চলমান সংবাদ

সম্পাদকীয়

-পথেঘাটে পৈশাচিকতা: এই সমাজ কি আর সভ্য আছে?

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র, মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে একজন মানুষকে—লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে—নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। শত শত মানুষ ও যানবাহনের ভিড়ের মধ্যেই তাঁকে পিটিয়ে, ইট-পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করা হয়। তাঁর শরীরের ওপর উঠে কেউ কেউ লাফিয়েছে, তাঁকে বিবস্ত্র করা হয়েছে। এসব ঘটেছে সিসিটিভি ক্যামেরার সামনে, জনসমক্ষে, রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকায়।

একটি রাষ্ট্রের পক্ষে এর চেয়ে বড় লজ্জা আর অপমান কী হতে পারে? কীভাবে একটি সমাজে এমন বর্বরতা সম্ভব? কোথায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী? প্রশ্ন শুধু পুলিশের প্রতি নয়—প্রশ্ন গোটা রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সমাজব্যবস্থার প্রতি।

নিহত লাল চাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। বরং জানা গেছে, তিনি চাঁদা না দেওয়ায় একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। এ পর্যন্ত যেসব তথ্য প্রকাশ পেয়েছে, তাতে রাজনীতির ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী চক্রের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট। এও জানা গেছে, আটক ব্যক্তিদের কেউ কেউ যুবদলের পরিচিত মুখ, কারও কাছ থেকে বিদেশি পিস্তলও উদ্ধার হয়েছে।

এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এটি পুরো সমাজের বিবেক ও মনুষ্যত্বকে আঘাত করেছে। এটি একটি বার্তা দিচ্ছে—যে কেউ যে কোনো সময় রাজনৈতিক কিংবা সন্ত্রাসী শক্তির খপ্পরে পড়ে এমন বীভৎস পরিণতির শিকার হতে পারেন। এমন একটা দেশে আমরা বাস করছি, যেখানে কেউ হত্যা করেও দিব্যি ভিডিওতে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যেতে পারে।

রাষ্ট্র যদি নাগরিকের জীবন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে তা কেবল শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতাই নয়, এটি একটি জাতির নৈতিক ও মানবিক পরাজয়। রাষ্ট্র যখন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়, তখন এমন ঘটনা ঘটবেই।

আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, এ ধরনের সহিংসতা ও রাজনৈতিক সন্ত্রাস দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। মাদক, চাঁদাবাজি, দখল ও প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা গ্যাং সংস্কৃতি আজ জননিরাপত্তার সবচেয়ে বড় হুমকি। আর যখন এসব গ্যাংয়ের পেছনে রাজনৈতিক দল বা নেতা থাকে, তখন তারা আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যায়।

আমরা লাল চাঁদ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই এবং দায়ীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাই। একইসঙ্গে, এ ঘটনার রাজনৈতিক ও সামাজিক উৎস অনুসন্ধান ও নির্মূল করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে আমরা এগিয়ে যাব।

এই সময় আমাদের সবাইকে প্রশ্ন করতে হবে—এই সমাজ কি আর সভ্য আছে? এই রাষ্ট্র কি এখনো আমাদের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম? আমরা কী আগামী প্রজন্মকে একটি রক্তাক্ত, হিংস্র ও অনিরাপদ নগরী উপহার দিতে চাই?

আমরা চাই, বিচার হোক—দ্রুত, স্বচ্ছ এবং দৃষ্টান্তমূলক। অপরাধী যারাই হোক, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নয়, তাদের অপরাধই বিবেচ্য হোক। আর রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি যেন প্রমাণ করে—এখনো এটি মানুষের, সভ্যতার ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে পারে।