চলমান সংবাদ

বিজ্ঞান ভাবনা (২০৮): জুলাই

– বিজন সাহা

জুলাই মাস। ২০২৪ সালের জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসেবে পরিগণিত হবে। কারো কাছে সেটা হবে কালো অধ্যায়, কারো কাছে বিজয়ের গৌরব গাথা। একদল মানুষ বর্তমানের অনিয়ম, বিচারহীনতা আর সরকারের ব্যর্থতা দেখে বলবে আগেই ভালো ছিলাম, আরেক দল বলবে স্বৈরাচারের পতন যেকোনো ব্যর্থতার গ্লানি ধুয়ে নিয়ে যাবে। কোনটা ঠিক?

কয়েক দশক আগের বাংলাদেশে এরকম গ্রামের অভাব ছিল না যেখানে শিক্ষিত মানুষ ছিল না, ছিল না স্কুল বা ভালো ডাক্তার। এখানে এক দরিদ্র ছেলে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করল। গ্রামের মানুষ ভাবল সবাই মিলে যদি সেই ছেলেকে ডাক্তারি পড়ায় তাহলে তাদের গ্রামের মানুষ চিকিৎসা পাবে। হয়তো সেই ছেলেটিও তখন ডাক্তার হয়ে গ্রামের মানুষের সেবা করার স্বপ্ন দেখত। না দেখলেও জীবনের লক্ষ্য রচনায় এমনটিই লিখত। ধরা যাক ছেলেটি সবার সহযোগিতায় মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হল আর একসময় ডাক্তার হয়ে এলাকায় ফিরে এলো। এমনটি ঘটলে সেই ছেলের ও গ্রামের মানুষের সবার স্বপ্নই সফল হবে। কিন্তু যদি ছেলেটি গ্রামে ফিরে না এসে সপ্তাহে একদিন গ্রামে বিনা পয়সায় বা অল্প মূল্যে চিকিৎসা দেয়া শুরু করে তাহলে ছেলেটির স্বপ্নের পাশাপাশি গ্রামের লোকের স্বপ্ন আংশিক ভাবে পূর্ণ হবে। আর ছেলেটি যদি আর গ্রামে ফিরে না আসে ও গ্রামের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে তাহলে গ্রামের মানুষের স্বপ্ন সফল হবে না। আবার ছেলেটি যদি পাশ করেও ডাক্তারি না করে ধরা যাক ব্যবসা বা অন্য কোন ক্ষেত্রে উন্নতি করল, তাহলে সে সফল মানুষ হল বটে কিন্তু তার ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করার স্বপ্ন পূর্ণ হল না। আর সে যদি পাশ করতেই না পারে বা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে তাহলে গ্রামের মানুষের তো বটেই এমনকি নিজের স্বপ্নও পূর্ণ হবে না। তাই কোন কিছুর সাফল্য বা ব্যর্থতা কোন সরল বিষয় নয়। বিপ্লবের ক্ষেত্রে সেটা নির্ণয় করা আরও কঠিন, কারণ এর সাথে জড়িত থাকে লাখ মানুষের স্বপ্ন, জড়িত থাকে লাখ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা।

আমি ভারত বিভাগকে ব্যর্থ মনে করি। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় লিখেছি। কারণ যে স্লোগান দিয়ে ভারত বিভক্ত হয়েছিল তার একটিও পূর্ণ হয়নি। জিন্নাহ বলেছিলেন পাকিস্তান আর ভারত হবে দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ – কিন্তু সেটা হয়নি। সাম্প্রদায়িকতা এতটুকু কমেনি। সাধারণ মানুষ – বিশেষ করে এসব এলাকার মুসলিম জনগণের অবস্থার খুব একটা হেরফের হয়নি। তবে এটা ঠিক ভারত ভাগ এসব এলাকার এলিটদের জন্য ক্ষমতার পাশাপাশি অঢেল সম্পদ এনে দিয়েছে। তাই এলিটদের জন্য সেটা সফল হলেও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যর্থ। একই ভাবে গত বছরের গণ অভ্যুত্থান কিছু কিছু মানুষের জন্য ক্ষমতা ও অঢেল সম্পদের দুয়ার খুলে দিলেও সাধারণ মানুষের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনেনি। বিচারহীনতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। যে কোটার বিরুদ্ধে লড়াই করে সরকার উচ্ছেদ এখন সেই কোটা প্রতি পদে পদে। মুক্তিযোদ্ধার কোটার জায়গায় এসেছে জুলাই কোটা, সমন্বয়ক কোটা আরও কত কি। কিন্তু মানুষ যে আঁধারে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। বরং তাদের জীবনের কষ্ট লাঘবের জন্য সার্বজনীন পেনশন ও অন্যান্য ভাতা ইত্যাদি যেটুকু ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেটাও আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে।

প্রতি মুহূর্তে বলা হচ্ছে সংস্কারের কথা। কিন্তু এই সংস্কার কি? সংস্কারের নামে যেন জনগণকে ধোঁকা দেয়া না হয় সেটাও মাথায় রাখতে হবে। আমাদের প্রধান সমস্যা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারের পতনে আমরা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কথা বলি। আমরা বলি যে আওয়ামী লীগ যতই এখানে বাইরের শক্তির হাত দেখুক না কেন, জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মাঠে নেমেছিল আওয়ামী দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে। মানুষ শুধু ভাত কাপড় চায় না, চায় নিরাপত্তা, চায় গণতান্ত্রিক অধিকার। অর্থনীতি, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি করার পরেও আওয়ামী লীগ জনগণকে তাদের হেলমেট বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি, মানুষকে নিজের ভোট নিজেকে দিতে দেয়নি। ধর্মীয় উগ্রবাদ লালন করেছে। দেশকে সাংস্কৃতিক ভাবে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর এসব কারণেই মানুষ রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু সমস্যা হল এটা যারা বিশ্বাস করে তাদের একাংশ, যারা ক্ষমতার বড় স্টেক হোল্ডার, বিশ্বাস করতে চায় না যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধও হয়েছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। এমনকি তারা মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের ষড়যন্ত্রে বাঙালি-বিহারী দাঙ্গা বলে প্রচার করে। কিন্তু বাস্তবতা হল তখন পাক বাহিনীই বাধ্য করেছিল মানুষকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে। আর সেই দিক থেকে একাত্তর ও স্বাধীনতা – এটা মীমাংসিত অধ্যায়। একাত্তরকে মুছে দেবার কোন রাস্তা খোলা নেই। যারা এটা করে তারা বাংলাদেশের শত্রু, তারা বাঙালি জাতির শত্রু, তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের শত্রু। আজ যদি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন আসে, সেই প্রশ্ন জামাত সহ অন্যান্য স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষেত্রেও আসা উচিৎ। আমরা যদি আইনের শাসন চাই, তাহলে সেটা সবার জন্যই সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে আর সব ধরণের ইন্ডিমনিটি বিল উঠিয়ে সবার বিচারের জন্য ফেয়ার ও লেভেল গ্রাউন্ড তৈরি করতে হবে।

পড়ুন:  বিজন ভাবনা (১): - বিজন সাহা

ইদানিং বেশ কিছু পোস্টে দেখলাম জুলাই নিয়ে প্রশ্ন করলেই সেটাকে ভিন্ন ভাবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু আবারও বলি এই প্রশ্ন করার সুযোগ কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো আর বর্তমান প্রশাসনই করে দিয়েছে। আগেই ভালো ছিলাম এটা মানুষের আর্তনাদ। তারা আগে ভালো ছিল না বলেই রাস্তায় নেমেছিল, ভালো থাকার জন্য লড়াই করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণে তারা আবার হতাশ হয়ে বলল আগেই ভাল ছিলাম। এটাই দেশের রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের চরম ব্যর্থতার বিরুদ্ধে গণ রায়। জীবনে প্রতিটি মুহূর্তে মানুষ তিন রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায় – সব পথই অজানা, সব পথই বিপদসঙ্কুল। সুস্থ ও সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবাইকে সাথে নিয়ে সেই বিপদ পার হয়, অসুস্থ ও লোভী নেতৃত্ব জনগণকে বিপদে ফেলে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে মনোযোগ দেয়। আজ অনেককেই দেখি এসব ব্যর্থতার দায় পরাজিত শক্তির কাঁধে চাপাতে। আওয়ামী লীগও তার ব্যর্থতা জামাত আর বিএনপির কাঁধে চাপাত। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হত না। এখনও তাই। রাজাকার আর স্বৈরাচারের যাঁতাকলে পড়ে জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। সব ব্যর্থতায় আওয়ামী লীগের হাত খোঁজা আসলে নিজেদের দুর্বলতাকে ঢাকার হাস্যকর প্রয়াস। এটা যেমন দক্ষিণপন্থী শিবিরে বিদ্যমান তেমনি বিদ্যমান বামপন্থী শিবিরে। শিবির এখানে কী ওয়ার্ড। আমাদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে সব কিছুতেই আওয়ামী লীগের দোষ ধরে এমনকি যে স্বাধীনতার জন্যে ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ দিল সেটা রক্ষার জন্যেও চেষ্টা না করা। আচ্ছা, পলপট সমাজতন্ত্রের নামে লাখ লাখ মানুষ খুন করেছে বলে কি সমাজতন্ত্র পচে গেছে? তাহলে কেন আওয়ামী দুঃশাসনের কারণে জয় বাংলা, শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এসব আমরা হারিয়ে যেতে দেব? এসবই কি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের বিশ্বাসঘতকতার প্রমাণ নয়? এই যে বামাতি আর জামাতি পাশাপাশি বলা হয় এটা কি শুধু কথার কথা? আমরা,  আমাদের বামেরা কি এই বলার পেছনে কোন ইন্ধনই যোগায়নি?

একটা বিতর্ক সমাজে আছে – তা হল এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত গণ অভ্যুত্থান নাকি কালার রেভ্যুলিউশন? অবশ্যই এক পর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষ এখানে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করেছে, তবে এটাও ঠিক পেছন থেকে অদৃশ্য শক্তি একে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে। এর আগে সমস্ত গণ অভ্যুত্থানের পেছনে রাজনৈতিক দল ছিল, তাদের রাজনৈতিক দাবি দাওয়া ছিল। এবার সেটা হয়নি। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, নব্বুইয়ের এরশাদ বিরোধী অভ্যুত্থান বা শাহবাগ আন্দোলন এসব ক্ষেত্রে কখনোই আন্দোলনকারীরা নিজেরা মানুষ খুন করে সরকারকে দায়ী করে জন সমর্থন আদায় করেনি। এই আন্দোলনে সেটা হয়েছে। যারা করেছে তারা নিজেরাই সেটা স্বীকার করেছে, করছে। অনেক শহীদের মৃত্যুলোক থেকে ফিরে আসা সেটাই প্রমাণ করে। তাই জনগণের অংশগ্রহণকে খাটো না করে এটাও স্বীকার করে নিতে হবে যে এই আন্দোলন কিছু কিছু মানুষের ও বিদেশী সংস্থার ষড়যন্ত্রের ফসল। কারণ তারাই আন্দোলনের ফলভোগ করছে। কেন আন্দোলনের ফসল হাতছাড়া হয়ে গেল, কেন সোনার বাংলা গড়ার প্রতিশ্রুতি এখন নতুন করে পাকিস্তান গড়ার আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে সেটা পরিষ্কার হবে। সমস্যা না বুঝলে সেটার সমাধান সম্ভব নয়।

জুলাই এক দিকে যেমন আমাদের অর্জন, আরেক দিকে আমাদের বিসর্জনও। হ্যাঁ, আমরা জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিয়েছি বা দিতে বাধ্য হয়েছি। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা মৌলবাদের কাছে হেরে গেছি। আপদ দূর করে বিপদ ডেকে এনেছি। এ থেকে বেরুনোর জন্য দরকার আত্মসমালোচনা, দরকার নির্মোহ আত্মবিশ্লেষণ। অনেকেই বাম ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন। কিন্তু ঘরে যখন শান্তি নেই, ঘর যখন লণ্ডভণ্ড তখন কেউ কি আসবে সেই ডাকে? বিজয়ের অন্যতম পথ হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় উপস্থিত থাকা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া, আমাদের বামেরা প্রায়ই এসব মিস করে অসময়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়।

দেশের ক্রান্তিকালে মানুষ রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ভিন দেশের শান্তি রক্ষার অজুহাতে নিজ দেশের মানুষকে অশান্তির আগুনে জ্বলতে দেখেও নিশ্চিন্তে বাঁশি বাজাচ্ছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দেখছে কীভাবে দেশটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জয় নাকি মৌলবাদের কাছে পরাজয় ঠিক কোনটি দেশের জন্য মঙ্গলজনক সেই বিষয়ে নিশ্চিত না হতে পারা এখন তথাকথিত একাত্তরের পক্ষের অবশিষ্ট শক্তির প্রধান সমস্যা। কী সামরিক, কী রাজনৈতিক, কী বুদ্ধিবৃত্তিক – সব সেক্টরে এমন নপুংশক, দিশেহারা ও অদক্ষ নেতৃত্ব বাঙালি জাতির জীবনে কখনো এসেছে বলে মনে হয় না। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুবর্ণ সুযোগ এরা পেয়েছিল মবের কাছে সেই সুযোগ হারিয়ে ফেলার নজীর বিশ্বের কোথাও আছে কি?

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো