বিজন ভাবনা

বিজন ভাবনা (৬): শান্তি নিয়ে অশান্তি

-বিজন সাহা

আলাস্কা সামিট নিয়ে বিভিন্ন প্রথম দিকের আলোচনা শুনে মনে হল ট্রাম্প ও পুতিনের আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে বলেই বেশিরভাগ মানুষের ধারণা। এসবই অবশ্য পশ্চিমা মাধ্যমের বয়ান। তাই প্রশ্ন জাগে এটা সত্য নাকি পশ্চিমা এলিটদের বেশির ভাগ যা চায় সেটাই সত্যের মোড়কে বাজারে ছাড়া। পশ্চিমা এলিট ইউক্রেন ও ইউরোপের অনুপস্থিতিতে রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে ইউক্রেন বিষয়ে কোন চুক্তি হোক সেটা চায়নি। আমার আরও মনে হয়েছে একদল মানুষ ধারণা করেছিল যে আলোচনা মানেই আত্মসমর্পণ যেটা কিছুদিন আগে ফন ডের লায়েন করেছে ইউরোপের হয়ে ট্রাম্পের কাছে। দুই পক্ষের লড়াইয়ে একপক্ষ দুর্বল হলে সেটা হয় বেদম প্রহার আর দুই পক্ষ সমান হলে হয় মারামারি। সেখানে সহজে সমঝোতা আসে না, অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন থেকেই যায়। আর এসব প্রশ্নে দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়। প্রেস কনফারেন্সে পুতিন ও ট্রাম্পের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে এটা সাত দিনের প্রায় বিনা প্রস্তুতিতে আয়োজিত কোন সামিট নয়, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার ফসল। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ দিন যোগাযোগ না থাকায় যে পাহাড় প্রমাণ সমস্যা তৈরি হয়েছে সেসব বিষয়েই সার্বিক আলোচনা হয়েছে। এখানে ইউক্রেন নিমিত্ত মাত্র আর সেটা এদের সার্বিক যোগাযোগ থেকে দৃষ্টি এড়ানোর জন্য।

ইউক্রেন প্রশ্নে এখনও সমঝোতা হয়নি। কারণ সেটা করতে হলে ইউক্রেনের মতামত জানতে হবে। তাছাড়া বর্তমানে ইউক্রেন নিজের বুদ্ধিতে চলে না, তার উকিল অনেক। কথায় বলে অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। স্মরণ করা যেতে পারে ২০২১ সালে শেষ দিকের কথা যখন রাশিয়া প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে নিজের নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি লিখেছিল। সেখানে ন্যাটোর কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তারা। রাশিয়া ন্যাটোর কাছে তাদের নিরাপত্তার দাবিতে অটল সেটা নতুন করে ব্যক্ত করেছে। রাশিয়ার নিরাপত্তা বাইপাস করে ইউরোপ ও ইউক্রেন নিরাপদ নয় এটা তারা বুঝিয়ে দিয়েছে এবং এ বিষয়ে আমেরিকার সাথে একযোগে কাজ করার আগ্রহ জানিয়েছে।

শক্তির অবস্থান থেকে কাজ করা কখনো কখনো দুর্বলতার পরিচয়। আমেরিকা সবসময় সেখান থেকে কাজ করে। ফলে তাদের ছোটখাটো ব্যর্থতা মানুষ বড় করে দেখে। এটা অনেকটা বুমরা উইকেট বা কোহলি রান না পেলে জনমনে যে হতাশা তৈরি হয় সেটার মত যদিও এসব অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার ধারণা ইউক্রেনের বাইরে অনেক ব্যাপার নিয়েই আলোচনা হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই অনেক আগে থেকেই এই সামিট ইয়াল্টা সামিটের আধুনিক রূপ মনে করছে যেখানে চার্চিল তথা বৃটেনের স্থান নেই। আর এটাই বৃটেনের এই আলোচনার বিরোধিতার কারণ। যদি তাই হয় আমরা ধীরে ধীরে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা দেখতে পাব। অসুস্থ বিশ্ব রাজনীতিতে ইউক্রেন অনেকটা ক্যান্সারের মত। এখানে অস্ত্রোপচারের জন্য শরীরের অন্যান্য অংশের, বিশেষ করে ইউরোপের মানসিক সমস্যার উন্নতি দরকার। এমনকি এই মুহূর্তে যদি ইউক্রেন সমস্যার কোন সমাধান নাও হয় এই আলোচনা ভবিষ্যৎ বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

তবে এটা ঠিক ট্রাম্প আর পুতিনের আলাস্কা সামিটের পর আলোচনা শেষ হয়নি, বরং তা নতুন নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব উঠেপড়ে লেগেছে এটা বানচাল করার জন্য। জেলেনস্কি গোঁ ধরেছে সংবিধান রক্ষা করবেই। এ যেন সেই নন্দলালের অবস্থা। কেন? আচ্ছা সংবিধান যদি রক্ষা করতেই হয় তাহলে শুরুটা অনেক আগে থেকেই করা দরকার। এমনকি যদি ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা এসব বাদও দেই তাহলে অন্তত জেলেনস্কি যে অনেক আগেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেআইনি হয়ে গেছে সেটা তো নতুন কথা নয়। নাকি এটা সেই বাচ্চাদের মত খেলার সময় সুবিধামত সংবিধান মানা বা না মানা। আর ইউরোপের জনসমর্থনহীন এলিটরাও জেলেনস্কির সাথে সুর মিলিয়ে হুক্কা হুয়া করছে। কিন্তু এরা কি ভুলে গেছে জেলেনস্কির আর যাই থাক তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বলতে কিছুই নেই, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি বলতে তার অভিধানে কোন শব্দ নেই। আছে শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার অদম্য ইচ্ছে আর যুদ্ধকে ব্যবসায় পরিণত করে অনেক অনেক অর্থ উপার্জন করা যদিও কোন দিন সেটা ভোগ করতে পারবে কিনা সে নিজেও জানে না। আসলে পশ্চিমা বিশ্ব এখন কালেকটিভ ম্যাডনেসের শিকার। সবাই যেখানে পাগল সেখানে কে কার পাগলামি তাড়াবে। ওয়াশিংটনে জেলেনস্কি যাতে নতুন নাটকের জন্ম না দেয় তাই ইউরোপ থেকে গিয়েছে সব রথী মহারথীরা। কিন্তু তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বারবার বলে দিয়েছে শান্তি নয় তারা অশান্তির দূত।

কথায় বলে পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। অবশ্যই এখানে যে কেউ চাইলে যে কাউকে পিপীলিকা হিসেবে দেখতে পারে। তবে আমার মনে হয় এক্ষেত্রে ইউরোপের এলিট শ্রেণী পিঁপড়ার ভূমিকায় অভিনয় করছে। বিগত তিন দশকে ইউরোপের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে জড়িত ছিল রাশিয়ার সস্তা কাঁচামাল। তেল, গ্যাস, কাঠ, বিভিন্ন খনিজ সম্পদ আর ১৪০ মিলিয়ন মানুষের বিশাল বাজার। জনসংখ্যার দিক থেকে রাশিয়া ইউরোপের বৃহত্তম দেশ, ইউরোপীয় সংস্কৃতির ধারক এমন সব দেশের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে আমেরিকার পরেই রাশিয়ার স্থান।  আর যদি রেসের কথা বলি তাহলে রুশরা সবচেয়ে বড় শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী। তারপরেও ইউরোপ বিগত কয়েক শ’ বছর ধরে চেষ্টা করছে রাশিয়াকে ধ্বংস করার। কখনো কখনো সাময়িক ভাবে সফল হলেও প্রতিবারই পরাজিত হয়েছে। অথচ বন্ধুত্ব করলে সবাই ভালো থাকতে পারত, বিশেষ করে ইউরোপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ২৭ মিলিয়ন লোক হারানোর পরেও এরা জার্মানির প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল যার ফলে জার্মানি পরিণত হয় ইউরোপের অর্থনীতির লোকোমোটিভে। অথচ এই জার্মানি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে এখন সর্বোতভাবে ইউক্রেনকে প্ররোচিত করছে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। কেন? মনে হয় জার্মানি এখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজয় হজম করতে পারেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর হিটলার ২০ বছর সময় নিয়েছিল, ফ্রেডরিক মেরজ ৮০ প্লাস বছর সময় নিচ্ছে ১৯৪৫ সালে আত্মসমর্পণের পরে। ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলে জার্মানিকে আবার অস্ত্র সজ্জিত করতে চাইছে নাৎসিদের উত্তরসূরীরা। জার্মানির বর্তমান নেতৃত্বের অনেকেই ছিল গেস্টাপোর কর্মকর্তা। বাংলাদেশে রাজাকারদের উত্তরসূরীরা যেমন ৫৪ বছর পরে প্রতিশোধ নিয়েছে, নাৎসিরাও সেদিকেই এগুচ্ছে। দেশে বাম, প্রগতিশীল, একাত্তরের পক্ষের অনেকেই যেমন ছাত্র নামধারী অনেক পাকিস্তান পন্থীদের কূটকৌশল ধরতে পারেনি, ইউরোপের অনেকেই তেমনি জার্মানির বর্তমান শাসকদের আসল রূপ ধরতে পারছে না। যখন জার্মানি নিজেকে অস্ত্র সজ্জিত করে ইউরোপকে শুধু অর্থনৈতিক ভাবেই নয় সামরিক ভাবেও পদানত করবে তখন হয়তো এদের ঘোর কাটবে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাখো ইউক্রেনে সেনা পাঠাতে বদ্ধপরিকর। এ ব্যাপারে স্কট রিট্টার মাখোকে স্মরণ করিয়ে দেন যে ফ্রান্সের সেনা বাহিনী মাত্র কয়েক সপ্তাহে হিটলারের কাছে আত্মসমর্পণ করে, সেখানে মাত্র কয়েক জন রুশ সেনা দীর্ঘ ৫৮ দিন ধরে স্তালিনগ্রাদে পাভলভের বাড়ি নিজেদের দখলে রাখে।

পড়ুন:  বিজন ভাবনা (৫): ১৫ আগস্ট ২০২৫   -বিজন সাহা

ইউরোপ এখন ইউক্রেনের অধিকার নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু এই ইউরোপই কি ইউক্রেন তথা অন্যান্য দেশের অধিকার অনবরত খর্ব করছে না? আসলে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অন্যান্য দেশের অধিকার মানে এসব দেশে নিজেদের অবাধ নিয়ন্ত্রণের অধিকার। যে দেশই নিজেদের স্বার্থ নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় পশ্চিমা বিশ্বের চোখে সেই দেশ সাথে সাথে আউটকাস্ট হয়ে যায়। মনে রাখা দরকার যে মানবাধিকারের কথা বলে পশ্চিমা বিশ্ব কসোবাকে সার্বিয়ার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়েছে আবার সেই মানবাধিকারই যখন বার বার লঙ্ঘিত হয়েছে দনবাসে ইউক্রেন সেনাদের দ্বারা তখন তারা নিশ্চুপ। সমস্যা তাই অন্য দেশের নয়, সমস্যা পশ্চিমা বিশ্বের মানসিকতায়, সমান অধিকারের কথা বলে অন্য দেশ বা সমাজকে সেই অধিকার দিতে ব্যর্থ হওয়ায়। অনেক আগেই উপনিবেশ থেকে পাত্তারি গোটাতে বাধ্য হলেও তারা উপনিবেশবাদী মানসিকতা থেকে এখনও নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলিয়ে অযথা সমস্যার সৃষ্টি করছে।

শান্তি প্রচেষ্টা ভেস্তে দিতে এমনকি আলাস্কা সামিটের পরেও ইউক্রেন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়ায় বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ চালাতে। ইতিমধ্যে প্রায় ৩০০ কেজি বিস্ফোরক সহ একটি গাড়ি ধরা পড়েছে যার লক্ষ্য ছিল ক্রিমিয়ার ব্রিজ। এছাড়া এদেশে নাশকতামূলক কাজ চালানোর জন্য ব্রিটেন ও ক্যানাডা দ্বারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ইউক্রেনের একটি দল ধরা পড়েছে। তাই ইউক্রেন ও ইউরোপ যে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে শান্তি চুক্তির বারোটা বাজাতে তাতে সন্দেহ নেই। ইউক্রেনে রাশিয়াকে ভূমি ছাড় দিয়ে শান্তি চুক্তি করার বিষয়ে চালানো জনমত জরিপে দেখা যায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যারা যত দূরে তারা তত বেশি যুদ্ধের পক্ষে। লভভ ও ইউক্রেনের পশ্চিমাংশে, সেখানে বান্দোরার অনুসারীরা বরাবরই শক্তিশালী ছিল, যুদ্ধের পক্ষের লোক বেশি যেমনটা ইউরোপে পালিয়ে যাওয়া ইউক্রেনিয়ানদের মধ্যে। কারণ যুদ্ধের ফলে যে বিশাল অঙ্কের অর্থ এখানে আসছে তার ভাগ এরা পাচ্ছে বিভিন্ন ভাবে। যারা ইউরোপে তারা সেসব দেশের সরকারি অনুদানে উন্নত জীবন যাপন করছে। তাই যুদ্ধের অবসান মানে তাদের সুদিনের শেষ। ঠিক যেমনটি বলা যায় ইউরোপের এলিটদের ক্ষেত্রে। ট্রাম্প যে ইউরোপকে অস্ত্র কিনতে বাধ্য করছেন সেটাও অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের তুষ্ট করতে আর ইউরোপের গণ ধিকৃত নেতাদের লাইফ জ্যাকেট দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করতে। শুধু জেলেনস্কি আর তার নিকটতম বন্ধুরাই নয়, সেই যুদ্ধের প্রফিট পাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের বিশাল এক এলিট শ্রেণী আর ইউক্রেনের উগ্রপন্থীরা। আর যুদ্ধের ফলে পস্তাচ্ছে এসব দেশের সাধারণ মানুষ সহ তৃতীয় বিশ্বের জনগণ। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা কে কখন ভেবেছে?

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো