বিজন ভাবনা

বিজন ভাবনা (৫): ১৫ আগস্ট ২০২৫  

-বিজন সাহা

১৫ আগস্ট ২০২৫ – বঙ্গবন্ধু হত্যার ৫০ বছর। ভিন্ন পরিস্থিতিতে এই দিনটি হয়তো ভিন্ন মর্যাদায় পালিত হত, কিন্তু আজকের বাংলাদেশে যা কিছু বাংলাদেশের সাথে, বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত  সেসব নিষিদ্ধ। অন্তত প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যারা এই দিনটি পালন করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছে। এই যদি হয় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের ভাষা তাহলে এদের কাছ থেকে গণতন্ত্র কীভাবে আশা করা যায়? আর গণতন্ত্র যদি আশা না করা যায় তাহলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন তারা দেবে কীভাবে?

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যদি হয় বাঙালি জাতির জীবনে উজ্জ্বলতম দিন তাহলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো দিনগুলোর একটা। শেখ মুজিব ও তাঁর রাজনীতি নিয়ে ভিন্ন মত থাকতেই পারে তবে বাংলাদেশ সৃষ্টির ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা সর্বজনবিদিত। গান্ধীকে নিয়ে খোদ ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতভেদ আছে, তবে তিনি যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম স্তম্ভ সে ব্যাপারে না ভারতে, না বহির্বিশ্বে – কোথাও কেউই সন্দেহ পোষণ করে না, যেমন বহির্বিশ্বে কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় শেখ মুজিবের ভূমিকা অস্বীকার করে না, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। এটা আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত সত্য। সেই অর্থে শেখ মুজিব আর স্বাধীনতা সমার্থক। এখনও অনেক দেশের অনেক সাধারণ মানুষ বাংলাদেশ বলতে শেখ মুজিবের দেশ মনে করে আর মুজিব হত্যাকে বাংলাদেশের জনগণের বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করে। যারা মনে করে শেখ মুজিবের অনেক ভুল ছিল, যারা রাজনৈতিক ভাবে শেখ মুজিবের প্রতিপক্ষ ছিল তাদের নিঃসন্দেহে অধিকার ছিল মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করার, কিন্তু হত্যার অধিকার ছিল কি? বিনা বিচারে হত্যা অন্যায়। অন্যায় দিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা কি এতই সোজা? তাছাড়া যদি শেখ মুজিবকে প্রতিপক্ষ ভাবার অধিকার যেমন এক পক্ষের আছে একই ভাবে আরেক পক্ষের অধিকার আছে তাঁকে বঙ্গবন্ধু ভাবার, দেশের মহান নেতা ভেবে তাঁর জন্মদিন বা মৃত্যু দিবস পালন করার। যখন সেটা করতে বাধা দেয়া হয় – তখন যারা এটা করে তাদের দিয়ে আর যাই হোক গণতন্ত্র, আইনের শাসন এসব হয় না। সেটা সুষ্ঠু রাজনীতির পারিচায়ক নয়।

১৭৫৭ সালে ইংরেজ পরোক্ষ ভাবে শুধু বাংলা নয়, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এর আগে বাংলা অঞ্চলে বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্য থাকলেও সমস্ত বাংলা কখনোই বাঙালি শাসিত ছিল না। ১৯৪৭ সালে গঠিত পূর্ববঙ্গ বা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের ভিত্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল না, ছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বা দ্বিজাতিতত্ত্ব। সেদিক থেকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রথম বারের মত যে রাষ্ট্র আমরা পাই তার জন্ম ১৯৭১ সালে এদেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে চাষাভুষার অনন্য আত্মত্যাগের মাধ্যমে আর সে দেশের নাম বাংলাদেশ। বিদেশি শক্তি নয়, এই এলাকার ভূমিপুত্রদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জন্ম নেয় বাংলাদেশ যেখানে আনুষ্ঠানিক ধর্ম নয়, মাটি থেকে পাওয়া ধর্ম অর্থাৎ মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, জীবন ধারণের রীতিনীতি মানুষকে এক করেছিল এই লড়াইয়ে। সেই বিবেচনায় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে, বাঙালির স্বপ্নকে। ১৯৪৭ সালে এই অঞ্চলের মুসলমান যদি শুধু বাংলাভাষী মুসলমানদের জন্য একটি রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন করে তবে ১৯৭১ ছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ভাষা ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের জয়, শুধু ধর্মের ভিত্তিতে নয়, ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে এই অঞ্চলের ভূমিপুত্রদের জন্য একটি দেশের জন্য লড়াই। তাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছিল বাঙালি জাতিসত্ত্বার উপর আঘাত। একাত্তরে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত ও দুই লাখ মা বোনের আত্মত্যাগের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইতিহাসের চাকা উল্টে দেয়া।

এমনকি ১৯৭১ সালে যখন খুব অল্প সংখ্যক বাঙালি বিদেশে বসবাস করত তারাও বিভিন্ন ভাবে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বিশ্ব জনমত গঠনে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে সেটা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সামাজিক মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে যেমন বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি, তেমনি বিপক্ষের শক্তিও নানা ভাবে দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয় যেকোনো দেশের জন্যই সত্য। দেশে কথা বলার স্বাধীনতা যতই সীমিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী ডায়াস্পোরা তত বেশি সোচ্চার হয়েছে দেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। শুধু ২০২৪ এর জুলাই আগস্টেই নয়, অনেক আগে থেকেই সেটা ঘটে এসেছে। আর সেই সূত্র ধরেই গত বছরের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশীরা সক্রিয় ভাবে এতে অংশ নিয়েছে। সেখানে নিশ্চয়ই মেটাকুলাস প্ল্যান সম্পর্কে অবহিত লোকজন ছিল, তবে আমার বিশ্বাস অধিকাংশ মানুষ সে ব্যাপারে জ্ঞাত ছিল না। তারা হাসিনার স্বৈরশাসন, বিশেষ করে যখন সাধারণ ছাত্রদের উপর গুলি করা হয়, তখন নাগরিক দায়বোধ থেকে এর প্রতিবাদ করে এবং হাসিনা সরকারের পতন চায়। এদের বেশির ভাগ একটি গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে কথা বলে যারা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে, সুস্থ রাজনীতি ফিরিয়ে আনবে ও মৌলবাদ তোষণের রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু এদের অধিকাংশই জানত না যে দেশে যখন রাজনীতি অনুপস্থিত তখন সরকার পতনে যে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হবে সেটা পূরণ করার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে জামায়াত সহ বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক শক্তি। এই সুযোগ জামায়াত শিবির পুরোপুরি গ্রহণ করেছে এবং সরকার ও প্রশাসনে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল না হলেও জনগণ সেটা বুঝতে পেরেছে আর তাই বর্তমান মব রাজনীতির বিরুদ্ধে যতটুকু প্রতিরোধ গড়ে উঠছে সেটা এই সাধারণ মানুষের হাত ধরেই। তাই রাজনৈতিক নেতারা ইনিয়ে বিনিয়ে নতুন বন্দোবস্তের পক্ষে সাফাই গাইলেও সাধারণ মানুষ, তা সে রিক্সাওয়ালা হোক আর খেটে খাওয়া মানুষ হোক, এর বিরুদ্ধে মুখ খুলছে, এমনকি অত্যাচারের সম্মুখীন হচ্ছে। নব্বইয়ের দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়েছিল। বর্তমানে একাত্তরের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলছে তাকে রুখে দেবার জন্য মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও ডঃ কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে মুক্তি মঞ্চ।

পড়ুন:  বিজন ভাবনা (৬): শান্তি নিয়ে অশান্তি -বিজন সাহা

 

বাংলাদেশে বর্তমানে যা চলছে সেটাকে এক কথায় মানবতা বিরোধী বর্বর কর্মকাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। গত বছর আমরা শেখ হাসিনার পুলিশ ও লেঠেল বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। এক বছর পার হয়ে গেছে, অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। স্বৈরাচারী এক শাসক বিদায় নিয়েছে কিন্তু স্বৈরাচার বিদায় নেয়নি। আপদের জায়গায় এসেছে বিপদ। আজ মানুষের জান মাল আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সংকটাপন্ন। যে আশা নিয়ে জাতি সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্ববরেণ্য মানুষটির হাতে দেশের ভার তুলে দিয়েছিল তাঁর হাতে দেশ আজ পণ্য। দেশ আজ বিপন্ন। বিপন্ন দেশের বন্দর, দেশের করিডোর, বিপন্ন একাত্তর, বিপন্ন দেশের স্বাধীনতা। দেশের এই ক্রান্তি লগ্নে প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষকে আবারও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে তা সে দেশেই থাকুক আর দেশের বাইরেই থাকুক। একাত্তরের মতই বাংলাদেশে ঘটমান প্রতিটি  মানবতা বিরোধী ও স্বাভাবিক নৈতিকতা বর্জিত ঘটনা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে হবে, গড়ে তুলতে হবে বিশ্ব জনমত, এসব অন্যায় অপরাধ দৃষ্টিগোচর করতে হবে বিভিন্ন দেশের সরকারের ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার। দেশের অস্তিত্ব যখন বিপদের সম্মুখীন তখন কোন দলাদলি বা সাম্প্রদায়িকতার অবকাশ নেই। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেষ্ট হতে হবে। সেটাই হবে দেশের প্রতি আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ। শুধু সত্যটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা, দেশ ও দেশের মানুষকে মৌলবাদ ও স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের ছোট ছোট প্রয়াস এক নতুন বাংলাদেশের জন্ম দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এটাই হোক এবারের ১৫ আগস্টের অঙ্গীকার। শেখ মুজিবের রাজনীতির সাথে আমরা একমত নাও হতে পারি, কিন্তু এই মানুষটি বছরে পর বছর জেল খেটে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছেন। এবং এ দেশের জন্য নিজের বুকের রক্ত পর্যন্ত দিয়েছেন। সেই রক্তের ঋণ শোধ করার সময় এখনই।  গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো