বিজন ভাবনা (১০): অজ্ঞতা -বিজন সাহা
মাঝে মাঝে এরকম পোস্ট দেখি যে অজ্ঞতাই সব দুর্গতির মূল। অজ্ঞতা থেকেই মানুষ বিভিন্ন রকমের খারাপ কাজ করে, অজ্ঞতা থেকে মানুষ অন্যের ক্ষতি করে। সব ধরণের অসামাজিক কাজের মূলে আছে অজ্ঞতা। আসলেই কি তাই? উল্টো যারা বেশি জানে তারাই তো মনে হয় সমাজ, দেশ ও মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। তাহলে?
প্রথমে আমাদের জানতে হবে অজ্ঞতা কি? এটা কি শুধুই ডিগ্রিহীনতা? এই যে আমি ইউনিভার্সিটি শেষ করেছি, পিএইচডি করেছি, ডিএসসি করেছি তাই বলে কি নিজেকে বিজ্ঞ দাবি করতে পারি? ষাটের দশকের শেষে আর সত্তরের দশকে শুরুতে যখন প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম তখন অনেকেই স্কুল থেকে ছিটকে পড়েছিল। তারা হয়তো জীবনে কোন সার্টিফিকেট পায়নি তবে তারা যে অজ্ঞ সেটা কি বলা যায়? তারা প্রায় সবাই নিজের নিজের মত করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত। জ্ঞান এটাতো শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, জ্ঞান এটা অভিজ্ঞতা। আর এই অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করি জীবন থেকে।
এই গল্পটি আমি অনেকবার বলেছি, লিখেছি। বার বার বললেও কিছু গল্প পুরানো হয় না। তখন সেভার বয়স কত? পাঁচ বড়জোর! একদিন ওকে নিয়ে বাসায় ফিরছি মিউজিকের স্কুল থেকে। অফিসে কী একটা জরুরি জিনিস ভুলে ফেলে আসায় ওকে গেটের বাইরে দাড় করিয়ে সেটা আনতে গেছি। ফিরে যখন ওকে নিয়ে বাসার দিকে হাঁটছি ও তখন হঠাৎ করেই প্রশ্ন করল
– পাপা, আমাদের দুই জনের কে বেশি বুদ্ধিমান?
– এই দেখ, তুই বেহালা বাজাতে পারিস, আমি পারি না। তাই বেহালা বাজানো নিয়ে কথা হলে তুই বুদ্ধিমান। অন্যদিকে আমি তোর চেয়ে ভালো অংক কষতে পারি। অংক নিয়ে কথা হলে এই মুহূর্তে আমি বুদ্ধিমান। আসলে তুলনা চলে একই ধরণের বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে। দেখিস না একটা আপেলের সাথে একটা কমলা যোগ করে দুটো হয় না, একটা আপেল আর একটা কমলাই থাকে।
জানি না হঠাৎ এরকম উত্তর মাথায় এলো কেন? তারপরেও কেন যেন এভাবেই ওকে উত্তর দিলাম। হতে পারে আমার কাছে ওর নিজের গুরুত্ব বোঝাতে, অথবা হেঁয়ালি করে। তবে পরে অনেক বার মনে হয়েছে যে কারণেই আমি তখন সেটা বলি না কেন এবং সেভা সেটা বুঝেছিল কিনা, তবে সেভার জীবনে সেটা তেমন কোন প্রভাব না ফেললেও আমার জীবন দর্শনে নিঃসন্দেহে প্রভাব ফেলেছে। এখনও যখন ছাত্রদের ক্লাস নেই, আমি নিজে ওদের পড়াতে গিয়ে অনেক কিছুই শিখি বা অনেক কিছুই নতুন করে বুঝি। রুশরা বলে শত বছর বাঁচ শত বছর ধরে শেখ।
আজকাল মানুষের জানার পরিধি ও বৈচিত্র্য এতটাই বেড়ে গেছে যে এমনকি নিজের সাব্জেক্টেও সব জানা বা সব কিছু সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা সম্ভব নয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করার পরেও চাকরি জীবনে যখন কেউ কোন স্পেসিফিক কাজ শুরু করে তখন অন্য বিষয়ে পিছিয়ে পড়ে। একজন চোখের ডাক্তার কখনোই কান-নাক-গলার বিষয়ে পারদর্শী হবে না। অর্থাৎ কোন বিষয়ে একজন বিজ্ঞ মানুষ অন্য বিষয়ে অনায়াসে অজ্ঞ হতে পারে। ঐ সেই বাবু আর মাঝির মত! নদীতে ঝড় উঠলে বাবুর সব ডিগ্রি নিমিষেই অকেজো হয়ে যায় অথচ অক্ষর জ্ঞানহীন মাঝি ঠিকই বিপদ সামলে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যায়। তাই সমস্যা যতটা না অজ্ঞতায় তারচেয়ে বেশি নিজের জ্ঞানকে সব সমস্যার সমাধান বলে মনে করায় আর অন্যদের জ্ঞান বা অভিজ্ঞতাও যে ক্ষেত্র বিশেষে একই রকম কার্যকরী হতে পারে সেটা বুঝতে না পারায়। আর ভিন্ন মত অবজ্ঞা করা বা ভিন্ন মত পালন করার অধিকার না দেয়া হল মৌলবাদ। তাই অজ্ঞতা নয় বরং মৌলবাদী আচরণ সব সমস্যার জন্ম দেয়। তবে মনে রাখতে হবে যে ভিন্ন মত হলেই যে কারো অধিকার আছে সেটা চর্চা করার তা কিন্তু নয়। সেই মত যেন মানবতা বিরোধী না হয়, সামাজিকভাবে ক্ষতিকর না হয় সেটাও মনে রাখতে হবে। তবে আমাদের যে স্টেরিওটাইপ গড়ে উঠছে তাতে জ্ঞান আর সার্টিফিকেট সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সবাই ছুটছে নম্বরের পেছনে। যদি কেউ পরীক্ষায় ভালো নম্বর পায় তাহলেই সে জ্ঞানী বা বিদ্বান। কিন্তু আসল পরীক্ষা যে পরীক্ষার হলে নয়, আসল পরীক্ষা হয় বাস্তব জীবনে সেটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। এবং একাডেমিক লাইফে খারাপ করা কেউ যদি জীবনে উন্নতি করে তাহলে সেটাকে আমরা অন্যায় মনে করি, মেনে নিতে পারি না। আর এ কারণেই আমাদের সব দেশে আমরা কাজের সঠিক মর্যাদা দিতে পারি না। ক্রিকেটার, ফুটবলারদের মত অন্য পেশার লোকজনের প্রতিও আমরা যদি একই রকম শ্রদ্ধা দেখাতে পারতাম তাহলে দেশের সামাজিক পরিবেশ একেবারেই ভিন্ন হত।
অনেক দিন আগে সেভার সাথে কথা হচ্ছিল কাজের ব্যাপারে। আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে ছোট কাজ বলে কিছু নেই। কারণ মানুষ যদি শুধু তথাকথিত সম্মানের কাজ করত তাহলে সমাজ অনেক আগেই লাটে উঠত। সমাজে আসলে ছোট বা বড় কাজ বলে কিছু নেই, আছে প্রয়োজনীয় আর অপ্রয়োজনীয় কাজ। যদি কৃষক ফসল ফলানো বন্ধ করে দেয় তাহলে ভদ্রলোককে আর খেয়ে পরে বাঁচতে হবে না। আবার যদি সুইপার রাস্তাঘাট নিয়মিত পরিষ্কার না করে তাহলে মানুষ বেশি দিন সেই রাস্তায় হাঁটতে পারবে না। এমনকি আমাদের সময়েও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ইতালীতে সুইপাররা ধর্মঘট করে বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের কাজ নিয়ে অনেকেই নাক সিটকালেও তাদের ছাড়া সমাজ অচল। হয়তো এখন রোবটের যুগে তাদের ছাড়াও অনেক কাজ হবে কিন্তু সমাজে সব সময়ই বিভিন্ন কাজ থাকবে এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজ প্রায়োরিটি পাবে। কিছুদিন আগেও আইটি স্পেশালিস্টদের চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। এখন আইএ-র কল্যাণে এই সেক্টরে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তাই অজ্ঞ তো নয়ই, এমনকি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও সমাজের ও সময়ের চাহিদার উপরে নির্ভর করে বিজ্ঞ মানুষ অজ্ঞ হচ্ছে আর অজ্ঞ মানুষ বিজ্ঞ। অজ্ঞতা আর বিজ্ঞতার পাশাপাশি আমাদের উন্নয়ন সম্পর্কেও সঠিক ধারণা থাকতে হবে। বর্তমান যুগে উন্নত সমাজ মানে মানবিক সমাজ। দিনের শেষে মানুষ শান্তি চায়, পরিবার পরিজন নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে চায়। এ কারণেই হয়তো আগে মানুষ একটা বয়সের পরে সংসার থেকে অবসর নিয়ে সন্ন্যাসী হত, মানে দৈনন্দিন জীবনের চাওয়া পাওয়া থেকে দূরে গিয়ে মানসিক শান্তি লাভ করতে চাইত। কিন্তু এই শান্তি নষ্ট করে কারা? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষিত মানুষ। তারাই অশিক্ষিত লোকজনকে ম্যানিপুলেট করে, তারাই নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য দেশে দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের অনেকেই বিশ্বসেরা ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট হয়েও দেশের পর দেশ ধ্বংস করেছে, মানব জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। তাই অজ্ঞতা নয়, মানুষের মানুষ না হওয়ার কারণে সমাজে বিপর্যয় ঘটে।
পৃথিবীতে সব বিষয়ে বিজ্ঞ যেমন কেউ নেই, সব বিষয়ে অজ্ঞও তেমনি কেউ নেই। প্রতিটি মানুষ নিজের নিজের জুতো পায়ে পথ চলে, নিজের মত করেই অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সেটা একান্তই নিজের। কেউ চাইলে তার কপি করার চেষ্টা করতে পারে কিন্তু তা কখনোই সব দিক থেকে খাপে খাপে মিলবে না। একই নদীতে যেমন দুইবার প্রবেশ করা যায় না ঠিক তেমনি কারোও অভিজ্ঞতা পুরোপুরি পুনরাবৃত্তি করা যায় না।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া