আলাস্কাতে ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক নিয়ে যত জল্পনা-কল্পনা —— রবীন গুহ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন শুক্রবার আলাস্কায় একটি শীর্ষ সম্মেলনের জন্য মিলিত হচ্ছেন – অন্তত মার্কিন পক্ষ থেকে – যার লক্ষ্য ২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আক্রমণের পর শুরু হওয়া ভয়াবহ যুদ্ধের অবসান ঘটানো। ইউক্রেনকে ঘিরে যেকোনো শান্তি চুক্তিতে ভূখণ্ডের বিষয়ে চুক্তি থাকতে হবে, যেখানে রাশিয়া বর্তমানে ইউক্রেনের প্রায় এক পঞ্চমাংশ ভূমি দখল করে আছে। সারা বিশ্বের তাবৎ আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকদের নজর এখন আলাস্কাতে ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের উপর। সব নামীদামী পত্রিকার সম্পাদকীয় আর নিউজ ফিড জুড়েই চলছে এনিয়ে নানা চুলচেরা বিশ্লেষণ। আলাস্কা পৌঁছাতে ট্রাম্পের আট ঘণ্টা আর পুতিনের লাগবে দশ ঘণ্টা সময়। দুই পরাক্রমশালী রাস্ট্রের দুই নেতার এই বৈঠক সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার কথা বলা হলেও যুদ্ধকালীন সময়ে পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়ার বৈরি সম্পর্কের ইতি টানার মধ্য দিয়ে অর্থনীতি, বাণিজ্য, জ্বালানি, প্রতিরক্ষাসহ নানা বিষয়ে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে। সর্বোপরি আমেরিকা-রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেরও বড় রকমের পরিবর্তন ঘটতে পারে এমন সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দেয়া যায়না। ট্রাম্প একসময় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সাত দিনের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আর পুতিনও শুরুতেই মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও পশ্চিমা মদদপুষ্ট ইউক্রেন রাশিয়ার ভয়াবহ হামলার মুখে বিশ শতাংশের বেশি ভূমি হারানোর পরও হার মানতে নারাজ। যদিও এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল, তবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশসমূহ এবং অন্যান্যরা ইতিবাচক কিছুরই আশা করছেন।
একসময় একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের রুশ নেতার সাথে দেখা করা স্বাভাবিক ছিল। জর্জ ডব্লিউ বুশ পুতিনের সাথে প্রায় দুই ডজন বার দেখা করেছিলেন। জো বাইডেন তার সাথে মাত্র একবার দেখা করেছিলেন, ২০২১ সালে। কিন্তু ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার পর ট্রাম্পের এই বৈঠকই হবে কোনও আমেরিকান প্রেসিডেন্টের প্রথম। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প, পুতিনের একগুঁয়েমি এবং বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করার ইচ্ছার সমালোচনা করেছেন, রাশিয়ান এবং তাদের সাথে ব্যবসা করা অন্যান্য দেশের উপর নতুন নিষেধাজ্ঞার জন্য একাধিক সময়সীমা নির্ধারণ করেছেন। গত শুক্রবার ছিল সবচেয়ে সাম্প্রতিক সময়সীমা এবং এর আগের সকলের মতো ট্রাম্প অবশেষে পিছু হটেছেন। ট্রাম্প এখন রাশিয়ার সাথে যে কোনো মূল্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে চান।
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্যে পুতিনের সাথে যুদ্ধ বিরতি চুক্তির ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির কৃতিত্ব নিয়েছেন, যদিও ভারতীয়দের কাছে সেই গল্পের ভিন্ন রূপ রয়েছে। হোয়াইট হাউসে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তি প্রতিশ্রুতিতে তিনি সরাসরি ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সংঘাতও ছিল যেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে, বড় সংঘাতগুলি তাকে এড়িয়ে গেছে।
অবশ্যই, এগুলো হল ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ এবং ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ, যা তিনি বীরদর্পে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি পুতিনের সাথে তার দীর্ঘ এবং তার দৃষ্টিতে, শ্রদ্ধাশীল সম্পর্কের ভিত্তিতে, ২৪ ঘন্টার মধ্যে সমাধান করবেন। মস্কো যদি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি না হয় তবে “খুব গুরুতর পরিণতির” হুমকির মুখে তিনি এটি অর্জন করতে চান। যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার সম্ভাবনাও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনুমোদন করেছে। একই সাথে, সম্ভাব্য পরিকল্পনায় “কোনও লঙ্ঘন” রেকর্ড করা হলে নিষেধাজ্ঞা পুনরায় আরোপেরও কথা রয়েছে।
ট্রাম্প আমেরিকান মাটিতে রাশিয়ান রাষ্ট্রপতিকে আতিথ্য দিচ্ছেন এবং “ভূমি-অদলবদল” সম্পর্কে কথা বলছেন, যা ইউক্রেনের আশঙ্কা, শান্তির বিনিময়ে জমি ছাড়ের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। গত শুক্রবার, ট্রাম্প পরামর্শ দিয়েছিলেন যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে “কিছু ভূখণ্ডের বিনিময়” অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে, তবে তিনি কোন অঞ্চলের কথা উল্লেখ করছেন তা এখনও স্পষ্ট নয় এবং ইউক্রেন তার ভূখণ্ডের কিছু অংশ ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এই শীর্ষ সম্মেলন থেকে পুতিন প্রথম যে জিনিসটি চান তা হল এমন কিছু যা তাকে ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে এবং তা হল স্বীকৃতি। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ আমেরিকার স্বীকৃতি যে ক্রেমলিন নেতাকে বিচ্ছিন্ন করার পশ্চিমা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে জারশাসিত রাশিয়া আলাস্কাকে আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল, এই সত্যটি মস্কো একবিংশ শতাব্দীতে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সীমান্ত পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করছে। “আলাস্কা একটি স্পষ্ট উদাহরণ যে রাজ্যের সীমানা পরিবর্তন হতে পারে এবং বৃহৎ অঞ্চলগুলি মালিকানা পরিবর্তন করতে পারে” – লিখেছেন রাশিয়ান একটি জনপ্রিয় পত্রিকা মস্কোভস্কি কমসোমোলেটস। কিন্তু পুতিন কেবল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং প্রতীকের চেয়েও বেশি কিছু চান। তিনি বিজয় চান। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে রাশিয়া চারটি ইউক্রেনীয় অঞ্চলে (ডোনেটস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া এবং খেরসন) দখলকৃত এবং দখলকৃত সমস্ত জমি রাখুক এবং কিয়েভ সেই অঞ্চলগুলির অংশগুলি থেকে সরে যাক যেখানে এখনও ইউক্রেনীয় নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ইউক্রেনের জন্য এটা অগ্রহণযোগ্য। “ইউক্রেনীয়রা তাদের জমি দখলদারকে দেবে না,” দেশটির রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন।
ক্রেমলিন এটা জানে। কিন্তু যদি তারা তাদের আঞ্চলিক দাবির জন্য ট্রাম্পের সমর্থন নিশ্চিত করে, তাহলে হিসাব করা যেতে পারে যে ইউক্রেন কর্তৃক প্রত্যাখ্যানের ফলে ট্রাম্প কিয়েভের প্রতি সমস্ত সমর্থন বন্ধ করে দেবেন। ইতিমধ্যে, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিকাশের সাথে এগিয়ে যাবে।
কিন্তু এখানে আরেকটি দৃশ্যপটও আছে। রাশিয়ার অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। বাজেট ঘাটতি বাড়ছে, তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে আয় কমছে। যদি অর্থনৈতিক সমস্যা পুতিনকে যুদ্ধ শেষ করতে বাধ্য করে, তাহলে ক্রেমলিন আপস করতে পারে।এরকম আরো অনেক জল্পনা কল্পনা করা যায়, তবে আজকের ১৫ আগস্টের আলাস্কা বৈঠকের সিদ্ধান্ত কি হবে তা স্পষ্ট করে জানা যাবে বৈঠকের সমাপ্তির পর। এই সিদ্ধান্ত থেকে ভবিষ্যৎ রুশ-মার্কিন সম্পর্ক কেমন হবে, ন্যাটোভুক্ত ইউরোপের দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত দিক তথা বিশ্ব রাজনীতিতে কি পরিবর্তন আসতে পারে অনেকটাই আঁচ করা যাবে।
(লেখকঃ প্রগতির যাত্রী ডট কম এর সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য)