বিজন ভাবনা (৭): তন্ত্রের গোলকধাঁধা -বিজন সাহা

হাঁটতে হাঁটতে সেভা আর আমি চলে এলাম মস্কো নদীর উপরে পায়ে হাঁটা সাঁকোর কাছে। আমাদের ছাত্র জীবনে মস্কো নদীর উপর অসংখ্য ব্রীজ থাকলেও পায়ে হাঁটা ব্রীজ ছিল বলে মনে করতে পারছি না, মানে সেই ব্রীজ যা দিয়ে শুধু পায়ে হেঁটে নদী পার হওয়া যায়। এখন এ রকম ব্রীজের সংখ্যা অনেক। এর একটা নিস্কুচনি সাদের কাছে, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশে। এছাড়া আছে ক্রাইস্ট দ্য স্যাভইর গির্জার পাশে, কিয়েভস্কায়ার ওখানে, ফলে কিয়েভস্কায়া হয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে যাওয়া সহজ হয়ে গেছে, আছে মস্কো সিটির ওখানে। এসব ব্রীজ পায়ে হেঁটে মস্কো ঘোরা অনেক সহজ করে দিয়েছে। অনেকক্ষণ হাঁটছি তাই সেভা জিজ্ঞেস করল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারব কি না। আসলে হাঁটতে সমস্যা না হলেও উপরে উঠতে আজকাল একটু হাঁপিয়ে উঠি। আমাদের জন্য লিফটের ব্যবস্থা আছে। ওখান থেকে নেমে যখন ফ্রুঞ্জেনস্কায়ার দিকে হাঁটছি একদল তরুণ তরুণী ইলেকট্রিক স্কুটারে করে শো শো করে বেরিয়ে গেল।
– যাই বল, মস্কোয় এই স্কুটার নিষিদ্ধ করা উচিৎ।
আমি জানি সেভা সোভিয়েত ইউনিয়ন খুব একটা পছন্দ করে না, তাই ইচ্ছে করেই বললাম
– যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকত তাহলে আর এসব থাকত না। এখন চাইলেও বন্ধ পারবে না। মেয়র থেকে জনমত যাচাই করে জানতে চাইছে মস্কোবাসীরা এরকম স্কুটার চায় কি না। এটা গণতন্ত্র। মানুষের মতামত না নিয়ে কিছু করতে পারে না। যদি বেশির ভাগ মানুষ না চায়, তাহলে সরকার বন্ধ করবে যদিও যা কিছু নিষিদ্ধ করে মানুষ সেটাই বেশি করে করে।
– তাই বলে কি আমাদের সোভিয়েত সিস্টেমে ফিরে যেতে হবে? আমার মনে হয় সেটা খুবই খারাপ হবে।
– সোভিয়েত ইউনিয়ন তো শুধু কোন দেশ নয়, সেটা একটা সিস্টেম যেখানে চাইলেই ফিরে যাওয়া যায় না। সে জন্য সমাজের, সামাজিক সম্পর্কের খোলনলচে বদলিয়ে ফেলতে হয়। সেটা খুব সহজ নয়। সবচেয়ে বড় কথা এ রকম দেশে বাস করার জন্য বিশেষ মানসিকতার মানুষ দরকার। কারণ সমাজতন্ত্র বলি আর গণতন্ত্র বলি – সবই মানুষের হাতে তৈরি। এদের লালন পালন ও বিকাশের দায়িত্ব মানুষের। এই মানুষই এক সময় গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র সৃষ্টি করেছিল, তারাই এখন এসব ধ্বংস করছে। কেন? কারণ এসব নীতির প্রথম ও প্রধান শর্ত অন্যকে সাহায্য করা, অন্যের অধিকারের জন্য লড়াই করা। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ নিজের জন্য লড়তে আগ্রহী, অন্যের জন্য নয়। অন্যের অধিকার কায়েম না করে নিজের অধিকার রক্ষা করা কষ্ট।
– কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তো সব দিক থেকেই পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। শিল্প, বানিজ্যের কথা না হয় বাদই দিলাম, এমনকি মানবতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা এসব ক্ষেত্রেও।
– ঠিক। তবে এখানে দুটো কথা বলতে হয়। এই যে আমরা যে বাসায় থাকি সেটা অনেক পুরানো, ১৯২৯ সালের। আমাদের পাশের নতুন বিল্ডিংগুলোয় একেটা বাসার দাম কয়েক মিলিয়ন ডলার। আমরা কোন দিন ওখানে বাসা কিনতে পারব না, অথচ অনেকেই কিনছে। মানে এখন রাশিয়ায় মানুষের আয়ের বিরাট তারতম্য যেটা সব পুঁজিবাদী দেশেই আছে। এটা আমার মনে হয় শুধু সম্পদের ক্ষেত্রেই নয়, পুঁজিবাদী দেশে সবার বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা একই রকম কিনা সে নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। তাছাড়া সবার ভাত কাপড়ের অধিকার থাকা আর ভাত কাপড় থাকা এক নয়। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নে খুব ভালো না হলেও সবাই চিকিৎসা পেত, পেত পড়াশুনা করার সুযোগ, মাথা গোঁজার ঠাই। এটা কিন্তু পশ্চিমা দেশের ক্ষেত্রে বলা যাবে না। যদি পরিবর্তন কিছু হয়ে থাকে সেটা সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণেই।
– শোষণ তো সোভিয়েত ইউনিয়নেও ছিল। পার্টির লোকেরা শুনেছি কাজ না করে ভালো থাকত।
– ছিল। তবে অন্য ধরণের। এখন আমরা প্রায়ই ডিপস্টেট বলে একটা কথা শুনি। আমার মনে হয় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ছিল এই ডিপস্টেটের প্রটোটাইপ। এখানে সরকার থাকলেও সব কিছু হত পার্টির নিয়ন্ত্রণে, পার্টির নির্দেশে। এটাকে বলা চলে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। যার কোন জবাবদিহিতা ছিল না জনগণের কাছে যদিও সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করত। এরা ছিল আমলার উপরে আমলা। আর আমলা মানেই যারা কোন কিছু উৎপাদন করে না কিন্তু ভোগ করে। এটা ছিল সোভিয়েত আদর্শের পরিপন্থী।
– মানে?
– সোভিয়েত আদর্শ কী? এক কথায় বললে সমাজতন্ত্রে মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ (উৎপাদন) করবে আর কাজ অনুযায়ী বেতন পাবে। পার্টির এসব লোক ঐ অর্থে কোন উৎপাদন করত না, কিন্তু সবচেয়ে বেশি বেশি ভোগ করত। তবে শুধু এটাই নয়, এর বাইরেও দেশের জনগণের এক বিশাল অংশ এ ধরণের শোষণের সাথে জড়িত ছিল।
– সেটা আবার কি করে?
– মানুষ যেহেতু কাজ না করলে বেতন পেত না আর বেতন না পেলে চলতে পারত না, তাই সবাইকে বাধ্যতামূলক ভাবে কাজ করতে হত। ফলে প্রায়ই দেখা যেত অযোগ্য লোকদের কাজ দেয়া হচ্ছে। এরা যে শুধু কাজ করত না তা নয়, এরা কাজ না করে অন্যদের সমান বেতন পেত। যোগ্য ও দক্ষ লোকেরা তাদের শ্রম দিয়ে যে বেতন পেত প্রায় একই পরিমাণ বেতন পেত অযোগ্য ও অদক্ষ লোকেরা। সেই অর্থে এই অদক্ষ লোকেরা মূলত দক্ষ মানুষদের শোষণ করত। পুঁজিপতি হয়তো একাই প্রচুর শোষণ করে কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে এই অযোগ্য অদক্ষ কর্মী ছিল অসংখ্য, আর তাই তাদের টোটাল শোষণের পরিমাণ মনে হয় কয়েক জন পুঁজিপতিকে ছাড়িয়ে যেত। এর ফলে তৈরি হয়েছিল বিশাল ক্ষুদ্র শোষক বাহিনী যারা সেই অর্থে উৎপাদন না করেও দেশের বিশাল সম্পদ ভোগ করত। এসব ঘটনা সত্যিকারের দক্ষ ও কর্মঠ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ, কাজের প্রতি বিতৃষ্ণার জন্ম দিত। আর এসব কিছু সম্মিলিত ফল ছিল ভয়ঙ্কর। কিন্তু সরকার যদি মানুষকে বেশি পরিমাণ আয় করার আইনি সুযোগ দিত তাহলে দক্ষ ও কর্মঠ লোকেরা বেশি করে কাজ করত, আয় করত, আর যারা অকর্মণ্য তারা হয় কাজ করতে বাধ্য হত, না হলে অন্তত যারা বেশি বেশি কাজ করছে তাদের বোকা ভেবে হাসাহাসি করত না। ফলে যোগ্য লোকেরা শুধু কাজ করে আনন্দই পেত না, পেত বেশি বেতন আর সুন্দর জীবন যাপনের সুযোগ। আর সেটাই হত সামাজিক ন্যায়। ন্যায্য বন্টন মানে সবার মধ্যে সমান বন্টন নয়, যে যেটুকুর যোগ্য তাকে সেইটুকু দেয়া। আসলে ন্যায় বিচার বিষয়টি খুবই সুক্ষ, একটু এদিক ওদিক হলে কারও না কারও প্রতি অন্যায় করা হয়। আর তার ফলাফল হয় ভয়ঙ্কর। আসলে বর্তমানে ইউরোপে যা ঘটছে তার অনেক কিছুই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শিক্ষা না নেবার ফল।
যেমন?
এক সময় পশ্চিমা বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দেবার জন্য ও নিজ নিজ দেশে সমাজতন্ত্রের আন্দোলন স্তিমিত করতে শোষণ পীড়ন অনেকটাই কমিয়ে জনজীবন সহজ করে তোলে। এর ফলে জন্ম নেয় বিভিন্ন ওয়েলফেয়ার স্টেট। এরা পুঁজিবাদী পথে চললেও সামাজিক জীবনে সমাজতন্ত্রের অনেক কিছুই গ্রহণ করে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অনেক দেশে সামাজিক খাতে ব্যয় কমানো হয়। তবে সব ক্ষেত্রে নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তার প্রভাব বিস্তারের জন্য বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে বড় রকমের ইনভেস্ট করত। এই আমি যে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করেছি সেটাও সেই প্রকল্পের অধীনেই। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন মনে হয় প্রতিদানে কখনও তেমন কিছু চায়নি বা পাবার চেষ্টা করেনি। পুঁজিবাদী বিশ্বও ইনভেস্ট করেছে, কিন্তু কড়ায়গণ্ডায় সেসব উসুল করে নিয়েছে। পরবর্তী কালে সেখানেও সেই সোভিয়েত স্টাইলের ইনভেস্ট শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ইমিগ্র্যান্টদের ক্ষেত্রে। পশ্চিমা বিশ্ব বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাবে নিজেদের সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করে সেসব দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে, যুদ্ধ লাগিয়েছে। বিভিন্ন রঙিন বিপ্লবের ফলে আরব বিশ্ব ও আফ্রিকা থেকে প্রচুর শরণার্থী এসব দেশে এসেছে, যেমন এসেছে এশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। এসব শরণার্থীরা বিনা পরিশ্রমে সরকারি অর্থে এসব দেশে বাস করছে যা স্থানীয় অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এটা অনেকটা সোভিয়েত ইউনিয়নে অযোগ্য লোকদের কাজ দেবার মত এমনকি তারচেয়েও খারাপ, কেননা মানুষ কাজ না করেই সব পাচ্ছে। এটা সামাজিক অসন্তোষ তৈরি করছে আর তৈরি করছে পটেনশিয়াল মৌলবাদী শক্তি – ধর্মীয় ও ফ্যাসিস্ট দুই ধরনেরই। কথা হল কেন পশ্চিমা বিশ্ব সেটা করছে। আসলে সেটা করছে পশ্চিমা বিশ্বের এলিট শ্রেণী যারা আর দেশের পুরাতন বাসিন্দাদের কাছে জনপ্রিয় নয়, কিন্তু নবাগত শরণার্থীরা তাদের ভোট ব্যাংক হিসেবে কাজ করে। এরা আবার সস্তা শ্রমিকও। কিন্তু সেটা প্রথম প্রজন্মের। পরবর্তী প্রজন্ম স্থানীয়দের মত বেতন দাবি করে এবং বেকার বাহিনী বাড়ায়। সব দেখে মনে হয় না সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ কেউই এখনও পর্যন্ত সেই ফর্মুলা আবিষ্কার করতে পারেনি যার ফলে প্রায় সবার জন্য কর্ম সংস্থান করা যেত আবার সবার মধ্যে বেশি করে কাজ করার উৎসাহও বিদ্যমান থাকত। তবে বর্তমানে যেভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের স্থান দখল করছে তাতে কিছুদিনের মধ্যেই মানুষের করার মত তেমন কোন কাজ থাকবে না।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া
