বিজন ভাবনা

বিজন ভাবনা (২): কন্ট্রাস্ট 

– বিজন সাহা

আমার ছোটবেলায় বাড়িতেই যাত্রার দল ছিল। বড়দা ভানু (বিধু ভূষণ) সাহার দলের নাম ছিল অম্বিকা নাট্য প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়াও গ্রামে কার্ত্তিক সাহার যাত্রার দল ছিল অন্নপূর্ণা নাট্য সংস্থা। সেদিক থেকে যাত্রা নাটক এসবের মধ্যেই কেটেছে আমার শৈশব, কৈশর। জাতীয় জীবনেও তখন নাটকীয়তা ছিল, তবে সেসব ছিল কালেভদ্রে,  আজকের মত এত ঘন ঘন ছিল না। উনসত্তর, একাত্তর, পঁচাত্তর…। এভাবেই পট পরিবর্তন ঘটত। তবে বর্তমানের ডিজিটাল যুগে মানুষ মোবাইল ফোনের মডেলের মতই নিত্যনতুন নাটক চায়, চায় উত্তেজনা। ফলে সব সরকারই চেষ্টা করে মানুষকে নতুন নতুন ইস্যু উপহার দিতে। কিছু কিছু ইস্যু সুখকর, কিছু কিছু দুঃখজনক। তবে জীবন তো কমেডি, ট্র্যাজেডি, ফার্স এসবেরই সমাহার। সবই যদি কমেডি হয় দর্শক বোর হবে, সরকারের যাত্রার দল তাহলে লাটে উঠবে। তাই সব সরকারই কিছুদিন পরপর নতুন নতুন করে ইস্যু তৈরি করে, উদ্দশ্য একটাই পুরানো ইস্যু ভুলিয়ে দেয়া। সেটা আমরা বিগত সরকারের সময়েও দেখেছি, এখনও দেখছি। হয়তো আগেও দেখতাম যদি সেসময় সামাজিক মাধ্যম শক্তিশালী থাকত। সেই বিচারে ইস্যু তৈরি যতটা না সরকারের কৃতিত্ব তারচেয়ে বেশি সময়ের দাবি।

গত সরকারের আমলে দেখছি আজ বিশ্বজিত হত্যা তো কাল ক্রস ফায়ার, এখানে শিক্ষক লাঞ্ছনা তো ওখানে অর্থ পাচার কেলেঙ্কারি। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে সরকার নিজের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে পর্যন্ত এই ফাঁদে ফেলে মন্ত্রী সভা থেকে বহিষ্কার করে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ নাটকের দেশ। প্রতিটি সরকার নতুন নতুন স্ক্রিপ্ট লেখে। কোনটা সাদামাটা, কোনটা মেটাকিউলাসলি প্ল্যান্ড। তবে বিগত সরকারের বিরদ্ধে অন্ধ ঘৃণা অনেককেই এতটাই বুঁদ করে রেখেছে যে তারা আসন্ন বিপদ দেখতে পাচ্ছে না। আমাদের রাজনীতিবিদদের সবার গায়ে মনে হয় গন্ডারের চামড়া। তবে পদপদবি ভেদে চামড়ার পুরুত্ব ভিন্ন। তাই একেক জনের একেক সময়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বোধোদয় ঘটে আর সেই অনুভূতির উপর ভিত্তি করে রচিত হয় তাদের রাজনৈতিক বয়ান। আর দিনের শেষে যা হয় তাকে বলে জগাখিচুড়ী।

চট্টগ্রামে বন্দর আর করিডোর নিয়ে বিরোধী দলের পদ যাত্রা শেষ হতে না হতেই বাম দলগুলোর হাত থেকে রিলে চলে গেছে এনসিপির হাতে সুদূর গোপালগঞ্জে। সাড়া দেশের জেলায় জেলায় তারা সাফল্যের সাথে প্রচারণা চালিয়ে প্রশংসা কুড়ালেও এখানে তারা যুদ্ধংদেহী রূপ নিয়ে প্রবেশ করে। সেটা শেখ মুজিবের আভা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল নাকি মুজিব বিরোধিতা করে – সেটা শুধু মনস্তত্ত্ববিদরাই বলতে পারবে। ফলাফল? চব্বিশের বিপ্লবীদের আর্মির গাড়িতে করে পলায়ান, পরবর্তীতে পরিস্থিতিতে আর্মির হস্তক্ষেপ, সেই আর্মির যারা এক বছর আগে জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে বোঝা যাচ্ছে সব জনগণই সমান নয়, কেউ বেশি আবার কেউ কম। ফলে গোপালগঞ্জে নেমে এসেছে আর্মির বুট, লয়েডের মত প্রাণ হারিয়েছে গোপালগঞ্জের এক সন্তান। তবে এখানে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ছিল না বিএলএম টাইপের কিছু একটা গড়ে তোলার জন্য। ফলে পরবর্তীতে আরও অনেকেই খুন গুম হয়েছে, কিল ঘুষি খেয়ে সরকারের আতিথেয়তায় দিন কাটাচ্ছে আরও অনেক গোপালগঞ্জবাসী। এ নিয়ে ঘরে বাইরে যখন ক্রোধ দানা বেঁধে উঠছে ঠিক তখনই শুরু হয় নতুন অধ্যায়। এবার স্কুলে। বিমান বাহিনীর এক যুদ্ধ বিমান প্রশিক্ষণের সময় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপর বিধ্বস্ত হলে আগুনে ঝলসে মারা যায় প্রচুর ছাত্রছাত্রী। এখনও পর্যন্ত সঠিক সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ আছে, সন্দেহ আছে যে প্রশাসন ইচ্ছাকৃত ভাবে সঠিক সংখ্যা লুকিয়ে রাখছে, তবে সংখ্যা যাই হোক রাজধানীর মত একটি জনবহুল এলাকায় সেনাবাহিনীর বিমান প্রশিক্ষণ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এমনকি কেউ কেউ সন্দেহ করছে যে এটা গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর কবর ধ্বংসের মহড়া মাত্র। জানা যায় যে মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের ছেলেমেয়েরা চব্বিশের জুলাই আগস্টে হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এখানে এত বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পরেও প্রশাসন, বিশেষত ছাত্র সমন্বয়ক ও এনসিপির ভূমিকা ছাত্র জনতাকে ক্ষুব্ধ করে। এমনকি একদল ছাত্র কয়েকজন সমন্বয়ককে বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘেরাও করে রাখে। ঘোষিত হয় রাষ্ট্রীয় শোক দিবস। কিন্তু রাষ্ট্রীয় শোক দিবসে রাষ্ট্রের স্টেকহোল্ডাররা কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক প্রকাশের সৌজন্যটুকু রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। এটা আবারো প্রমাণ করল যে এই রাষ্ট্র বর্তমান শাসকদের জন্য শুধুই বধ্যভূমি যেখানে ন্যুনতম দ্বিধা না করে জনগণ শিকার করা যায়।

কিন্তু কেন? লাভটাই যদি জীবনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয় তবে সে জীবনে আর যাই থাকুক অন্যের জন্য দরদ বা ভালোবাসা থাকে না। ভালবাসা থাকে না দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। আজকাল রাজনীতিতে টাকার খেলা চলে, চলছে। অনেকেই রাজনীতি করে অর্থ উপার্জন করে, তবে এরাও রাজনীতিটাই প্রথমে রাখে। রাজনীতি  তাদের নেশা, ব্যাবসা বাইপ্রোডাক্ট। রাজনীতি এদের জীবনে প্রথম প্রেম। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা রাজনীতি ব্যবহার করছেন ব্যবসায়িক টুল হিসেবে, উপার্জনের একটি উপায় হিসেবে। শিক্ষক হিসেবে শুরু করলেও পরবর্তীতে ওনার সব কাজ প্রমাণ করে যে উনি জন্মগত ভাবে ব্যাংকার যার মূল উদ্দেশ্য লাভ করা। তাই ক্ষমতায় এসে প্রথমেই নিজেকে করমুক্ত বা সত্যিকার অর্থে দায়মুক্ত করেছেন। কাছে তার দায়? দেশের ও দেশের মানুষের কাছে। কিন্তু তিনি ও তার সরকার আক্ষরিক অর্থেই আজ দায়মুক্ত। গত এক বছরে এই সরকার জনগণের জন্য কিছু করেছে বলে মনে হয় না। যাকিছু অর্জন তা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। এই সরকার বন্যা ত্রাণ তহবিলের অর্থ উপযুক্ত খাতে ব্যয় করেনি বলে অভিযোগ আছে। এখন সরকার প্রধান দেশবাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন বিমান ধ্বংসের ফলে অগ্নিদগ্ধ মানুষের জন্য আর্থিক সাহায্যের। সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যেই রক্ত দিয়ে সাধ্যমত নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছে। বছরব্যাপী অরাজকতা ও মব সংস্কৃতির কারণে মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। মানুষ বিগত এক বছর যাবৎ আবেদন করে যাচ্ছে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে, বিদেশিদের হাতে দেশের বন্দর, করিডোর ইত্যাদি তুলে না দিতে। তিনি শোনেননি। কারণ জনতার দাবিতে লাভের গুড় নেই, তা আছে ত্রাণ তহবিলে জমা পড়া টাকায়। সমস্যা হল তার, তাদের লাভ আর মানুষের লাভ এক নয়, এরা পরস্পরবিরোধী। এরপরও হয়তো কিছু মানুষ শান্তির বাণীতে ভুলবে।

পড়ুন:  বিজন ভাবনা (৩): মত ও পথ -বিজন সাহা  

 

দেশ বর্তমানে একাত্তর বিরোধী শক্তির হাতে চলে গেছে। এটা অনেকেই বোঝে। কিন্তু সমস্যা হল স্বৈরচারী হাসিনা অনেকের কাছে একাত্তরের রাজাকার আলবদরের চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। তাই রাজাকার বিরোধী জাতীয় ঐক্য আজ সুদূরপরাহত। দেশকে বর্তমান অবস্থা থেকে বের করতে হলে অন্ধ আওয়ামী ভক্তি ও অন্ধ আওয়ামী বিরোধিতা দুটোই ত্যাগ করতে হবে। একাত্তর আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস কিন্তু নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের (শেখ মুজিবের) হাতেই ছিল। মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা যেমন অবজেক্টিভ শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হওয়াটাও তেমনি অবজেক্টিভ। কোনটা থেকে কোনটা বাদ দেয়া যাবে না। আওয়ামী লীগ অন্যদের অবদান অস্বীকার করে একাত্তরকে দলীয়করণ করে যেমন একাত্তরের ক্ষতি করেছে অন্যেরা একই পথে হেঁটে আওয়ামী লীগকে বাদ দিলে সেই একই ভুল করবে। সত্যের বিকল্প মিথ্যা তাই সত্যের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগ যেমন দায়ী একাত্তরের পক্ষের অন্যান্য দলগুলোয় তেমন দায়ী। সংসার করার মত রাজনীতিও কম্প্রোমাইজ করে করতে হয়, তবে জানতে হয় কার সাথে সেটা করা যায় কার সাথে নয়। আর এজন্য দরকার দলের উপর দেশকে স্থান দেয়া, দরকার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি। স্বৈরাচার হটানো আর আওয়ামী লীগ হটানো এক কথা নয়। আজ এই শোকের দিনে জাতীয় ঐক্যের কথা বলে পতিত স্বৈরাচারকে প্রতিহত করার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের রায়ে যে কেউই ফিরে আসতে পারে আবার গণতান্ত্রিক ভাবে যে কাউকে ঠেকানোর চেষ্টা করা যায়। সিপিবি যদি জামাত শিবিরের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের (আসলে বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারই কমবেশি স্বৈরাচারী ছিল) বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে (আসলে সিপিবির বিগত কয়েক বছরের কর্মকান্ড তাদের নিজেদের চেয়ে জামাত শিবিরকেই বেশি শক্তিশালী করেছে) সেটা হবে সিপিবির পতনের শেষ ধাপ। দেশে এখন সহানুভূতি আর সহমর্মিতা নয়, চরম উদাসীনতা হল হট কেক। সরকার ও তার লেজুড়বৃত্তি করা সব দলই আজ দেশের ব্যাপারে উদাসীন, তাদের লক্ষ্য কিছুটা হলেও ক্ষমতার হালুয়া রুটির ছিটে ফোঁটা পাওয়া। এটা আর যাই হোক একাত্তরের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ নয়।  তবে এই উদাসীনতার মধ্যেও আশার আলো দেখিয়ে গেলেন শিক্ষিকা মাহেরীন ও তার আরেক সহকর্মী যারা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে বাঁচিয়ে গেলেন অনেক শিশুর প্রাণ। এরাই যেকোনো দেশের প্রকৃত হিরো, প্রকৃত দেশপ্রেমিক – মানুষ যত তাড়াতাড়ি অন্যের প্রতি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে যত্নশীল হবে তত তাড়াতাড়ি দেশ হায়েনা মুক্ত হবে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো