এতগুলো শিশুর মৃত্যুর দায় আমরা এড়াতে পারি না -ফজলুল কবির মিন্টু

সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি
কোন কিছুতে যেন মন বসছে না। টিভি দেখতে পারছি না। ফেসবুকে শিশুদের পোড়া ছবিগুলো দেখলে ভীষণ অস্থির লাগে। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। বারবার মনে হয়, এই শিশুদের মৃত্যুতে আমাদেরও দায় আছে—কারণ আমরা এই সমাজের একজন, এই রাষ্ট্রেরও অংশ। আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে বিভীষিকাময় এক বাস্তবতা, আর আমরা শুধু তাকিয়ে দেখছি।
২১ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে আরও একটি শোকাবহ দিন গেঁথে রইল। রাজধানীর অদূরে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান ভেঙে পড়ল “মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ”-এর ওপর। মুহূর্তেই আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল স্কুলটি। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, ৩২ জন কোমলমতি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক প্রাণ হারিয়েছেন। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, মৃতের সংখ্যা আরও বেশি। দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। এ যেন মৃত্যু নামিয়ে আনা হলো আকাশ থেকে, যেখানে কেউ প্রস্তুত ছিল না মরার জন্য।
আমরা কি কল্পনা করতে পারি—একটি শিশু স্কুলে পড়তে গিয়ে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে? তারা সবাই স্কুল ছুটির জন্য অপেক্ষা করছিল। আর ১৫/২০ মিনিট বিলম্বে দুর্ঘটনাটা ঘটলে হয়তো অনেকগুলো প্রাণ বেঁচে যেতো। অথচ মাত্র ১৫/২০ মিনিট আগে দুর্ঘটনা ঘটায় কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল? এই ভয়াবহ বাস্তবতাকে কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
এই দুর্ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি প্রতীক—রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থা, নীতিহীনতা ও অবহেলার প্রতিচ্ছবি। প্রশ্নটা খুব সহজ—ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কীভাবে দিনের পর দিন প্রশিক্ষণ বিমান ওড়ানো হতে পারে? কে সেই অনুমোদন দিয়েছে? কারা এই অনিরাপদ বাস্তবতাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই, আর জানারও সুযোগ নেই—যদি রাষ্ট্র নিজেই দায় এড়িয়ে চলে। আমরা বারবার দেখেছি, বড় দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, শোক প্রকাশ করা হয়, তারপর কাগজে-কলমে কয়েকটি সুপারিশ, কিছুদিন পর ভুলে যাওয়া। কিন্তু এবার তো শিশুদের শরীর পুড়েছে। এবার কি আমাদের ঘুম ভাঙবে না?
এই দুর্ঘটনায় একদিকে আমরা দেখেছি প্রশাসনিক ব্যর্থতা, অন্যদিকে দেখেছি মানবিকতা ও বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ নজির। শিক্ষিকা মাহেরিন, যিনি নিজের জীবন দিয়ে ২০ জন শিশুকে আগুন থেকে উদ্ধার করেছেন, তিনিই আমাদের কণ্ঠরোধ হওয়া সময়ে কণ্ঠস্বর। বিভিন্ন হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তদাতারা, আগুনে পোড়া মৃত্যু পথযাত্রী শিশু বন্ধুর কাছে ছুটে যাওয়া আরেক বন্ধুকে দেখে ঐ বন্ধু যখন বলে “আমি আমি জানতাম তুমি আসবে” তা যেন বন্ধুত্বের নতুন ইতিহাস তৈরি করে—এই ঘটনাগুলো আমাদের বলে দেয়, কিছু মানুষের মনুষত্ব, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এখনো বেঁচে আছে। সবকিছু এখনো একেবারে হারিয়ে যায়নি।
কিন্তু এই ভালোবাসার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা। এক অভিভাবক জানাচ্ছেন, তিনি আহত সন্তানের জন্য একটি ২ লিটার মিনারেল ওয়াটারের বোতল ৬০০ টাকা দিয়ে কিনেছেন। এই একটিমাত্র তথ্যই বলে দেয়—আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। লোভ যখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে, তখন বিপর্যয়ের মুহূর্তেও কেউ পানি বিক্রি করে আগুনের চেয়েও ভয়ঙ্কর দামে।
এই দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—এই সমাজ হয়তো যান্ত্রিকভাবে কিছুটা এগিয়েছে, কিন্তু নৈতিকতা, মানবিকতা আর দায়বোধের জায়গায় আমরা ভয়াবহভাবে পিছিয়ে আছি। একটি জাতির ভবিষ্যৎ তার শিশুদের নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করে। আর এই ঘটনায় আমরা সেই পরীক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখানে শুধু আনুষ্ঠানিক শোক প্রকাশে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। এখন প্রয়োজন—একটি স্বাধীন, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত, যা কেবল দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করবে না, বরং যথাযথ শাস্তিও নিশ্চিত করবে। আহতদের উন্নত চিকিৎসা, নিহতদের পরিবারের জন্য যথার্থ ক্ষতিপূরণ, এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান চলাচলের নীতিতে জরুরি ও বাস্তবভিত্তিক সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
এই শোক আমাদের চোখ ভিজাক, হৃদয় ভারাক্রান্ত করুক—তবু সেই শোক যেন আমাদের ঘুম ভাঙায়, বিবেক জাগায়। আমরা আর কোনো শিশুকে স্কুলের ইউনিফর্মে আগুনে ঝলসে যেতে দেখতে চাই না। আমরা চাই এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে কর্তৃত্ব থাকবে দায়িত্বের সঙ্গে, যেখানে মানুষ মানুষকে বেচে খাবে না, যেখানে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও মানবিকতা হবে সমাজের মূল চালিকাশক্তি।
আমরা কি সেই সমাজ গড়তে পারি না?
আমরা কি একবার গলা ছেড়ে বলতে পারি না—আর না!
আমরা আর চুপ থাকব না। আমরা প্রশ্ন করব, প্রতিবাদ করব—কারণ এই শিশুদের মৃত্যুতে আমাদেরো দায় আছে। আমরা এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক, এই সমাজের একজন অংশীদার। এবং এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই আমরা পরিবর্তনের শপথ নেব। কারণ আমরা মানুষ, এখনো মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই।
(লেখকঃ সংঠক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র)
