ও জনগণের ওপর অর্থনৈতিক চাপ

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে গড়ে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর ফলে আমদানি-রপ্তানি খরচ বাড়বে, বিশেষ করে পোশাক শিল্প—যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত—মারাত্মক সংকটে পড়বে। আমদানি ব্যয় বাড়লে জীবনযাত্রার খরচও বেড়ে যাবে। নিত্যপণ্য, ওষুধ, কাঁচামাল সব কিছুর দাম প্রভাবিত হবে। অর্থাৎ ট্যারিফ বৃদ্ধির চাপ সরাসরি সাধারণ মানুষের ঘাড়ে গিয়ে পড়বে।

এই ট্যারিফ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত এনসিটি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেওয়ার আগেই নেওয়া হয়েছে, যা প্রমাণ করে—ভবিষ্যতে যদি এনসিটির নিয়ন্ত্রণ ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে যায়, তাহলে আরও অনেক গণবিরোধী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে। এই বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যেও গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তারা আশঙ্কা করছেন, বিদেশি অপারেটরের মুনাফার স্বার্থে জাতীয় অর্থনীতি ও উৎপাদন খাত আরও বিপর্যস্ত হবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের জীবনে।

৬. বিকল্প পথ: দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিক অংশগ্রহণ

বাংলাদেশে বন্দর পরিচালনায় কোনো দক্ষতার ঘাটতি নেই। নৌবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের অধীনে চট্টগ্রাম বন্দর ইতিমধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ত ও কার্যকর বন্দর।
বিদেশি ইজারার পরিবর্তে রাষ্ট্র চাইলে—

  • আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি,

  • শ্রমিকদের ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত,

  • দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি
    এই তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই বন্দরের দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব, বিদেশি অপারেটর ছাড়াই।

৭. জনগণের দায়বদ্ধতা ও সরকারের দায়িত্ব

চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যৎ কেবল সরকারের নয়, সমগ্র জাতির প্রশ্ন। এই বন্দর আমাদের জাতীয় সম্পদ, আমাদের শ্রম, ঘাম ও বিনিয়োগে গড়া।
একটি অনির্বাচিত ও অনর্বর্তী সরকারের পক্ষে এমন কৌশলগত সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া কোনোভাবেই নৈতিক নয়। এটি হবে রাষ্ট্রের সম্পদের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ হারানোর সূচনা।
সরকার যদি সত্যিই দেশের স্বার্থে কাজ করতে চায়, তবে অবিলম্বে—
১. ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে এনসিটি ইজারার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।
২. চট্টগ্রাম বন্দরের সংলগ্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের গণবিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করতে হবে।
৩. দেশের সচেতন মানুষ এবং শ্রমিকদের মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বন্দর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

৮. উপসংহার

চট্টগ্রাম বন্দর কেবল একটি অর্থনৈতিক অবকাঠামো নয়—এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। আমরা চাই, এই বন্দর বাংলাদেশের শ্রমিক, নাবিক, ব্যবসায়ী ও জনগণের হাতে নিরাপদ থাকুক।
বিদেশি ইজারা মানে জাতীয় নিয়ন্ত্রণ হারানো, শ্রমিক অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়া এবং ভবিষ্যতের উপর অনিশ্চয়তার ছায়া পড়া।
আমরা বিশ্বাস করি—দেশের জনগণ ও শ্রমিক সমাজ একত্রিত থাকলে কোনো বিদেশি স্বার্থই বাংলাদেশের সম্পদ গ্রাস করতে পারবে না।
তাই আজই সময় এসেছে, “রাষ্ট্রের সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে রাখো”—এই ঐতিহাসিক অঙ্গীকার পুনরায় উচ্চারণের

(লেখকঃ শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী)