বিজন ভাবনা

বিজন ভাবনা (১):

– বিজন সাহা

গত শুক্রবার প্রকাশিত হল আমার নিয়মিত কলাম বিজ্ঞান ভাবনার ২০৮ নম্বর পর্ব। বছরে ৫২ সপ্তাহ মানে ২০৮ নম্বর পর্ব লিখতে দীর্ঘ চার বছর কেটে গেছে। এছাড়া গত ০৯ জুলাই ফেসবুক মনে করিয়ে দিল ২০২১ সালের এই দিনে প্রকাশিত প্রথম সংখ্যার কথা। সেখানে আমি লিখেছিলাম বিজ্ঞান ভাবনা নাম হলেও আমার চেষ্টা থাকবে বিজ্ঞানমনস্ক পাঠক গড়ে তোলার যে চেষ্টা করবে নিরপেক্ষ ভাবে ভাবতে, যেকোনো বিষয়েই প্রশ্ন করতে, যে ধরে নেবে তার আজকের সাফল্য শেষ কথা নয়, এটা নতুন সাফল্য অর্জনের পথে একটি ধাপ মাত্র। কারণ বিজ্ঞান মানেই অনুসন্ধান। বিজ্ঞান সত্যের সন্ধানে এক অবিরাম প্রক্রিয়া, অবিরাম পথচলা। তবে এক সময় মনে হল বিজ্ঞান  ভাবনা নামে লেখাটা সব সময় ঠিক তেমনটা থাকছে না যেমনটা প্রথমে ধারণা করেছিলাম। ইচ্ছা অনিচ্ছায় কিছু সাবজেক্টিভ বিষয় সেখানে চলে আসছে। অন্য দিকে অনেকেই ইতিমধ্যে সব ক্ষেত্রে আমার ভাবনার সাথে একমত না হলেও পড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। তাই অনেক দিন থেকেই লেখার নাম পরিবর্তনের একটা তাগিদ বোধ করছিলাম। সামনে দুটো পথ খোলা ছিল – হয় নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজের ভাবনায়, লেখায় পরিবর্তন আনা, যেটা লেখক হিসেবে আমার স্বাধীনতা কিছুটা হলেও খর্ব করে, না হয় নিজের কথা আগের মত করেই বলে যাওয়া আর সেক্ষেত্রে নাম বদলানো। যদি বিজ্ঞান ভাবনা না হয়, তাহলে কি নামে লেখা? অনেকগুলো নাম মনে এসেছিল।

প্রথমেই যে নামগুলো মাথায় আসে তা হল “ভোলগা তীরের গল্প” বা “দুবনা থেকে।” কিন্তু “ভোলগা তীরের গল্প” মানেই ভোলগাকে কেন্দ্র করে। আমার লেখা তো বিভিন্ন বিষয়ে। তাতে আসে বিশ্ব রাজনীতি, দেশীয় রাজনীতি, আমাদের দৈনন্দিন জীবন আরও কত কি! তাই “ভোলগা তীরের গল্প” ঠিক যায় না। অন্য দিকে “দুবনা থেকে” ব্যাপারটাও ঠিক নয়, কারণ আমি লিখি বিভিন্ন জায়গা থেকেই। যদি নাম বদলাতেই হয় তাহলে এমন নাম দেয়া দরকার যা বিভিন্ন দিক দিয়ে লেখার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। আরেকটা নাম মনে হয়েছিল – ভিন্ন ভাবনা। কারণ আমি বরাবরই বলি আমার লেখার উদ্দেশ্য কারও কাছে নিজের ভাবনা বা বিশ্বাসের সত্যতা প্রমাণ করা নয়, আমার লেখার উদ্দেশ্য শুধু একথা বলা যে বিষয়টা ভিন্ন ভাবেও দেখা যায়, ভাবা যায়। এটা অনেকটা ইংরেজি ছয় আর নয়ের মত। যে সংখ্যাটি এক জন ৬ (6) বলে দাবি করছে উল্টো দিকে দাঁড়ানো আরেক জন সেটা ৯ (9) বলে দাবি করতেই পারে। এটা সংখ্যার দোষ নয়, সংখ্যার প্রেক্ষিতে তাদের অবস্থানের ভিন্নতা। যেহেতু সত্য আপেক্ষিক এবং কোন কিছু সম্পর্কে আমাদের ইন্টারপ্রেটেশন পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল তাই নিজের বিশ্বাসকে একমাত্র সত্য বলে ধরে নেয়া সাধারণত কোন সমস্যার সমাধান দেয় না, বরং নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে। সেদিক থেকে “ভিন্ন ভাবনা” বলাই যেত। কিন্তু সেটাও ঠিক যুতসই মনে হচ্ছিল না। তাহলে? আরও একটা অপশন ছিল “অভি কাহিনী” নামে লেখার। আমি কখনও কখনও অভি নামেও লিখি। অভি_কাহিনী বলে বিভিন্ন লেখা হ্যাশ-ট্যাগ করি। এই অভির আবির্ভাব মহাভারতের অভিমন্যু থেকে। অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অন্যায় ভাবে নিহত হয়। যুদ্ধের শুরুতে যখন অর্জুন নারায়ণী সেনাদের মোকাবেলায় ব্যস্ত তখন দ্রোণাচার্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে চক্রব্যূহ রচনা করেন। অর্জুন ছাড়া আর কারও সেখানে ঢোকার বা সেখান থেকে বেরুনোর কৌশল জানা ছিল না। দ্রোণাচার্য তার প্রিয় ছাত্র একমাত্র অর্জুনকেই সেই মহাবিদ্যা দান করেছিলেন। কী করা? যুধিষ্ঠির, ভীম সবাই চিন্তিত। সেই মুহূর্তে এগিয়ে আসে অভিমন্যু। যুধিষ্ঠিরকে বলে সে যখন মাতৃ গর্ভে ছিল, তখন তার পিতা অর্জুন মা সুভদ্রাকে চক্রব্যূহ সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন। কিন্তু মা প্রবেশ কৌশলের বর্ণনা পর্যন্ত জাগ্রত ছিলেন। অর্জুন যখন বেরুনোর কৌশল বলেন সে সময় মা ঘুমিয়ে পড়েন। তাই অভিমন্যু চক্রব্যূহে প্রবেশ করতে পারলেও বেরুতে পারবে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত নয়। ভীম ও অন্যান্যরা অভিমন্যুকে সাহস দিয়ে বলে যে তারা ব্যূহ ভেঙ্গে তাকে বের করে নিয়ে আসবে, আর না হলে অর্জুনকে ফিরিয়ে আনবে। যাহোক, সেই অসম যুদ্ধে অভিমন্যু কৌরব সেনাদের নাভিশ্বাস ওঠায়। শেষ পর্যন্ত অভিমন্যুর সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ সহ সাতজন কৌরব মহারথী এক সাথে আক্রমণ করে অভিমন্যুকে হত্যা করে যা ছিল সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী অন্যায় যুদ্ধ।  সেই ছোটবেলা থেকেই অভি আমার অন্যতম প্রিয় চরিত্র। পরে অবশ্য এর সাথে অন্য দর্শন যোগ হয়েছে। এক অর্থে আমরা সবাই অভিমন্যু। কারণ আমরা জীবন নামক এই রঙ্গমঞ্চে বা যুদ্ধ ক্ষেত্রে শুধু প্রবেশ করতেই জানি, আজীবন যুদ্ধ করে বাঁচি আর এক সময় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবন নামক রণক্ষেত্র থেকে বেরুতে পারি। টাকা পয়সা, ধন দৌলত, বন্ধু বান্ধব কেউই মৃত্যুর হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে না। আমরা শেষ পর্যন্ত অভিমন্যুর মতই জীবন যুদ্ধে পাতা চক্রব্যূহ থেকে মুক্তি পাই। মরেও কেউ জয়ী হয়, কেউ বা পরাজিত। আর সেটা নির্ভর করে মানুষের নিজের জীবন দর্শনের উপর। তবে শেষ পর্যন্ত মনে হল এই নামটাও সঠিক ভাব প্রকাশ করতে ব্যর্থ হবে। তাহলে?

পড়ুন:  বিজন ভাবনা (২): কন্ট্রাস্ট - বিজন সাহা

হ্যাঁ, এখন থেকে নতুন নামে লিখব। নাম হবে “বিজন ভাবনা।” কেউ এটাকে আমার নামের সাথে মিলিয়ে নিতে পারেন। যেহেতু এটা হবে আমার ভাবনা, তাই সেটা মিথ্যা হবে না। তবে এই নামের পেছনে আরও কিছু গল্প আছে। আমার জন্ম গত শতাব্দীর ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে – তখন দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি মোটেই সন্তোষজনক ছিল না। অবশ্য আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে এই প্রশ্ন আসতেই পারে যে সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তখন ভালো ছিল নাকি এখন? যাহোক মা বলেছেন সেই সময় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার আভাস দেখা দিলে গ্রামের হিন্দু পাড়ার প্রচুর লোকজন পালিয়ে যায়, আমাদের পাড়া হয়ে পড়ে প্রায় জনশূন্য। আর বিজনের অর্থ  জনশূন্য – সেই থেকেই আমার নাম। এই কারণে কিনা জানি না, আমি বরাবরই একা থাকতে ভালবাসি, নিজের সঙ্গ পছন্দ করি, নিজেকে নিজের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করি। এটা একাকীত্ব নয়, এটা আমার নিজের ভালোলাগা। তাছাড়া বিগত একত্রিশ বছর আমি থাকি দুবনায়, বলতে গেলে বাঙালি বিবর্জিত এলাকায়। দুয়েকজন যে নেই তা নয়, তবে দেখা হয় কালে ভদ্রে। আমার যেহেতু মুখোমুখি বাংলায় কথা তেমন বলা হয় না তাই বাংলায় কথা লিখি। এটাও আমার লেখালেখির অন্যতম মূল কারণ। একা থাকতে ভালবাসা, বাঙালি পরিবেশের বাইরে একা থাকা, দেশ বা অন্য বিষয় নিয়ে মূলত একা একাই ভাবা – এসবই বিজন ভাবনা নামের উৎস। উল্লেখ করা যেতে পারে যে আমি গবেষণাও মূলত একাই করি। মাঝে মধ্যে কেউ কেউ কোলাবরেশনের অফার দেয়, করিও, তবে একা কাজ করে যে আনন্দ, যে স্বাধীনতা উপভোগ করি অন্যদের সাথে করে ঠিক ততটা করি না। এই সব বিবেচনায় এখন থেকে আমার লেখা “বিজন ভাবনা” নামেই যাবে যদিও লেখায় ধরণ আগের মতই থাকবে। আমি আশাবাদী এই নাম পরিবর্তন লেখার ক্ষেত্রে আমাকে আরও বেশি স্বাধীনতা দেবে আর আমার লেখাকে দেবে আরও নতুন নতুন বৈচিত্র্য। সাথে থাকুন, পাশে থাকুন আর নিজেদের পছন্দ, অপছন্দ জানান যাতে লেখাটা শুধু আমার কথা না হয়ে আপনাদের কথাও হয়, মনোলগ না হয়ে ডায়ালগ হয়।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া