উত্তরায় যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনা: জরুরি স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন – আহতদের স্থানান্তরে সময়ক্ষেপণ, আইসোলেশন না মেনেই ‘সেলফি’, রাজনৈতিক কুচকাওয়াজ—হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল কাঠামোগত দুর্বলতা

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল প্রাঙ্গণে সামরিক যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্তের পর আশপাশের হাসপাতালগুলোতেই প্রথম ধাক্কা সামলাতে হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর পরিস্থিতি বিবেচনায় আহতদের বিভিন্ন বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হলেও পুরো প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণ হয়েছে কি না—এ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা (ইমার্জেন্সি হেলথ রেসপন্স) ব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়ে। শুধু তাই নয়, পোড়া রোগীর সংক্রমণ ঝুঁকি উপেক্ষা করে হাসপাতালের শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সেলফি তোলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় রোগী-স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা ও পেশাগত প্রটোকল ভঙ্গের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
দুর্ঘটনার পরপরই স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের পাশাপাশি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়। ট্রায়াজ—অর্থাৎ কাকে আগে চিকিৎসা দেওয়া হবে, কাকে কোথায় রেফার করা হবে—সে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব ও সমন্বয় ঘাটতির অভিযোগ তুলছেন স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড, ট্রমা কেয়ার নেটওয়ার্ক, বার্ন ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার বেডের রিয়েল-টাইম ইনভেন্টরি এবং অ্যাম্বুলেন্স-টু-হাসপাতাল ডাইরেক্ট লাইন না থাকলে ভবিষ্যতেও একই চিত্র দেখা যাবে।
একই সঙ্গে, জরুরি পরিস্থিতিতে হাসপাতালের ভেতরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দলবল নিয়ে প্রবেশ, ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন নিয়ে ‘দর্শনার্থীদের’ ভিড়—সব মিলিয়ে চিকিৎসক ও নার্সদের কাজে বাধা এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ প্রটোকল (আইপিসি) প্রশ্নের মুখে পড়েছে। চিকিৎসা নীতিমালা অনুযায়ী, এমন পরিস্থিতিতে আক্রান্ত রোগীদের চারপাশে কনট্রোলড অ্যাকসেস, সীমিত জনসমাগম এবং যথাযথ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) ব্যবহারের কথা থাকলেও বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
সমালোচনার কেন্দ্রগুলো
-
সমন্বয়হীন ট্রায়াজ ও রেফারাল: কোন রোগীকে কোন হাসপাতালে পাঠানো হবে, সে সিদ্ধান্তে একীভূত নির্দেশনার অনুপস্থিতি।
-
টাইম-ক্রিটিক্যাল কেয়ারের বিলম্ব: বার্ন, ট্রমা ও শক ম্যানেজমেন্টে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ হারানোর ঝুঁকি।
-
হাসপাতালে নিয়ন্ত্রণহীন ভিড়: সংক্রমণ, চিকিৎসায় ব্যাঘাত ও রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন।
-
ডেটা ও কমান্ড সেন্টারের অভাব: রিয়েল-টাইম বেড অবস্থা, রক্ত ও ওষুধের প্রাপ্যতা, অপারেশন থিয়েটারের প্রস্তুতি—সবই ‘ম্যানুয়াল’ ও বিলম্বিত।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি মহানগরে একটি “সেন্ট্রালাইজড এমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (EOC)”, ট্রমা-বার্ন-ক্রিটিক্যাল কেয়ার রেফারেল ম্যাট্রিক্স, এবং প্রতিটি বড় হাসপাতালের জন্য বাধ্যতামূলক ‘ডিজাস্টার কোড’ (কোড রেড/কোড ট্রায়াজ ইত্যাদি) প্রটোকল থাকা জরুরি। এছাড়া অ্যাম্বুলেন্স সেবার জন্য একক শর্ট কোড,统一 (ইউনিফায়েড) ডিসপ্যাচ সিস্টেম, জিপিএস-সমর্থিত বেড-ইনফো ড্যাশবোর্ড চালু না হলে মাঠপর্যায়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
হাসপাতালের ভেতরে সেলফি–রাজনীতি: নৈতিকতা ও নিরাপত্তা প্রশ্নে
বার্ন ও ট্রমা রোগীদের শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এটি শুধু রোগীর ব্যক্তিগত মর্যादा খর্ব করে না, চিকিৎসা-নির্দেশনা ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও হুমকিতে ফেলে—বলছেন চিকিৎসকরা। তাদের দাবি, হাসপাতালকে ‘নো-ফটো/ভিডিও জোন’ ঘোষণা, ভিজিটর ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার, ও নিরাপত্তা দায়িত্বে প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ এখন সময়ের দাবি।
নীতিগত সংস্কারের প্রস্তাব (সারসংক্ষেপ)
-
জাতীয় ইমার্জেন্সি মেডিকেল সার্ভিস (EMS) আইন ও নীতিমালা: কেন্দ্রীয় কমান্ড, স্ট্যান্ডার্ড ট্রায়াজ, এবং বাধ্যতামূলক রিপোর্টিং সিস্টেম।
-
ট্রমা ও বার্ন কেয়ার নেটওয়ার্কিং: রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরে নির্দিষ্ট ট্রমা সেন্টার, রিয়েল-টাইম বেড ও ওটি (OT) স্ট্যাটাস প্ল্যাটফর্ম।
-
একীভূত অ্যাম্বুলেন্স ডিসপ্যাচ: এক শর্ট কোডে কল—কাছের প্রস্তুত হাসপাতাল ও বিশেষায়িত বেডে স্বয়ংক্রিয় রাউটিং।
-
হাসপাতাল ‘ডিজাস্টার কোড’ বাধ্যতামূলক: বছরে অন্তত দুবার মক ড্রিল; জরুরি ওয়ার্ডে ‘র্যাপিড রেসপন্স টিম’।
-
ভিজিটর ও মিডিয়া প্রটোকল: জরুরি সময়ে রাজনৈতিক/প্রটোকল ভিজিট নিষিদ্ধ বা সীমিত; মিডিয়ার জন্য আলাদা ব্রিফিং জোন।
-
ডেটা ট্রান্সপারেন্সি ও অডিট: প্রতিটি বড় দুর্ঘটনার পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ‘মর্টালিটি-মরবিডিটি রিভিউ’ প্রকাশ।
-
স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা: আইপিসি নিশ্চিত করা, নিরাপত্তার জন্য হাসপাতালের নিজস্ব ট্রেইনড সিকিউরিটি, এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্রুত সাপোর্ট।
দুর্ঘটনার মতো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব না হলেও, সুনির্দিষ্ট প্রটোকল, সমন্বিত কমান্ড, প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত—এই চারটি স্তম্ভ শক্ত না হলে প্রতিটি বড় দুর্ঘটনার পরই একই প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে সামনে আসবে, এবং ‘গোল্ডেন আওয়ার’ হারিয়ে যাবে অবকাঠামো ও শৃঙ্খলার ঘাটতিতে।
নাগরিকদের দাবি, এই ঘটনার পর দ্রুত একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি, পরিষ্কার টাইমলাইন ও দায়বদ্ধতার রোডম্যাপ, এবং স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে—যাতে পরেরবার হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে আর সময়ের সঙ্গে প্রাণের লড়াই করতে না হয়।
