বিজ্ঞান ভাবনা (২০৬): শুরু না শেষ-বিজন সাহা

শেষ পর্যন্ত ইরান ও ইসরাইল যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা দিয়েছে আর ডোন্যাল্ড ট্রাম্প ইমপিচমেন্ট ও নোবেল শান্তি পুরস্কার নামক নরক ও স্বর্গের মাঝামাঝি ঝুলছেন পৌরাণিক হরিষচন্দ্র রাজার মত। অবশ্য দেবতাদের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। তারা সাপ হয়ে দংশন করে তো ওঝা হয়ে ঝাড়ে। ট্রাম্পের সেই অবস্থা। ইরানের পারমাণবিক গবেষণাগারে বোমা মেরে সোজা শান্তির জন্য হুমকি দিয়েছেন। একে বলে বল প্রয়োগ করে শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটা হরহামেশাই ঘটে, স্বামীরা বৌদের মেরে চুপচাপ সংসার করতে বাধ্য করায়। যাহোক এই যুদ্ধে মনে হয় সবাই নিজেদের জয়ী বলে ভাবছে যদিও আমার কেন যেন মনে হয় সবাই পরাজিত হয়েছে। ইসরাইল, আমেরিকা, ইরান সবাই বিজয় উল্লাস করে যুদ্ধ সমাপনী উৎসব পালন করছে। মজার ব্যাপার এই যে আজকাল সবাই নিজেদের বিজয়ী মনে করে। কিছুদিন আগে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে দুই পক্ষই নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করল। রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধে রাশিয়া সবার দৃষ্টিতে এগিয়ে থাকলেও জেলেনস্কি সুযোগ পেলেই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে। এভাবে চলতে থাকলে ক্রিকেট বা ফুটবলের মত যুদ্ধের মাঠেও আম্পায়ার বা রেফারি নিয়োগ করতে হবে যাতে করে যুদ্ধে জয় পরাজয় নির্ধারণ করা যায়। না হলে এত লোকের এত স্বপ্ন, এত আত্মত্যাগ সবকিছুই মাটি।
আমেরিকা ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক গবেষণাগারে বোমা ফেলার ফলে অনেকেই লিখেছিলেন – লা ফিনিটা – শেষ। আমার কেন যেন মনে হয় খেলা কেবল শুরু। আমরা শুধু পারমাণবিক সংঘর্ষের নতুন পর্যায়ে উপনীত হলাম। এতদিন পর্যন্ত নতুন কোন দেশ যাতে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে না পারে সে জন্য তাদের উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হত। সেটা ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে, তেমনি হয়েছে উত্তর কোরিয়া আর ইরানের ক্ষেত্রেও। প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও ইসরাইলের যে পারমাণবিক অস্ত্র আছে সেটা ওপেন সিক্রেট। এছাড়াও পারমাণবিক অস্ত্র আছে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন আর ফ্রান্সের। আচ্ছা এদের পারমাণবিক অস্ত্র আছে তারা জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য বলে? জানি না। কেন যেন প্রশ্নটা মাথায় এল। যাহোক ইরানের কথায় ফেরা যাক। এই প্রথম কোন দেশের উপর সামরিক আক্রমণ করে সে দেশের পারমাণবিক গবেষণা ক্ষতিগ্রস্থ করা হল যদিও পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে কোন বাধা নেই। মনে পড়ে কসোভার কথা। পশ্চিমা বিশ্ব যখন বেলগ্রেডের আপত্তির তোয়াক্কা না করে কসোভার স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া বলেছিল যে পশ্চিমা বিশ্ব প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিল। পরবর্তীতে রাশিয়া পশ্চিমাদের দেখানো পথে ক্রিমিয়ার স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে জার্মানি, জাপান সহ অনেক দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কথা বলছে। উত্তর কোরিয়ার তুলনায় ইরান সব দিক থেকেই অনেক উন্নত দেশ – তা সে লোকবলেই হোক, অর্থনীতিতে হোক বা অন্য কোন দিকেই হোক। তারপরেও আমেরিকা উত্তর কোরিয়া আক্রমণ করেনি। কারণ তার পারমাণবিক অস্ত্র আছে। এ থেকে অনেক দেশই পারমাণবিক অস্ত্রকেই নিজেদের রক্ষা কবচ মনে করতে পারে। সেদিক থেকে বিশ্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি বিপদজনক বলে মনে হয়। আবার যে জার্মানি দু’ দুটো বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়েছে তাদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র অনেকেই ভালো চোখে দেখবে না। উল্লেখ করা যায় যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দৌড়ে এগিয়ে ছিল। আর সেই সময় পারমাণবিক অস্ত্র হিটলারের হাতে পড়লে পৃথিবীর অবস্থা কি হত সেটা কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে। জার্মানির বর্তমান নেতৃত্বের অনেকেই নাৎসি বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উত্তরসূরি। আমরা যারা বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছি ও একাত্তরের রাজাকারদের উত্তরসূরিদের জানি তা থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না যে বর্তমান জার্মান নেতাদের কেউ কেউ সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করতেই পারে ঠিক যেমনটা ঘটেছে বাংলাদেশে। সেক্ষেত্রে জার্মানির পারমাণবিক গবেষণাগারে যদি রাশিয়া বা অন্য কেউ আক্রমণ করে তখন? কারণ আমেরিকা নজির তৈরি করেছে। রাশিয়া যদি নিজেকে বিপদের সম্মুখীন মনে করে সে নিঃসন্দেহে আমেরিকার দেখানো পথ গ্রহণ করবে। অন্তত এখানে অনেক বিশেষজ্ঞ সেদিকেই মত দিচ্ছে।
এতদিন পর্যন্ত আয়রন ডোম বলে খ্যাত ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা নিশ্ছিদ্র বলে মনে করা হত। কিন্তু ইরান বারবার সেই ব্যুহ ভেদ করে ইসরাইল আক্রমণ করেছে। সেটা ইসরাইলকে নতুন করে ভাবাবে। শুরু হবে নতুন ধরণের অস্ত্র প্রতিযোগিতা। হয়তো বা অনেক দেশই তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নে মনোযোগ দেবে। গড়ে তুলবে ড্রোন ব্রিগেড। অন্তত রাশিয়া ইতিমধ্যেই সেই ঘোষণা দিয়েছে। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ এখন প্রধানত ড্রোনের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এসব দেখে আমার রামায়ণের রাম রাবণের যুদ্ধের কথা মনে হয়। একজন অগ্নি বাণ ছুঁড়লে অন্যজন বরুণ বাণে সেটা প্রতিহত করে, একজন সর্প বাণ ছাড়লে অন্যজন ছাড়ে গরুড় বাণ। এখানেও সেই অবস্থা। সবাই যার যার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি আক্রমণ শক্তি বাড়াতে ব্যস্ত। তাছাড়া শোনা যাচ্ছে যে আমেরিকা ইরানের পারমাণবিক গবেষণাগারের ততটা ক্ষতি করতে পারেনি যতটা বলা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে সব পক্ষের শক্তির পাশাপাশি দুর্বলতাগুলো সামনে চলে এসেছে। চাইলেই যে একটি দেশ অন্য দেশের পারমাণবিক স্থাপনার মত স্পর্শকাতর জায়গা আক্রমণ করতে পারে সেই পথও খুলে গেছে। শুধু তাই নয় যুদ্ধ ঘোষণা না করে অন্য দেশের উচ্চ পর্যায়ের সামরিক অফিসার ও বিশেষ করে বেসামরিক বিজ্ঞানীদের হত্যা সেটাও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে জায়েজ করা হয়েছে।
সাঙ্কত পিতেরবুর্গ ইকোনমিক ফোরামে পুতিন বিখ্যাত রুশ লোককথা উল্লেখ করে বলেছেন যেখানে রুশ সৈনিক পা রাখে সেটাই রাশিয়া। প্রশ্নোত্তরের সময় অনেকটা ঠাট্টাচ্ছলে একথা বললেও এর গুরুত্ব অনেক। কারণ যুদ্ধ বিরতি আলোচনা শুরু হবার পরে তো বটেই এমনকি যুদ্ধের সমস্ত সময় ধরে এই প্রথমবারের মত তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে এরকম ক্যাটাগরিক্যাল মত দিলেন। বললেন বিভিন্ন সময়ে রাশিয়া ইউক্রেনকে যুদ্ধ বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছে আর এও বলেছে প্রতিদিন শর্ত হবে আরও কঠিন। বিশেষ করে কুরস্কে ইউক্রেন সেনারা সাধারণ মানুষের উপর যেভাবে অত্যাচার করেছে, নিরীহ মানুষদের ঘরে বন্ধ করে যেভাবে হত্যা করেছে তাতে ইউক্রেনের প্রতি এদেশের মানুষের সহানুভূতি অনেকটাই কমে গেছে। এখন যদি রুশ সেনারা ইউক্রেনের উপর আক্রমণ তীব্র করে আর এতে যদি কিছু সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাতে মনে হয় এদেশের সাধারণ মানুষ তা নিয়ে কথা তুলবে না। কী গাজা, কী ইরান আক্রমণে ইসরাইলের কৌশল ও তাতে পশ্চিমা বিশ্বের নেতাদের বেশির ভাগের সায় বুঝিয়ে দিয়েছে যে যুদ্ধক্ষেত্রে মানবতার সুযোগ কম, সেটাকে বরং বোকামি বা দুর্বলতা বলে মনে করে শত্রু পক্ষ।
ইতিমধ্যে ন্যাটোর সম্মেলন হয়েছে। এই প্রথম ইউক্রেন নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়নি। সেটা যে ট্রাম্পের কারণে বুঝতে অসুবিধা হয় না। সাধারণত দুই দিনের সম্মেলন দুই ঘন্টায় শেষ হয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আগের মত কঠিন কিছু বলা হয়নি, বরং এই সমস্যার যে সামরিক সামাধান নাই সেটাই বলেছে। তবে ট্রাম্প ইউরোপ ত্যাগ করার পর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সমাবেশে মূষিক আবার সিংহের রূপ নিয়েছে। আবার যুদ্ধের দামামা বাজছে। এখানে বিশেষ ভূমিকা রাখছে বাল্টিকের ছোট ছোট দেশগুলি। এ যেন কুকুর লেজ নাড়ায় না, লেজই কুকুরকে নাড়ায়। তবে এটাই বর্তমান ট্রেন্ড। আজকাল এলজিবিটি বা এ জাতীয় ছোট ছোট গ্রুপ সম্মান অধিকারের নামে জনগণের মূল অংশকে অকেজো করে ফেলছে। গণতন্ত্র আজ যেন সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের মতামত নয় গণতন্ত্র আজ অল্প কিছু মানুষের অধিকার রক্ষার অস্ত্র যদি তাতে অধিকাংশ মানুষের যৌক্তিক অধিকার বিসর্জন দিতে হয়ও। আর এই নীতিই ব্যবহৃত হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠনে। এতে সমস্যা ছিল না যদি না ছোট ছোট দেশের জেদ বড়দের যুদ্ধের মাঠে না নামাত। অন্তত এখন মনে হয় রাশিয়া আর পশ্চিমা বিশ্ব দুটো গ্যালাক্সির মত প্রচন্ড দ্রুত গতিতে সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে কি রাজনৈতিক লড়াই কী দেশে দেশে যুদ্ধ এসব জনগণের ভালোর জন্য যতটা না তারচেয়ে বেশি এই জনগণকে কে কত বেশি পরিশীলিত ভাবে শোষণ করবে তার প্রতিযোগিতা। জনগণের জন্য রাজনৈতিক পরিবর্তন তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপদ থেকে মুক্তি পেয়ে বিপদে পড়া বা ফাঁসির রজ্জু আর ফায়ারিং স্কোয়াড এই দুইয়ের মধ্যে একটি বেছে নেয়া – মৃত্যু তার নিশ্চিত শুধু তাকে কীভাবে বরণ করবে সেটা বাছাইয়ের নাম এখন গণতন্ত্র।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
