মতামত

শক্তিশালী বিকল্প গড়ার ডাক: সিপিবির কংগ্রেস ও বাংলাদেশের বাম রাজনীতির পথচলা

-ফজলুল কবির মিন্টু –

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থার ইতিহাস দীর্ঘ, সংগ্রামী এবং নানা চড়াই-উৎরাইয়ে ভরা। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, শ্রমিক-কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন—এই সবকিছুর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) রাজনীতি গড়ে উঠেছে।

সম্প্রতি সিপিবির ত্রয়োদশ কংগ্রেসে যে রাজনৈতিক প্রস্তাব ও দিকনির্দেশনা উত্থাপিত হয়েছে, তা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক গভীর প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করায়—এই রাষ্ট্র, সমাজ এবং ক্ষমতার কাঠামো কি জনগণের পক্ষে কাজ করছে? যদি না করে, তবে এর বিকল্প কী হতে পারে?

বাম রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা

সিপিবি তাদের কংগ্রেসে যে বার্তা দিয়েছে, তা স্পষ্ট ও সময়োপযোগী—“জনগণের শক্তিকে সংহত করে শক্তিশালী পার্টি গড়ে তুলতে হবে”। এই বক্তব্য একদিকে যেমন একটি অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক চ্যালেঞ্জের স্বীকৃতি, অন্যদিকে তা জাতীয় রাজনীতিতে একটি বিকল্প মঞ্চ তৈরির প্রত্যাশাও।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত—একদিকে শাসকগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয়কৃত ক্ষমতার রাজনীতি, অন্যদিকে দুর্বল ও বিভক্ত বিরোধী রাজনীতি। এই পরিস্থিতিতে জনগণের মাঝে একপ্রকার রাজনৈতিক হতাশা ও বিমুখতা তৈরি হয়েছে। সিপিবির প্রস্তাবিত “বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন” এই স্থবিরতা ভাঙার একটি সাহসী ডাক হতে পারে, যদি তা কার্যকর সাংগঠনিক পুনর্গঠন ও বৃহত্তর গণসংযোগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যায়।

সমাজতন্ত্র: কেবল স্বপ্ন নয়, প্রয়োজন

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, “শোষণ ও বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করতে হবে”। এটি কেবল একটি তাত্ত্বিক দাবি নয়, বর্তমান সময়ে বৈষম্য, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দমননীতির প্রেক্ষাপটে এটি হয়ে উঠেছে বাস্তবিক চাহিদা।

সিপিবি যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে যুক্ত করেছে, তা একধরনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার দাবিও তুলে ধরে। তবে প্রশ্ন হলো—এই দাবি কিভাবে সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হবে? কিভাবে এই প্রস্তাব কেবল দলীয় নীতি না থেকে একটি জনপ্রিয় গণআন্দোলনের রূপ নেবে?

সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই

রাজনৈতিক প্রস্তাবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট প্রবণতা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান। সাম্প্রতিক সময়ের ধর্মীয় উগ্রতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তিগুলোর প্রেক্ষাপটে এই অবস্থান অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

সিপিবি যদি এই ইস্যুগুলোতে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করতে পারে এবং অন্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, তবে তারা সত্যিকারের বিকল্প শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

নির্বাচনী রাজনীতি ও গণসংগঠন

সিপিবি তাদের কংগ্রেসে নির্বাচনী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের কথা বলেছে। তবে এটাও উপলব্ধি করেছে যে, শুধুমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন শক্তিশালী গণসংগঠন—ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও পেশাজীবী শ্রেণির মধ্যে প্রগতিশীল সংগঠন গড়ে তোলা।

এই জায়গাটিতে অতীতে বামপন্থীরা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে তা দুর্বল হয়ে পড়েছে। সিপিবির সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—এই সংগঠনের কাঠামো পুনর্গঠন করে তা আবার কার্যকরভাবে মাঠে নামানো।

উপসংহার

সিপিবির ত্রয়োদশ কংগ্রেস একটি নতুন প্রত্যয়ের ইঙ্গিত দিয়েছে—সমাজতন্ত্র কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, তা ভবিষ্যতের প্রয়োজন। তবে কংগ্রেসের ঘোষণাপত্র কেবল কাগজে সীমাবদ্ধ থাকলে তা অর্থহীন হবে। প্রয়োজন সংগঠনকে তৃণমূলে শক্তিশালী করা, জনগণের জীবন্ত ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে সিপিবির ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, তা নির্ভর করবে তারা নিজেদের ঘোষণাকে কতটা বাস্তব রূপ দিতে পারে তার উপর। তবে একথা সত্য—রাজনীতি যখন কেবল ক্ষমতার খেলা হয়ে ওঠে, তখন ন্যায়ের রাজনীতির প্রয়োজন আরও বেড়ে যায়। আর সেই জায়গাতেই সিপিবির মতো শক্তিগুলোর দায় ও দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।

(লেখকঃ  বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার সাবেক সভাপতি এবং টিইউসি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক)