মতামত

এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়

-উৎপল দত্ত

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট। ইতিহাসের এক নির্মম হত্যাকান্ড এটা। আমি তখন স্কুলের ছাত্র । স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সকালে মা ডেকে বললেন  স্কুলে যেতে হবে না। বংগবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করেছে। স্কুল কলেজ সব বন্ধ। কি হচ্ছে দেখার জন্য গলির মোড়ে এসে দেখি ছোট খাট জটলা। একজন খুশিতে লাফাচ্ছে, অন্যরা দাঁড়িয়ে দেখছে। একটু অবাক হলাম। দেশের নেতার মৃত্যু হয়েছে কেউ এর বিরুদ্ধে কিছু বলছে না কেন?  যাই হোক পরে জানলাম এটা সামরিক অভ্যুত্থান। দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে না।

স্কুল জীবন শেষ হলো ১৯৭৭ সালে। এই বছর গুলো বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে শুনি নাই। একটা থমথমে পরিস্থিতি। তবে পাড়ার বড়ো ভাই যারা ছিলেন তাদের সাথে দেখা হলে, ক্লাবে খুব সাবধানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা করতেন ।

কলেজে ভর্তি হয়েছি । বন্ধুদের কাছ থেকে জানলাম ১৯৭৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ঢাকা থেকে একটি সাহিত্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে- যেখানে কবি নির্মলেন্দু গুন, মহাদেব সাহা, মোহাম্মদ রফিক সহ অনেকের কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। সংকলনটির নাম “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়”।

সংকলনটি চট্টগ্রামে কি ভাবে, কোথায় পাওয়া যেতে পারে খোঁজ খবর নেয়া শুরু করলাম। সময় ছিল বৈরী। ঐ সময় বঙ্গবন্ধু’র নাম প্রকাশ্যে উচ্চারণ করা সম্ভব ছিল না। কিছুদিন আগে ও যারা আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ছাত্র ইউনিয়ন বিভিন্ন কলেজে কাজ শুরু করেছে।

চট্টগ্রাম নিউমার্কেট এর বিপরীত দিকে জলসা সিনেমা হল। তার পাশেই ছিল কারেন্ট বুক সেন্টার। আমরা বই দেখার জন্য প্রতিদিন একবার কারেন্ট বুক সেন্টারে ঢুঁ মারতাম। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ পত্রিকা, ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন, বিভিন্ন সাপ্তাহিক এই দোকানে বিক্রি হত। আমরা মাঝে মাঝে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন কিনতাম। দোকানের মালিক জানতেন আমরা কেনার খরিদ্দার না, দেখার ও দাঁড়িয়ে পড়ার খরিদ্দার। আমরা বই পত্র ঘাটাঘাটি করি তাই হয়তোবা মালিক আমাদের একটু প্রশ্রয় দিতেন। উনাকে গিয়ে বললাম এই সংকলনটি আমাদের এনে দিতে হবে। উনি জানালেন এটা এখন পাওয়া যাবে না, সময় লাগবে। আমরা নিয়মিত তাগাদা দিতে লাগলাম । ১৯৭৮ সালের অক্টোবর এর শেষ কিম্বা নভেম্বরের প্রথম দিকে কারেন্ট এর মালিক আমাদের বললেন “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়” এর কয়েকটি কপি উনি এনেছেন। দাম রাখলেন ১৫ টাকা। আমাদের জন্য অনেক বেশি। ঠিক আছে, সংকলন তো পেলাম।

এই সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল সূর্য তরুণ গোষ্ঠীর ব্যানারে। সেই সময়কার তরুণ কবি ও ছড়াকারের কবিতা ও ছড়া এই সংকলনে স্থান পেয়েছিল। ছড়া ও কবিতা মিলে মোট লেখার সংখ্যা ছিল ত্রিশটি । সংকলনের কোন ভূমিকা ছিল না। শুরুতেই ছিল দুই বাংলার প্রথিতযশা কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি ছড়া। এই ছড়ার প্রথম দু’লাইন ছিল “যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবর রহমান”। মহাদেব সাহা লিখেছিলেন “আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়/ কোনো শংখচিল নয়, শেখ মুজিবের বেশে,/হেমন্ত কুয়াশা আর এই প্রিয়/মানুষের বেশে”। কবি নির্মলেন্দু গুন লিখেছিলেন “ মুজিব মানে আর কিছু না/ মুজিব মানে উক্তি/ পিতার সাথে সন্তানের/ অলেখা প্রেম চুক্তি”। হায়াৎ মামুদের কবিতা ছাপা হয়েছিল ‘মুজিবের এপিটাফ’ শিরোনামে, কবিতার শেষ দু’ লাইন ছিল এমন : আমরাও বেঁচে থাকি স্মৃতি নিয়ে তোর/তোর রক্ত ফুল হবে, আঙিনায় ভোর”।

এই সংকলনে যারা লিখেছিলেন যতদুর মনে আছে – অন্নদাশঙ্কর রায় , মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আলতাফ আলি হাসু, আখতার হুসেন, মোহাম্মদ রফিক, জাহিদুল হক, কবি দিলওয়ার, শান্তিময় বিশ্বাস, ইউসুফ আলী এটম, হায়াৎ মামুদ, রাহাত খান, ভীষ্মদেব চৌধুরী প্রমুখ। সব নাম এখন আর মনে ও নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর যখন বাংলাদেশ স্তব্ধ, এই নামটির প্রকাশ্য উচ্চারণ নিষিদ্ধ সেই রকম একটা সময়ে এই কাজটি ছিল একদল তরুণ এর দুঃসাহসিক অভিযাত্রা।

বাংলাদেশে আবার বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ। তার মৃত্যু দিবস পালন করলে মামলা ও জেল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মূলধারার কোন সংবাদপত্রে যখন কোন লেখা নেই মনে পড়ে গেল “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়” সংকলনের কথা। কবিতায় ও ছড়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যা কান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ।

(লেখকঃ সম্পাদক, প্রগতির যাত্রী ডট কম)