বিজন ভাবনা

বিজন ভাবনা (৮): যুদ্ধ নিয়ে যুদ্ধ  

-বিজন সাহা

গত ৩ সেপ্টেম্বর চীনের রাজধানী বেজিংএ ঘটা করে পালিত হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৮০ বছর। প্রেসিডেন্ট পুতিন সহ ২০ টি দেশের সরকার প্রধানের উপস্থিতিতে যুদ্ধ শেষের এই আয়োজনে চীন দেখাল ভবিষ্যৎ যুদ্ধে তার শক্তি। এর আগে অবশ্য তিয়ানজিং-এ সম্পন্ন হল সাংহাই ক্লাব বা এসসিও সামিট ২০২৫। ট্রাম্পের খাজনা নিয়ে বাজনা বাজানোর প্রেক্ষিতে সি, পুতিন ও মোদীর ত্রিমুখী করমর্দন এক নতুন সিগন্যাল দিল পৃথিবীকে। অনেকের ধারণা দীর্ঘদিন ধীর গতিতে চলার পর এই সামিটের মধ্য দিয়ে এক নতুন মেরু মাথা তুলে দাঁড়ালো। পশ্চিমা বিশ্ব স্বাভাবিক ভাবেই একে আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বের মালিকদের বিরুদ্ধে দাস বিদ্রোহ হিসেবে দেখার চেষ্টা করছে। তারা এটাকে গণতন্ত্র ও মুক্ত বিশ্বের বিরুদ্ধে একনায়কদের চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্ণনা করছে। যদিও সাংহাই ক্লাব কোন দেশের বিরুদ্ধে কোন রকম বাক যুদ্ধের অবতারণা করেনি, বরং বলেছে যে এখানে তারা জড়ো হয়েছে নিজেদের সমস্যার সমাধানের জন্য পশ্চিমা মাধ্যম এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই প্রথম পশ্চিমা বিশ্বকে সত্যিকার অর্থেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে কী সামরিক, কী অর্থনৈতিক, কী প্রযুক্তিগত, কী ডেমোগ্রাফিক – সব দিক থেকেই পশ্চিমা বিশ্বকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এমন এক শক্তিশালী সংগঠন উচ্চ কণ্ঠে তার আবির্ভাব জানান দিল। যারা আজীবন নিজেদের শাসক ও শোষকের ভূমিকায় দেখে অভ্যস্ত তারা সহজে এটা যে মেনে নিতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া কিছুদিন আগে আলাস্কায় ট্রাম্প ও পুতিনের সামিট নিয়ে পশ্চিমা এলিট খুশি নয়। এই ঘটনাকে ব্যবহার করে তারা ট্রাম্পকে শান্তির কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করে যুদ্ধের বলয়ে ফিরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই এই নিয়ে আরও অনেক জল যে ঘোলা হবে তাতে সন্দেহ নেই।

যদিও ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়েছে ৯ মে (সময় ব্যবধানে ইউরোপে ৮ মে) এর পরেও চীনে যুদ্ধ চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এখানে যুদ্ধ শুরুও হয় অনেক আগে, আর জাপানকে অস্ত্র সজ্জিত করায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে আমেরিকা ও ইংল্যান্ড। জার্মানির ক্ষেত্রেও ব্যকিক্রম ছিল না। জাস্ট বিজনেস। হিটলারের জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন হারায় ২৭ মিলিয়ন মানুষ। চীনের ক্ষতি আরও বেশি। জাপানি সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে চীন হারায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ। সেই অর্থে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দুটো দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চীন, সবচেয়ে লাভবান আমেরিকা। যুদ্ধ পরবর্তী জাতি সংঘে স্থায়ী সদস্যের পদ তাই এদের রক্ত দিয়ে কেনা, আমেরিকা আর ইংল্যান্ড পেয়েছে তখনকার বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাবশালী অবস্থানের ফলে। ফ্রান্স পেয়েছে মূলত স্তালিনের দয়ায়। ফলে যুদ্ধে বিজয়ের মূল উৎসব যে মস্কো আর বেজিংএ হবে সেটাই স্বাভাবিক যদিও ইদানিং কালে এদের অবদানকে অস্বীকার করার চেষ্টা চলছে পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে।

পশ্চিমা বিশ্ব তথা ইউক্রেন তাকিয়ে ছিল তিয়ানজিং সামিটে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কোন ঘোষণা দেয়া হয় কিনা সেটা দেখতে। প্রেসিডেন্ট পুতিন সেখানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সাথে সাক্ষাৎ কালে আলাস্কা সামিট সম্পর্কে অবহিত করেন, তবে ইউক্রেন নিয়ে এখানে কোন ঘোষণা আসে না। উপস্থিত নেতারা এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। তবে বেজিংএ পুতিন বিষয়টি এড়িয়ে যাননি। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, রাশিয়া সব সময়ই আলোচনার জন্য প্রস্তুত ছিল, এখনও আছে। রাশিয়া নয়, পশ্চিমা বিশ্ব ও ইউক্রেন বারবার আলোচনার মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আর সেই ব্যর্থতা এখন রাশিয়ার কাঁধে চাপাতে চাচ্ছে। রাশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন এড়িয়ে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যদি পশ্চিমা বিশ্ব সেটা না বুঝতে চায় তবে রাশিয়া যুদ্ধের মাধ্যমেই তার লক্ষ্য অর্জন করবে। এই প্রথম বারের মত প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধ বিরতির ব্যাপারে এরকম ক্যাটগরিক্যালি উত্তর দিলেন।

আমেরিকা আপাতত এ ব্যাপারে মৌনতা বজায় রাখলেও ইউরোপ বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ইউক্রেনের জন্য দল গঠনের চেষ্টা করছে। বাল্টিকের দেশগুলো, ফিনল্যান্ড সায় দিলেও ইতালি নিজেকে দূরে রাখছে, যেমন রাখছে হাঙ্গেরি আর স্লোভাকিয়া। জার্মানি সরাসরি কিছু না বললেও যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পক্ষে মত দিচ্ছে। খুব সম্ভব এস্টোনিয়া মেয়েদের সেনা বাহিনীতে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে। এতে করে ১৫ হাজার পুরুষ সেনার পাশাপাশি আরও ১৬ হাজার মহিলা সেনা তারা পাবে। জার্মানিও ভাবছে সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার কথা। এক কথায় যুদ্ধের দামামা বাজছে তো বাজছেই। যে ইউরোপ ইউক্রেনের হয়ে যুদ্ধের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যায় করছে সেই ইউক্রেনের লাখ লাখ তরুণ যুদ্ধ এড়িয়ে ইউরোপ বা অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিচ্ছে আর ইউক্রেনের এলিট শ্রেণী পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আসা অর্থে ইউরোপ, আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন প্রাসাদ গড়ছে। আসলে শাসক শ্রেণী যখন অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ হয় তখন কী ইউরোপ কী আমেরিকা কী এশিয়া কী আফ্রিকা – ভূগোল নির্বিশেষে সব জায়গায় নরক নেমে আসে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয় ইউরোপ আর আমেরিকার প্ররোচনায়। ইউরোপ আমেরিকার নেতারা পুতুলনাচের কলাকুশলী থেকে নিজেরাই পুতুল হয়ে গেছে। আজ তাদের তৈরি জেলেনস্কি পশ্চিমা এলিটদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানির রাষ্ট্রনায়করা অস্ত্র আর অর্থ দিয়ে জেলেনস্কির খায়েশ মেটাতে দুই হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে উরসুলার বিরুদ্ধে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নয় ইউক্রেনের স্বার্থ রক্ষার অভিযোগ এসেছে। অবশ্য এতে অবাক হবার কিছু নেই। বিগত জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছিলেন জার্মানি নয় ইউক্রেনের মানুষের স্বার্থ রক্ষাই তার প্রথম দায়িত্ব। আগে কি কল্পনা করা যেত বিভিন্ন মানি লন্ডারিং স্ক্যামে জড়িত থাকার পরেও উরসুলা ক্ষমতায় থাকবে? মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে, সমাজের অধঃপতন নেতাদের দিয়ে। আসলে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী নব্বইয়ের দশকের পশ্চিমা নেতাদের অদূরদর্শিতা, বৃহৎ পুঁজির অতিরিক্ত লোভ আর রাজনীতির বানিজ্যিকীকরণ। বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে দেশে দেশে তারা (আমেরিকা ও বৃহৎ পুঁজি) নিজেদের লোকদের ক্ষমতায় বসিয়েছে আর এটা করতে গিয়ে ঢেলেছে অঢেল অর্থ। দেশপ্রেম নয় বৃহৎ পুঁজির প্রতি আনুগত্য হয়েছে ক্ষমতায় আসা বা টিকে থাকার মানদণ্ড। ফলে অর্থ আর প্রোপ্যাগান্ডার জোরে ভোটে জিতেও বেশিরভাগ শাসক অচিরেই অজনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কিন্তু নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সাম্প্রতিক ভোটের ইতিহাস সেটাই বলে। এমনকি এই মুহূর্তে জার্মানির বিরোধী দল অল্টারনেটিভ জার্মানির সাত জন প্রার্থী সন্দেহজনক ভাবে মৃত্যু বরণ করেছে বলে শোনা গেছে। যে গণতন্ত্রের জন্য ঠাণ্ডা যুদ্ধ, যে গণতন্ত্রের জন্য বিভিন্ন দেশ মাটিয়ে মিশিয়ে দেয়া আজ গণতন্ত্রের আবাসভূমি বলে পরিচিত ইউরোপ আমেরিকা থেকেই গণতন্ত্র বিদায় নিচ্ছে। তাহলে এত রক্তপাত কার জন্য? মানুষ শিক্ষা দীক্ষায়, বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে যত উন্নত হচ্ছে ঠিক সেই পরিমানেই কি তার অধঃপতন ঘটছে না নৈতিক ভাবে? আমাদের স্কুল জীবনে সাইন্স ও আর্টস মানে বিজ্ঞান ও মানবিক (আর্টস বা কলাকে মানবিক বলা হত) এই দুই বিষয়কে পরস্পর বিরোধী মনে করা হত। এখন মনে হয় বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে মানবিক গুনাবলীর পশ্চাৎমুখী যাত্রা। সবচেয়ে মজার কথা এর পেছনেও রয়েছে একান্ত মানবিক গুণাবলী – লোভ, লালসা ইত্যাদি। প্রকৃতি পদার্থবিদ্যার নিয়ম মেনে চলে। আসলে সত্য হল প্রকৃতি নিজের নিয়মে চলে আর আমরা তার যে ব্যাখ্যা দেই সেটা পদার্থবিদ্যা। নিত্যতার সূত্র সেই পদার্থবিদ্যার একটি অন্যতম মূল স্তম্ভ। কে জানে ভালোমন্দ – এটাও নিত্যতার সূত্র মেনে চলে কিনা? কোন বিষয়ে সমাজ ভালো করলে অন্য বিষয়ে তাকে খারাপ করতেই হবে। আসলে ইউরোপ আমাদের যেমন রেনেসাঁ দিয়েছে, দিয়েছে শিল্প বিপ্লব, আধুনিক শিক্ষা, তেমনি সে দিয়েছে উপনিবেশবাদ, দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধ। আজ এই ইউরোপই যে দ্রুত গতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে অবাক হবার কী আছে! মাতাল খুব বেশি রকম মাতলামি শুরু করলে তার গায়ে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিতে হয়। আমেরিকা পারে সেটা করতে। নাহলে দুই গালে জোরে থাপ্পর মারতে হয়। সেই ভার হয়তো নিতে হবে রাশিয়াকে। তবে তত দূর পর্যন্ত যাতে এগুতে না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে পশ্চিমা বিশ্বের জনগণকে। কেননা যুদ্ধের সব ধকল তো যাবে তাদের উপর দিয়েই। ইউক্রেন যুদ্ধে মরছে সাধারণ মানুষ কিন্তু নেতাদের পরিবার পরিজন অনেক আগেই ইউরোপ আমেরিকার প্রাসাদোপম অট্টালিকায় বসে দিন কাটাচ্ছে যুদ্ধের জন্য আনা ঋণের টাকায়। ফেরত দেবে তো জনগণ। পৃথিবী থেকে শান্তি আজ নির্বাসিত। যুদ্ধ চলছে, চলবে। কারণ যুদ্ধ খুব লাভজনক ব্যবসা। যত বেশি মানুষ মরবে জীবিতদের ভাগে তত বেশি অক্সিজেন থাকবে। একসময় দেশে প্রায়ই একটি স্লোগান শোনা যেত – লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই। ইউরোপ লড়াই চাইছে, রাশিয়া যে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে প্রস্তুত সে ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

পড়ুন:  বিজন ভাবনা (৭): তন্ত্রের গোলকধাঁধা -বিজন সাহা

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো