চলমান সংবাদ

অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেল সরকার

-রাজস্ব ঘাটতি, বিনিয়োগ সংকট ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় চাপ বাড়ছে অর্থনীতিতে

নতুন অর্থবছর শুরু হওয়ার আগেই ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আশানুরূপ রাজস্ব আদায় না হওয়া, সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা এবং বিদেশি উৎস থেকে প্রত্যাশিত পরিমাণে ঋণ না আসায় সরকারের পক্ষে অভ্যন্তরীণ উৎস, বিশেষত ব্যাংক খাতের উপর নির্ভরতা বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৯৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। তবে ১৫ জুন পর্যন্ত নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫৯১ কোটি টাকা বেশি।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের ভাষ্যমতে, রাজস্ব আদায় ও বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার দ্বৈত প্রভাবেই সরকারকে বাড়তি ঋণের পথে হাঁটতে হচ্ছে। এপ্রিল পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এক লাখ ২৭ হাজার ৬৮০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আহরণ করতে পেরেছে মাত্র ৯৪ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা।

ঋণের চাপে বেসরকারি খাত সংকুচিত
সরকারি ঋণ বাড়ায় বেসরকারি খাতের জন্য ব্যাংক ঋণের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগ বিশ্লেষকরা। তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম সংগঠক মহিউদ্দিন রুবেল ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে সব শিল্প খাতেই বিনিয়োগের প্রবণতা কমে গেছে। তদুপরি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগের পরিবেশকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৭.৫ শতাংশে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২.৪ শতাংশ কম। এতে প্রমাণ মেলে যে, দেশে নতুন বিনিয়োগ কার্যত স্থবির হয়ে আছে।

বিনিয়োগ না বাড়লে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন বলেন, “রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে কিংবা বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যয় সামাল দেয়। বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কম, তাই সরকার সে সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। তবে এটি কোনো শুভ লক্ষণ নয়। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে না, বরং মূল্যস্ফীতি ও সরকারিভাবে দায়-দেনা বাড়বে।”

অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির জানান, দেশের আর্থিক খাত বর্তমানে তীব্র চাপে রয়েছে। তার ভাষায়, “দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ঘাটতি, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ এবং রাজস্ব ঘাটতির কারণে সরকারকে চরম আর্থিক সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে।”

তার তথ্যমতে, বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা নতুন ঋণ প্রবাহের এক-চতুর্থাংশের সমান।

বিদেশি বিনিয়োগেও ধস
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনসিটিএডি) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০২৫’ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে দাঁড়িয়েছে ১২৭ কোটি ডলারে, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম। এই হ্রাসপ্রাপ্ত এফডিআই বার্ষিক রফতানি আয়ের এক-চতুর্থাংশ এবং মাসিক রেমিট্যান্স আয়ের অর্ধেকেরও কম।

নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত গতি ফিরবে না
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব নয় একটি নির্বাচিত, পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন সরকারের হাতে দায়িত্ব নেয়ার আগে। “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিনিয়োগ ফেরানো কঠিন,” বলেন ড. মাহফুজ কবির।

অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. আইনুল ইসলামও বলেন, “রাজস্ব আদায়ে অদক্ষতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনীতির প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যদি শ্রমবাজারে ধাক্কা আসে বা জ্বালানির দাম বেড়ে যায়, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।”

সাবধানী মুদ্রানীতির ইঙ্গিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহকে প্রভাবিত করেছে। তবে সরকারের স্থিতিশীলতা ফিরে এলে এ অবস্থা উন্নত হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী মুদ্রানীতিতে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।”

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত কিংবা কর ও রাজস্ব ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের আর্থিক কাঠামোতে স্থায়ী সমাধানের আশা করা কঠিন।