শ্রমিক সুরক্ষার নামে প্রহসন: তদন্ত কমিটিতে প্রতিনিধি মনোনয়নে বিধি ২৯(৭)–এর ফাঁদে শ্রমিকরা ফজলুল কবির মিন্টু
মোতাহেরা বেগম সুমি—চট্টগ্রামের একজন অভিজ্ঞ সিনিয়র নার্স। দীর্ঘদিন নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে কর্মরত থাকার পর প্রায় আড়াই বছর আগে তিনি সাগরিকা শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত একটি শতভাগ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা অর্গানিক জিন্স–এ যোগ দেন। এই কারখানাটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) পরিচালিত বেটার ওয়ার্ক কর্মসূচির আওতাভুক্ত এবং নিজেকে একটি ‘কমপ্লায়েন্ট’ প্রতিষ্ঠান বলে দাবি করে।
চাকরির প্রথম দুই বছর মোতাহেরার পেশাগত জীবন মোটামুটি নির্বিঘ্নেই কেটেছে। কিন্তু গত ছয় মাস ধরে তার ওপর শুরু হয় একপ্রকার মানসিক নির্যাতন। মেডিকেল অফিসার অনুরাধা বিশ্বাস তাকে একাধিকবার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এমনকি প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপকও মৌখিকভাবে তাকে ইস্তফা দেওয়ার ইঙ্গিত দেন। এতে মোতাহেরা মানসিকভাবে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নেয় ১০ মে ২০২৫ তারিখে, যখন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে একটি অপ্রাসঙ্গিক ও অস্পষ্ট অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। সেখানে অভিযোগ করা হয়, মোতাহেরা উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সহকর্মীদের সঙ্গে অযথা যুক্তিতর্কে জড়ান। কিন্তু কোন কর্মকর্তা বা সহকর্মীর কথা বলা হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। বরং মজার ব্যাপার হচ্ছে, অভিযোগের ভিত্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ২৩-এর উপধারা ৪ এবং দফা ‘খ’, যা মূলত প্রতিষ্ঠানের সম্পদ চুরির সঙ্গে সম্পর্কিত—a completely unrelated and damaging allegation.
মোতাহেরা যথাযথভাবে জবাব দেন এবং আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে জানান, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্পষ্ট ও অনভিপ্রেত এবং অভিযোগে উল্লিখিত ধারা ও দফার সঙ্গে তার আচরণের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার জবাব বিবেচনা না করেই কর্তৃপক্ষ ধারা ২৪(ঘ) অনুসারে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং তাকে নিজ পক্ষের দুইজন প্রতিনিধির নাম দিতে বলে।
এখানেই আসে শ্রম আইনের কিছু অসংগতি—ধারা ২৪(ঘ)-এ বলা হয়েছে, শ্রমিকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে একটি সমসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে (শ্রমিক ও মালিক পক্ষের সমান প্রতিনিধি) কমিটি গঠন করতে হবে, যাতে শ্রমিক ন্যায্য বিচার পেতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এই সুরক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় বিধি ২৯(৭)-এর কারণে, যেখানে বলা হয়েছে, শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের কারখানার অভ্যন্তর থেকেই মনোনীত হতে হবে।
এই বিধি কার্যত শ্রমিকের স্বাধীন প্রতিনিধি নিয়োগের অধিকারকে অস্বীকার করে এবং মালিক পক্ষের প্রভাবিত কর্মচারীদের মধ্য থেকেই প্রতিনিধি বাছাইয়ের ফাঁদে ফেলায় শ্রমিক কার্যত একা হয়ে পড়েন। মোতাহেরার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। কারখানার অভ্যন্তর থেকে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিনিধি পাওয়া অসম্ভব হওয়ায় তিনি কোনো নাম দেননি। ফলে কর্তৃপক্ষ ‘অংশগ্রহণমূলক কমিটি’ থেকে তার পক্ষের প্রতিনিধিদের মনোনয়ন দেয়, যারা তদন্তে তার বিপক্ষেই অবস্থান নেয়।
২১ জুন অনুষ্ঠিত তদন্ত কার্যক্রমে মোতাহেরা কার্যত একজন হয়ে পড়েন ছয়জনের বিপরীতে। অভিযোগকারী হিসেবে হাজির করা হয় মেডিক্যাল অফিসার অনুরাধা বিশ্বাস এবং সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত একজন নার্সকে—যারা পূর্বে কখনো অভিযোগকারী হিসেবে উল্লেখই ছিলেন না। পুরো তদন্ত প্রক্রিয়াই এক ধরনের নাটকীয়তা ও পক্ষপাতদুষ্টতার উদাহরণ হয়ে ওঠে।
সবশেষে ২৫ জুন মোতাহেরাকে বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হয়। অভিযোগের বিবরণে দেখা যায়, এবার নতুন করে ধারা ২৩-এর দফা ‘ক’, ‘চ’, ‘জ’ ও ‘ঞ’ যুক্ত করা হয়েছে—যার কোনোটিই পূর্ববর্তী কারণ দর্শানো নোটিশে ছিল না। এটি স্পষ্টভাবে আইনের লঙ্ঘন এবং প্রক্রিয়াগত অসঙ্গতির বহিঃপ্রকাশ।
প্রশ্ন উঠছে—তদন্ত কমিটি কি আদৌ শ্রমিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়?
আইনত ধারা ২৪(ঘ)–তে যে ন্যায়বিচারের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে বিধি ২৯(৭) তারই বিরোধিতা করছে। শ্রমিক যদি নিজ পছন্দমতো, বিশেষ করে বাইরের স্বাধীন প্রতিনিধি নিয়োগ দিতে না পারেন, তাহলে সমসংখ্যক প্রতিনিধি থাকার নিয়মটি কাগজে-কলমে থাকলেও তা কার্যত মূল্যহীন।
একমাত্র শাস্তি বরখাস্ত—আরেকটি কাঠামোগত ত্রুটি
শুধু তদন্ত কমিটির গঠনে নয়, শ্রম আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও একটি বড় কাঠামোগত অসংগতি রয়েছে—তা হলো শাস্তির পর্যায়ভিত্তিক কাঠামোর অভাব। বাস্তবে দেখা যায়, প্রায় সব ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রেই একটি মাত্র শাস্তি প্রয়োগ করা হয়—শ্রমিককে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা। অথচ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্যে সতর্কীকরণ, বেতন কর্তন, এককালীন শাস্তি বা সাময়িক বরখাস্তসহ একাধিক দণ্ডের সুযোগ রাখা হয়েছে।
তবুও মালিকপক্ষ প্রাথমিক অভিযোগের পরপরই সর্বোচ্চ শাস্তি—বরখাস্ত—দানের প্রবণতা দেখায়। কোনো অভিযোগের গভীরতা বিবেচনায় সুনির্দিষ্ট ও উপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণের জন্য আইনটি কোনো দৃষ্টান্তমূলক নির্দেশনা দেয় না। এই ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে মালিকপক্ষ প্রায়শই যেকোনো অভিযোগেই বরখাস্তের মতো চূড়ান্ত শাস্তি প্রয়োগ করে থাকে। এই ধরনের অতিমাত্রায় শাস্তিমুখী আচরণ শ্রমিকদের ওপর অন্যায্য চাপ সৃষ্টি করে এবং আইনের আশ্রয় না নিয়ে নীরবে সরে যাওয়ার সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে।
এমনকি এটি একটি গবেষণার বিষয় হিসেবেও বিবেচ্য হতে পারে —গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের বেসরকারি শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্যে ‘বরখাস্ত’ ছাড়া অন্যান্য বিকল্প শাস্তি কতটুকু কার্যকর হয়েছে, তা পর্যালোচনা জরুরি।
মোতাহেরার পদক্ষেপ:
মোতাহেরা বর্তমানে শ্রম আইনের ধারা ৩৩ অনুযায়ী মালিক বরাবর গ্রিভ্যান্স দরখাস্ত দাখিল করেছেন এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন। এই মামলা শুধুমাত্র একজন নার্সের চাকরি হারানো নয়—এটি শ্রমিক সুরক্ষার নামে প্রচলিত আইনি প্রহসনের একটি বড় উদাহরণ।
উপসংহার:
শ্রম আইনে যদি সত্যিকার অর্থে শ্রমিকের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে প্রথমত, ধারা ২৪(ঘ)-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধি ২৯(৭) সংশোধন করে শ্রমিককে স্বাধীনভাবে প্রতিনিধি মনোনয়নের অধিকার দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, আইনে বর্ণিত বিভিন্ন দণ্ড ব্যবস্থাকে বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে আনতে হবে এবং অভিযোগ অনুযায়ী কোন দণ্ড প্রযোজ্য হবে তা স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে।
এই আইনি অসংগতি ও বাস্তবিক প্রভাবকে সামনে এনে মোতাহেরার মতো শত শত শ্রমিকের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এটি শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত লড়াই নয়, বরং একটি কাঠামোগত সমস্যার বিরুদ্ধে এক সামাজিক আন্দোলনের সূচনা হতে পারে।
(লেখকঃ বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক এবং বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক)