মতামত

সংবিধান নিয়ে ‘ঐক্যমত’ নয়, চাই সম্মান ও সংবেদনশীলতা

-ফজলুল কবির

বাংলাদেশের সংবিধান একটি কাগজে মুদ্রিত কিছু ধারা-উপধারার সংকলন নয়। এটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়ের—মুক্তিযুদ্ধের—এক অনন্য দলিল। এই সংবিধানের প্রতিটি অনুচ্ছেদে, প্রতিটি শব্দে মিশে আছে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত, ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম, এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের ত্যাগ ও স্বপ্ন। এটি শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো নয়; এটি একটি জাতির চেতনা, আদর্শ ও আত্মপরিচয়ের নিদর্শন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত এই সংবিধান জাতীয় চার মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—কে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে এক নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিয়েছিল। সময়ের প্রয়োজনে সংবিধানে বহু সংশোধনী এসেছে, যার অনেকগুলো যুক্তিসঙ্গত হলেও, কিছু কিছু পরিবর্তন এই মূল চেতনার বিপরীতে অবস্থান করেছে। এসব বিষয় নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা, সমালোচনা কিংবা সংশোধনের প্রস্তাব আসতেই পারে। তবে তা হওয়া উচিত ইতিহাস, আত্মত্যাগ ও বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সম্প্রতি কিছু মহল থেকে এমন বক্তব্য উঠে আসছে যে, গোটা সংবিধানই বাতিল করে দেওয়া উচিত কিংবা এটিকে ‘ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা’ প্রয়োজন। এ ধরনের বক্তব্য কেবল অশালীনই নয়, এটি মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস এবং শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি গভীর অবমাননা। সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ, ধারা বা মতবাদের সঙ্গে দ্বিমত থাকতেই পারে, কিন্তু সেই কারণে গোটা সংবিধানকে অস্বীকার করা মানে দেশের জন্মসূত্রকেই অস্বীকার করা।

গতকাল সংবিধান প্রশ্নে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় সিপিবি ও বাসদ সংবিধানের জাতীয় চার মূলনীতিকে অক্ষুণ্ণ রাখার দাবি জানিয়েছিল। তারা যুক্তি দিয়েছে—এই চারটি মূলনীতি কেবল রাষ্ট্র পরিচালনার দিকনির্দেশনা নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক ভিত্তি। অথচ, কথিত ‘ঐকমত্য কমিশন’ এই গুরুত্বপূর্ণ দাবিকে আমলে নেয়নি। ফলে সিপিবি ও বাসদের পক্ষ থেকে বৈঠক বর্জন ছিল একটি যুক্তিসঙ্গত এবং আত্মমর্যাদাপূর্ণ সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি, তারা যথার্থ অবস্থান নিয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় অনেক বিষয়ে মতানৈক্য থাকতে পারে, মতভেদও থাকবেই। কিন্তু কিছু বিষয় আছে, যেগুলোর ওপর জাতিগত ঐকমত্য থাকা অপরিহার্য। জাতীয় চার মূলনীতি সেই রকমই এক ভিত্তি, যাকে ঘিরে ১৯৭১ সালে জাতি এক হয়েছিল। তাই এই মূলনীতিগুলোতে হাত দেওয়া মানে ঐতিহাসিক ঐকমত্যকে ভাঙা, জাতির আত্মপরিচয়কে ক্ষুণ্ণ করা।

আমরা সংবিধান নিয়ে আলোচনা করব, বিতর্ক করব, প্রয়োজনে সংশোধন করব। কিন্তু সেই বিতর্ক হতে হবে সংবেদনশীলতা ও সম্মানের মাধ্যমে। সংবিধান শুধুই আইন নয়—এটি একটি জাতির আত্মা। সেই আত্মাকে অবমাননা করে কোনো ‘ঐকমত্য’ গঠন সম্ভব নয়। বরং সংবিধানের মূল চেতনা ও মূল্যবোধকে ভিত্তি করেই ভবিষ্যতের পথরেখা নির্মাণ করা উচিত।

আমরা ভুলে গেলে চলবে না—সংবিধান কেবল একটি বই নয়, এটি আমাদের জাতিসত্তার এক অমোঘ প্রামাণ্য দলিল।

(লেখকঃ সংগঠক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র)