মতামত

জাহাজভাঙা শিল্পের রূপান্তর কি শ্রমিকের জন্য ন্যায্য?

-ফজলুল কবির মিন্টু

বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্প একদিকে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, অন্যদিকে এই খাতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য রয়ে গেছে অবর্ণনীয় বঞ্চনা, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অধিকারহীনতার করুণ চিত্র। বিগত কয়েক বছরে ১৩টি  গ্রিন ইয়ার্ড গঠনের মাধ্যমে এ শিল্পে অবকাঠামোগত ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার সংক্রান্ত কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।

জাহাজভাঙা শিল্পে এখনও অধিকাংশ শ্রমিক নিয়োগপত্র পায় না। যদিও কিছু ইয়ার্ড দাবি করে তারা নিয়োগপত্র দেয়, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় শ্রমিকের স্বাক্ষর নিয়ে সেই নিয়োগপত্র শ্রমিকের ব্যক্তিগত ফাইলে সংরক্ষিত থাকে, শ্রমিকের হাতে কোনো কপিই দেয়া হয় না। পরিচয়পত্র দেয়া হলেও তাতে চাকুরীতে যোগদানের তারিখ থাকে না, ফলে চাকরিচ্যুতি বা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর ভুক্তভোগী শ্রমিকের ক্ষতিপূরন নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

শ্রমিকরা কোনো ধরণের সবেতন ছুটি পায় না—না সাপ্তাহিক, না উৎসব, না নৈমিত্তিক, না পীড়া, না অর্জিত ছুটি। শুক্রবার বা সরকারি ছুটির দিন কাজ না করলে তারা মজুরি থেকেও বঞ্চিত হয়। অর্থাৎ, শ্রমিকেরা কেবল কাজের ভিত্তিতে মজুরি পায়—কাজ না করলে মজুরি নেই।

২০১৭ সালে  গ্যাজেটের মাধ্যমে এই শিল্পের জন্য শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ১৬ হাজার টাকা নির্ধারিত হলেও, আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। উৎসব বোনাসও দেয়া হয় না। কিছু ইয়ার্ড ঈদুল ফিতরের সময় সামান্য কিছু টাকা বোনাস হিসাবে দিলেও তা খুবই অপ্রতুল।

এত বঞ্চনার পরেও জাহাজভাঙা শ্রমিকদের প্রতিনিয়ত পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে দিয়ে কাজ করতে হয়। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রজত শংকর রায় বিশ্বাস কর্তৃক ২৫ জন জাহাজভাঙা শ্রমিকের ওপর পরিচালিত এক পর্বেক্ষনে দেখা যায়, প্রায় সকলেই কোনো না কোনো শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তাদের গড় বয়স ৪৯.২৮ বছর এবং গড়ে প্রায় ২৬ বছর ধরে এই শিল্পে কাজ করেছেন।

পর্যবেক্ষনে দেখা যায়, ২৫ জন শ্রমিকের মধ্যে ২১ জন কফজনিত রোগে, ২০ জন বুকে ব্যথা, ৮ জন শ্বাসকষ্টে, ২৪ জন শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছেন। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, ৭ জন হাইপারটেনশনে, ২ জন হৃদরোগে, ১০ জন পেপ্টিক আলসারে আক্রান্ত। একজনের রয়েছে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিস (COPD)।

২০২৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এস এন কর্পোরেশন শিপ ইয়ার্ডে আহত শ্রমিকদের উপর পরিচালিত আরেকটি গবেষণায় দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের রক্তে পাওয়া গেছে ১৪ ধরণের ভারী ধাতু—যার মধ্যে আর্সেনিক, লীড, নিকেল, কপার ও মার্কারি উল্লেখযোগ্য। এই ধাতুগুলো মানবদেহে দীর্ঘস্থায়ী জটিল ও অনিরাময়যোগ্য রোগ সৃষ্টি করতে পারে বিশেষজ্ঞ্রা জানিয়েছেন।

সবচেয়ে করুণ বাস্তবতা হলো, এইসব পেশাগত রোগের স্বীকৃতি শ্রমিকেরা পায় না। ফলে চিকিৎসা ব্যয় বা সবেতন ছুটির সুবিধাও তারা পায় না। দুর্ঘটনাপ্রবণ এই শিল্পে কাজ করা শ্রমিকেরা জীবন বাজি রেখে কাজ করলেও তাদের অধিকারের কোনো নিশ্চয়তা নেই। গ্রিন ইয়ার্ড গঠনের ফলে কিংবা ব্যবসার পরিমান কমে যাওয়ার কারনে ২০২২ সাল থেকে দুর্ঘটনার হার কিছুটা কমেছে ঠিকই, কিন্তু ২০২২ এর আগেও প্রতিবছর গড়ে ১৫-১৬ জন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করতেন এবং বহু শ্রমিক আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে যেতেন।

যেসব ঘটনা বড় ধরনের এবং গণমাধ্যমে আসে, সেসব ক্ষেত্রে নিহত শ্রমিকের পরিবার কিছুটা ক্ষতিপূরণ পেলেও (৪ থেকে ৭ লাখ টাকা), যেসব ঘটনা প্রচারের বাইরে থাকে সেসব ক্ষেত্রে পরিবারকে ক্ষতিপূরণ পেতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়। আহত শ্রমিকেরা প্রথম দিকে চিকিৎসা পেলেও পরে ফলোআপ চিকিৎসার ক্ষেত্রে সহায়তা পায় না। অনেক ক্ষেত্রে শ্রম আইন এবং জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বিধিমালা ২০১১ অনুসারে যথাযথ ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় না।

২০২৩ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ সরকার “হংকং কনভেনশন” অনুস্বাক্ষর করে, যার ফলে ২০২৫ সালের ২৬ জুন থেকে এই কনভেনশনের নিয়ম অনুসারে বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে শিল্পে একধরনের রূপান্তর শুরু হয়েছে—ইয়ার্ডগুলোর অবকাঠামো উন্নত হচ্ছে, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু শ্রমিকের অধিকার, নিরাপত্তা, মজুরি এবং চিকিৎসা সুবিধায় দৃশ্যমান উন্নয়ন নেই বললেই চলে।

এই বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে: জাহাজভাঙা শিল্পে যে রূপান্তর ঘটছে, তা কি কেবলই কাঠামোগত প্রযুক্তিগত, না কি এটি শ্রমিকদের অধিকার মর্যাদাকেও প্রতিফলিত করছে? যদি শ্রমিকেরা বছরের পর বছর তাদের শ্রম বিকিয়ে দিয়ে পায় কেবল বঞ্চনা, ঝুঁকি এবং স্বীকৃতিহীনতা, তাহলে এ রূপান্তরকে “ন্যায্য” বলা কি সম্ভব?

শিল্পের টেকসই উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন তা শ্রমিকবান্ধব হবে—তাদের অধিকার, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং মর্যাদাকে পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়ে। নতুবা এই রূপান্তর শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে, বাস্তবে নয়।

(লেখকঃ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ – বিলস কর্তৃক পরিচালিত জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক)