জাহাজভাঙা শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিস্থিতি ও অধিকার বঞ্চনার বাস্তবচিত্র উপস্থাপনা

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা জাহাজভাঙা শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের অধিকার বঞ্চনা ও ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিস্থিতির মধ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ‘জাহাজভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম’-এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক জরিপ উপস্থাপনায় এই বাস্তবচিত্র আরও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। অনুষ্ঠানটি আজ সকাল ১১টায় হোটেল আগ্রাবাদে অনুষ্ঠিত হয়। জরিপে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের কাজের ধরন, মজুরি, কর্মঘণ্টা, সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই শিল্পে শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে।
জরিপ অনুযায়ী, শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ৫ জন নিয়োগপত্র পেয়েছেন, অথচ শ্রম আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী এটি বাধ্যতামূলক। পরিচয়পত্র পেয়েছেন ৩১ জন শ্রমিক, বাকি ২৭ জন এখনও তা থেকে বঞ্চিত। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র না থাকায় শ্রমিকরা আইনগত ও সামাজিক দিক থেকে মারাত্মকভাবে অনিরাপদ অবস্থায় কাজ করছেন।
বেতন কাঠামোর দিক থেকেও চিত্রটি বেশ হতাশাজনক। সরকারের ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। জরিপে দেখা যায়, কাটার ম্যানদের অনেকে মাত্র ৮০০০ থেকে ১৬০০০ টাকা পর্যন্ত বেতন পান, যা বর্তমান বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। হেল্পার, ফিটার, ওয়াটার ও অন্যান্য গ্রুপে কর্মরত শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের বৈষম্য লক্ষ করা যায়। অধিকাংশ শ্রমিকই পে-স্লিপ পান না, ফলে প্রকৃত মজুরি সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণ করার সুযোগ থাকে না।
কর্মঘণ্টার বিষয়েও শ্রম আইনের চরম লঙ্ঘন দেখা গেছে। শ্রম আইনের ধারা ১০০ অনুযায়ী একজন শ্রমিক দৈনিক সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা কাজ করতে পারেন এবং বিশেষ প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা ওভারটাইম করা যেতে পারে। অথচ জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ শ্রমিক প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কাজ করছেন। ৩৯ জন শ্রমিক ওভারটাইম ভাতা পেলেও ১৯ জন তা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।
ছুটি ও সামাজিক সুরক্ষার দিক থেকেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। মাত্র ৯ জন শ্রমিক সবেতন ছুটি পান, বাকি ৪৯ জন শ্রমিক কোনো ছুটি পান না। ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ৩৯ জন শ্রমিক যুক্ত থাকলেও অনেকে চাকরি হারানোর ভয় বা সচেতনতার অভাবে যুক্ত হননি। এর পাশাপাশি, জরিপে অংশ নেওয়া ৫৮ জন শ্রমিকের কেউই গ্রুপবীমার আওতায় নেই, যদিও শ্রম আইনের ৯৯ ধারা অনুযায়ী ১০০ জনের বেশি শ্রমিক থাকলে গ্রুপবীমা বাধ্যতামূলক।
এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু করণীয় সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে—শ্রমিকদের জন্য নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও সবেতন ছুটি নিশ্চিত করা; সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন; প্রতিটি ইয়ার্ডে সেফটি কমিটি গঠন; গ্রুপবীমা চালু করা; মোবাইল ব্যাংকিং বা ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে বেতন প্রদান এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন তপন দত্ত, আহ্বায়ক, জাহাজভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম। জরিপ উপস্থাপন ও সঞ্চালনা করেন ফজলুল কবির মিন্টু। আলোচনায় আরও অংশ নেন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের নবনির্বাচিত সভাপতি আমজাদ হোসেন চৌধুরী, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ নুরুল্লাহ বাহার, অধ্যাপক কাজী নাজমুল হুদা, শ্রম দপ্তরের উপপরিচালক রুমানা আক্তার, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক টিপু সুলতান, সাংবাদিক ওমর ফারুক, রিপোর্টার ইমাম হোসাইন রাজু এবং জাহাজভাঙা শ্রমিক সেফটি কমিটির সদস্য সচিব মোঃ আলী এবং যুগ্ম সদস্য সচিব মোঃ ইদ্রিছ প্রমুখ।
এসময় মালিক পক্ষের প্রতিনিধি ও জাহাজভাঙা মালিক সমিতির সভাপতি আমজাদ হোসেন উপস্থাপনার কিছু বিষয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী ওভারটাইম ভাতা দেওয়া হয় এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে মালিকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, “ভারত সরকার যেভাবে জাহাজভাঙা শিল্পকে সহায়তা করছে, আমাদের সরকার সেভাবে সহযোগিতা করছে না। আমরা প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা সরকারের তহবিলে জমা দিচ্ছি, অথচ আমাদের প্রতি মনোযোগ কম।”
সবশেষে বলা হয়, ১৯৮০’র দশকে যাত্রা শুরু করা এই শিল্পে ইতোমধ্যে ১৭টি ইয়ার্ড গ্রিন সার্টিফায়েড হয়েছে। এই সাফল্যের পেছনে মালিকদের বিনিয়োগের পাশাপাশি শ্রমিকদের পরিশ্রম, ঘাম ও দক্ষতা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই টেকসই উন্নয়নের জন্য শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতেই হবে।
নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মপরিবেশ গড়ে তুলতে পারলেই বাংলাদেশ একটি মানবিক ও টেকসই জাহাজভাঙা শিল্পের আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।
