চলমান সংবাদ

শুল্কহার থেকে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি : যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক দরকষাকষি প্রতিরক্ষা পর্যন্ত গড়িয়ে পড়েছে – সংকেত অশনি হতে আর কতদূর?

-শরীফ শমশির

উপদেষ্টা মহোদয় বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে একটা ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি চাইছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এই খবরটি দেশের নানা রাজনৈতিক ডামাডোলের আড়ালে পড়ে যায়নি। জুলাইয়ের মধ্যে একটা শুল্ক চুক্তি করতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল ব্যস্ত সময় পার করছে। ইতিমধ্যে ট্রাম্প নির্ধারিত ৩৫% শুল্ক বৃদ্ধি বাংলাদেশের পোশাক খাতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ওয়ার্লমাটসহ বিভিন্ন ক্রেতা তাদের ক্রয়াদেশ স্থগিত করছে বা বাতিলের চিন্তা করছে। দরকষাকষি হচ্ছে বর্ধিত শুল্ক কে দিবে? ক্রেতা নাকি উৎপাদক। বাংলাদেশের উপর বেশ চাপ বাড়ছে। একটা সংবাদে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রাম ইপিজেডের কারখানাগুলো বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। দেশে যখন ডলারের বিপরীতে টাকার মান বাড়ছে, সামষ্টিক অর্থনীতি ভালোর দিকে তখন এই শুল্ক-ফোঁড়া বিষময় হয়ে উঠেছে, পোশাক খাতে বা রপ্তানি খাতে। এই বিপদ পোশাক খাত দিয়ে শুরু হলেও তার প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতি ও রাজনীতিতে। উপদেষ্টা যখন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি চাইছে তখন বুঝা যায় তা সামরিক বলয় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাগলকে মুতার সময় ধরতে হয়- প্রবাদের মোক্ষম ব্যবহারের পথ ধরেছে। তার ফাঁদ হলো, ফ্রেমওয়ার্ক।
একথা সকলেই জানেন, ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টিকফা চুক্তির বলয়ে আছে। ইতিমধ্যে বিশের অধিক বৈঠক হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে।
টিকফা মানে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামোগত চুক্তি। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার প্রতিষ্ঠার পর থেকে, সদস্য দেশগুলো বহুপাক্ষিক বা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বিষয়ে সম্মত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের টিকফা চুক্তি একটা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান টিকফা চুক্তিতে আবদ্ধ। বাংলাদেশ চুক্তিতে আছে তবে চুড়ান্ত বিষয়ে এখনো সম্মত নয়। এই চুক্তি, পরিবেশ, শ্রম মান, মেধাস্বত্ত্ব, সেবা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে কাজ করলেও চুক্তির বাধ্যবাধকতা সামরিক হস্তক্ষেপে গিয়ে ঠেকে। চুক্তির পর যদি কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চুক্তি ভঙ্গ করে তবে যুক্তরাষ্ট্র বৈধভাবে তার দেশের বা দেশের কোম্পানির স্বার্থের সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টিকফা প্রশ্নে বাংলাদেশের দরকষাকষি বেশ কয়েক বছরের। বিশেষ করে, শ্রম মানের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করে। ইপিজেড গুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের প্রশ্নকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করছে।
মেধা স্বত্ত্ব প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্যাটেন্ট ব্যবহার করলে তার রয়ালিটি যুক্তরাষ্ট্রকে দিতে হবে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কোনো উৎপাদনে অংশ না নিয়েও ডিজিটাল বা কম্পিউটার এবং ওষুধ শিল্প থেকে রয়্যালিটি বাবদ আয় করবে এবং বাংলাদেশ আর কোনো পাইরেসি করতে পারবে না। বাংলাদেশের ডিজিটাল সহ সকল শিল্পগত বস্তুতে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকার আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের সকল ডিজিটাল বিষয়ে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হলে তা দমনে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এছাড়াও, সেবা খাতও যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর অবারিত ক্ষেত্রে পরিণত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ না হলেও তার বাণিজ্যক স্বার্থ বহাল থাকবে।
মজার বিষয় হলো, ফ্রেমওয়ার্ক মানে বঙ্গোপসাগরের খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য থাকবে এবং তার জন্য বাংলাদেশের নৌবাহিনীর সাথে তার যৌথ মহড়া আর যৌথ থাকবে না। ধীরে ধীরে তা যুক্তরাষ্ট্রের নৌমহড়ায় পরিণত হবে।
ফ্রেমওয়ার্ক আসলে শুধু বাণিজ্য নয়, এটা একটা সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বুঝাপড়া। ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি হলে বাংলাদেশের বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শ্রম, পরিবেশ, সেবা, কৃষি ও খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তার সুরক্ষা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের অধিকার থাকবে।
এখন অপেক্ষার পালা বাংলাদেশের শুল্ক আলোচনা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। অনেক উপদেষ্টা ওয়াশিংটনে কি হচ্ছে তা জাতিকে পরিস্কার না করলেও জ্বালানি উপদেষ্টা সত্য ভাষণ দিয়েছেন। তাঁকে ধন্যবাদ। তবে বাংলাদেশের আলোচনা শুধু শুল্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই – এটাই দুশ্চিন্তার কারণ। যা কিছু হোক, জাতির জানার অধিকার যেন থাকে। শুভকামনা, বাংলাদেশ।