আগামী ২৭ ও ২৮ শে জুন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম লং মার্চ কেন? -ডা. আরিফ বাচ্চু
এই লং মার্চ সরকার পতনের জন্য নয়, যদি তাই হত তবে লং মার্চ হতো যমুনার দিকে।
এই লং মার্চ হবে, বাংলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীল নক্সা উন্মোচন করার জন্য। যাতে মানুষ আমেরিকার এই ভয়ংকর যুদ্ধ পরিকল্পনা বুঝতে পারে। এই লং মার্চ তাই জনতার লং মার্চ……
বাংলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীল নক্সা
এক দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে লাভজনক ও বন্দরের ৫৫% কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারা, নিউমুরিং টার্মিনাল কোন আন্তর্জাতিক দরপত্র বা প্রতিযোগিতা ছাড়া দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড যাদের সাথে মার্কিন নৌ-বাহিনীর চুক্তি ও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তাদেরকে দেয়ার উদ্যোগ, অন্য দিকে কাতার ও তুরষ্কের বিনিয়োগকারীদেরকে দেশে অস্ত্রের যন্ত্রাংশ তৈরীর কারখানা করতে দেয়ার চেষ্টা করা, রাখাইন করিডোর বা ত্রান চ্যানেল দেয়া নিয়ে তালবাহানা, অন্যদিকে স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট স্টার লিংক এর অনুমোদন, এবং আমেরিকান আর্মি কক্সবাজারে প্রবেশ করে অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে ট্রেনিং দেয়া, এই উপমহাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ভূরাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নীল নকশার অংশ বলেই মনে হচ্ছে এবং এর মধ্য দিয়ে মার্কিনের “চীন ঘেরাও” নীতির স্বার্থে যে ব্যবহৃত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ফলে বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক ভাবে আক্রান্ত হবে। বাংলাদেশেকে মায়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করবে। ভারত, চীন ও পাকিস্তান সহ নানা শক্তির দ্বন্দ্ব সংঘাত ছায়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশ। সেই সাথে রাখাইন করিডোর বা ত্রান চ্যানেল মারফত বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাবে। বিষয়টি জানাজানি হলে সরকার এই ব্যাপারে নানা সময় স্ববিরোধী কথাবার্তা বলে আরো ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়েও সরকারের পদক্ষেপ সন্দেহজনক।
এই পরিস্থিতিতে কোন অবস্থাতেই বাংলাদেশকে আমেরিকার ছায়া যুদ্ধক্ষেত্র হতে দেয়া যাবেনা।
আসুন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লং মার্চ থেকে আওয়াজ তুলিঃ
“আমার মাটি আমার মা, যুদ্ধক্ষেত্র হবে না।”
“আমার মাটি আমার মা, আমেরিকান কলোনি হবে না।”
“আমেরিকার ছলচাতুরী, বুঝে শুনে কবর দাও।”
“আমেরিকা যুদ্ধবাজ, দেশ করবে ছাড়খাড়।”
“আমেরিকার চক্রান্তে, যুদ্ধ চাইনা এই দেশে।”
“এই অঞ্চলের আমেরিকান-ইসরায়েল, বাংলাদেশ হবেনা।”
“মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ধ্বংস হোক নিপাত যাক।”
আমেরিকানরা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে তাদের ভূরাজনৈতিক চক্রান্তের কিছু কিছু কল কাঠি নাড়াচাড়া শুরু করছে, যার ফলে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া নিম্ন লিখিত বিষয় গুলোকে এক সূত্রে গাঁথা বলেই মনে হচ্ছেঃ
–ডিপি ওয়ার্ল্ড কে লাভজনক নিউমুরিং টার্মিনাল দেয়ার উদ্যোগ।
–রাখাইনে ত্রান চ্যানেল দেয়ার উদ্যোগ।
–দেশে অস্ত্র তৈরীর কারখানা করার উদ্যোগ নেয়া।
–স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা প্রতিষ্ঠান স্টার লিংক কে অনুমোদন দেয়া।
–অগ্নি নিরাপত্তা প্রশিক্ষনের নামে কক্সবাজারে মার্কিন সৈন্য বাহিনীর উপস্থিতি।
এবার আসুন প্রতিটি বিষয় এক এক এক করে বিশ্লেষন করিঃ
ক) চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল এর ব্যপারে সরকার যা বলছেঃ
১) নিউমুরিং টার্মিনাল ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিলে টার্মিনালের অব্যবস্থাপনা, চাঁদাবাজি বন্ধ হবে।
২) বিদেশী কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে নিউমুরিং টার্মিনাল এর সক্ষমতা বাড়াবে ও “পোর্ট টার্ন এরাউন্ড টাইম” কমিয়ে আনবে অর্থাৎ এখন একটি জাহাজের মালামাল খালাস করতে যেখানে গড়ে ৭ দিন লাগে সেখানে তা ২ দিনে নামিয়ে আনা যাবে।
৩) ডিপি ওয়ার্ল্ড কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে প্রতি ঘন্টায় ২৫ টি কন্টেইনার এর জায়গায় ৩৫ টি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারবে।
৪) ডিপি ওয়ার্ল্ড প্রতি কন্টেইনার হ্যন্ডলিং এর জন্য চার্জ করবে ৩ ডলার, এখন চার্জ করা হচ্ছে ৯ ডলার।
৫) ডিপি ওয়ার্ল্ড পৃথিবীর অনেক দেশের বন্দর পরিচালনার কাজ করছে; তারা আন্তর্জাতিক মানের বন্দর পরিচালনায় দক্ষ।
৬) ডিপি ওয়ার্ল্ডের মতো অভিজ্ঞ কোম্পানির মাধ্যমে বন্দরের আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর সম্ভব হবে এবং এর মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে এবং বন্দরের কার্যকারিতা বাড়বে।
সরকারের ভাষ্যের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করে আমরা বলতে চাই, সমুদ্রবন্দর ইজারা কেবল অর্থনীতির বিষয় নয়; এটি একটি কৌশলগত বিষয়। এর ফলে জাতীয় সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কোনো কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। এর ফলে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিদেশি কর্তৃত্বের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে; ভবিষ্যতে এ সম্পদ ঘিরে জটিলতা ও বিরোধের আশঙ্কা বাড়তে পারে, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি সমুদ্রবন্দর নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯২ শতাংশই এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের নির্বিঘ্ন প্রবাহ নিশ্চিত করতে এই বন্দর অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এই বন্দর প্রতিবছর প্রায় তিন মিলিয়ন টিইইউ (২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনারের একক হিসাব) কনটেইনার হ্যান্ডল (পরিচালনা) করে।
বিদেশি কোম্পানিকে টার্মিনাল চালানোর দায়িত্ব দিলে যে বন্দরে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে তা ঠিক নয়, যদি তাই হতো তবে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল তো বর্তমানে বিদেশিরা চালাচ্ছে এতেও কেন চাঁদাবাজি বন্ধ হল না?
উজান থেকে আসা পলি, নগরবাসীর ফেলে দেয়া বর্জ্যে প্রতিনিয়ত ভরাট হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। প্রতিনিয়ত ড্রেজিং করেও জোয়ারের সময় সবোর্চ্চ সাড়ে ৯ মিটার গভীরতার বেশি জাহাজ এই বন্দরে ভেড়ানো যায় না। ভাটায় গভীরতা নেমে আসে ৬ থেকে ৭মিটারে।
কিন্তু বিশ্ব নৌ বানিজ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন ব্যবসায়ীরা ছোট জাহাজের পরিবর্তে ১০/২০ হাজার কন্টেইনার পরিবহণ করতে পারে এমন জাহাজ ব্যবহার করছেন।
অথচ শ্রীলংকার কলম্বো বন্দরে ১৮ মিটার, ভিয়েতনামের সায়গন বন্দরে সাড়ে ১১ মিটার, সিঙ্গাপুর বন্দরে ১৬ মিটার জাহাজ আনায়েসে ভিড়তে পারে জেটিতে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল গুলোতে বড় জাহাজ ভেড়ার কোন সম্ভবনা নাই। ফলে ছোট ছোট জাহাজ দিয়ে গভীর সমুদ্র থেকে বন্দরে পণ্য আনা নেয়া করতে হয়।
বড়বড় যেসব মাদার ভ্যাসেলে পন্য নিয়ে বাংলাদেশের জল সীমানায় আসে সেগুলিকে কতুবদিয়ায় বহি: নোঙগরে পন্য খালাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। এক থেকে দেড় হাজার টনের ছোট ছোট লাইটার জাহাজ দিয়ে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে সেগুলিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছানো হয়।
কর্ণফুলীর নাব্যতা ধীরে ধীরে কমছে। শুধু নাব্যত নয়, কমেছে নদীর প্রশস্থতাও। নদীর দুপাড় দখল করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা। ফলে ক্রমশ ছোট হয়ে পড়েছে কর্ণফুলী নদীও।
বন্দর বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর তেমন একটা সুযোগ নেই। কয়েকটি বিদেশী অপারেটর, কিংবা কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে এখনো মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি গড়ে তোলা হয়নি।
বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হলে পণ্যে শুল্কায়নেরও আধুনিকায়ন করতে হবে। কাষ্টমস হাউজে গতিশীলতা বাড়াতে হবে। পণ্যে শুল্কায়ন যত সহজীকরণ হবে, যত দ্রুত হবে তত দ্রুত বন্দরে পন্য হ্যান্ডেলিং বেড়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরকে যদি বিশ্বমানের বন্দর হিসাবে গড়ে তুলতে হয় তাহলে সবার আগে প্রয়োজন দ্রুত মাতারবাড়িতে ডীপ সী পোর্টের কাজ শেষ করা। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগর উপকূলে বে-টার্মিনাল নামে নতুন বন্দর গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা দ্রুত শেষ করা । সেই সাথে কানেক্টিভিটি বাড়ানো এবং সেই সাথে নৌপথ সচল করা ।
চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে মূল কন্টেইনার টার্মিনাল আছে তিনটি নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল, চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনাল, পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল। এছাড়া কার্গো টার্মিনাল রয়েছে ৪টি, বিশেষায়িত টার্মিনাল রয়েছে প্রায় ২৫ টি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের ৫৫% কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয় নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালে।
চট্টগ্রাম বন্দরের নির্মাণাধীন প্রকল্প সমূহঃ
১) মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর: নির্মাণাধীন আছে, (২০২৬ সালের মধ্যে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে)।
২) বে টার্মিনাল-১ প্রকল্প নির্মাণ ও পরিচালনাকারী: সিংগাপুর এর পোর্ট অফ সিংগাপুর অথরিটি (পিএসএ) কোম্পানি ।
৩) বে টার্মিনাল-২ প্রকল্প নির্মাণ ও পরিচালনাকারী: আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড কোম্পানি।
৪) লালদিয়া টার্মিনাল প্রকল্পঃ ডেনমার্ক এর এপি মুলার কোম্পানির সাথে জি টু জি চুক্তি হওয়ার পথে।
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ২০০৭ সালে নির্মিত হয়, যার প্রাথমিক সক্ষমতা ছিল বছরে ১.১ মিলিয়ন টিইইউ। সাম্প্রতিক সময়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো সংযোজনের মাধ্যমে এটি আরও উন্নত করা হয়েছে। বর্তমানে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় টার্মিনালটি বছরে ১.৩ মিলিয়ন টিইইউর বেশি কনটেইনার হ্যান্ডল করছে, যা তার নির্ধারিত সক্ষমতার চেয়েও বেশি।
এনসিটি প্রতিবছর এক হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যে টার্মিনাল লাভজনকভাবে কাজ করছে, সেটি বিদেশি পরিচালনায় হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তা আসলে কতটুকু বাস্তবসম্মত?
বর্তমানে একটি জাহাজ বার্থিংয়ের (জাহাজের অপেক্ষার সময়) জন্য চট্টগ্রামে তিন–চার দিন অপেক্ষা করে, সেখানে সিঙ্গাপুরে এটি মাত্র ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা এবং কলম্বোয় ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই সম্পন্ন হয়। একইভাবে কনটেইনার খালাসে চট্টগ্রাম বন্দরে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে, যা বিশ্বের শীর্ষ বন্দরে সাধারণত ২–৩ দিনের মধ্যে শেষ হয়; এর ফলে রপ্তানি ও আমদানির খরচ বেড়ে যায়।
কিন্তু বন্দরের কর্মদক্ষতা কেবল অপারেশন ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে না; ভৌগোলিক অবস্থান ও কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপরও নির্ভর করে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলী নদীর তীরে একটি সরু চ্যানেলে অবস্থিত, যেখানে পানির গভীরতা (ড্রাফট) প্রায় সাড়ে ৯ মিটার যা আবার ভাটার কারণে ৬-৭ মিটারে নেমে আসে।
পানির অগভীরতার পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর সরু চ্যানেল, তীক্ষ্ণ বাঁক ও জোয়ার-ভাটার পরিবর্তন জাহাজ চলাচলে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে জাহাজের ‘টার্ন-অ্যারাউন্ড টাইম’ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। অবস্থানগত সীমাবদ্ধতার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতাকে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দরের মানদণ্ডে সরাসরি মূল্যায়ন করা যৌক্তিক নয়।
প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা ছাড়াও আধুনিক স্ক্যানিং প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সিস্টেমের অভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। অবকাঠামো ও গুদাম ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা পণ্য হস্তান্তরে বিলম্ব ঘটায় আর শ্রমিকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি অপারেশনাল কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাই চট্টগ্রাম বন্দরের চ্যালেঞ্জ কেবল কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়েই সীমাবদ্ধ নয়, এর কার্যকর সমাধানে প্রয়োজন কাস্টমস–প্রক্রিয়ার দ্রুততর ডিজিটালাইজেশন, শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং গুদামজাতকরণ ও পরিবহনব্যবস্থার আধুনিকীকরণ।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ২০২৩ সালে; সরকারের সঙ্গে সরকার (জিটুজি) আলোচনার মাধ্যমে। তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বন্দর নিয়ে কেন একই নীতি অনুসরণ করছে?
বিষয়টি শুধু একটি সরকারের সিদ্ধান্ত নয়; বরং এটি এক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মতবাদ—‘নব উদারনৈতিক (নিউ লিবারেল) দর্শনের প্রতিফলন।’ এই দর্শনের লক্ষ্য হলো বাজারব্যবস্থার সম্প্রসারণ, সরকারি সম্পদের বেসরকারীকরণ, নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে মূলধনের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা এবং বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর জন্য প্রবেশাধিকারের পথ উন্মুক্ত করা।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আইএফসি, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো এই দর্শন বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রেখে চলেছে। তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বৈদেশিক বিনিয়োগের নামে কৌশলগত খাতগুলোতে বেসরকারীকরণে উৎসাহ দিচ্ছে, যা অনেক সময় জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
একাধিক উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, এ ধরনের চুক্তির পরিণতি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে; যেমন আফ্রিকার ছোট্ট দেশ জিবুতি ২০০৬ সালে দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ‘ডোরালে কনটেইনার টার্মিনাল’ পরিচালনার জন্য ৫০ বছরের জন্য ইজারা দিয়েছিল। শুরুতে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়। ফলে ২০১৮ সালে জিবুতি সরকার একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল করে। জবাবে ডিপি ওয়ার্ল্ড আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি সংস্থায় মামলা করে এবং পরে ক্ষতিপূরণ দাবি করে জয়লাভও করে।
এ ধরনের উদাহরণ শুধু আফ্রিকায় নয়, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতেও দেখা গেছে। যেমন ২০১৪ সালে কেনিয়ার মোম্বাসা বন্দরের একটি টার্মিনাল চীনা কোম্পানি সিআরবিসিকে দিয়েছিল। শুরুতে রাজস্ব বাড়লেও পরে স্থানীয় শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ কমে যায়। কারণ, চীনা কোম্পানিগুলো নিজস্ব শ্রমিক ও সরবরাহব্যবস্থা ব্যবহার করেছিল।
বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যেসব অবকাঠামো প্রকল্পে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) বা বেসরকারীকরণ বাস্তবায়িত হয়েছে, সেগুলোর ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে আর্থিক ঝুঁকি ও দায় শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেই বহন করতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও কেনিয়ার মতো দেশের অভিজ্ঞতা বলছে, বিদেশি কোম্পানিকে কৌশলগত খাতের নিয়ন্ত্রণ দিলে স্থানীয়দের ক্ষমতা দুর্বল হয় এবং স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা কমে যায়।
এ ছাড়া একাধিক গবেষণা দেখিয়েছে, কৌশলগত খাতে বেসরকারীকরণ টেকসই উন্নয়নের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি; বরং আয়বৈষম্য, শ্রমবাজার সংকোচন এবং সামাজিক অসন্তোষ বেড়েছে। ওইসিডির ২০২২ সালের এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, যথাযথ নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ছাড়া কৌশলগত সম্পদের বেসরকারীকরণ দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন ও দর–কষাকষির ক্ষমতা দুর্বল করে।
যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় নীরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক উদ্বেগের কারনে তার দেশে ৩৬০ টা সমূদ্র বন্দর/টারমিনাল থাকা সত্ত্বেও চায়নার COSCO কোম্পানি যখন পোর্ট অব লস এঞ্জেলস পরিচালনায় স্বয়ংক্রিয় ও AI-ভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করে, তখন মার্কিন কর্তৃপক্ষ চিন্তিত ছিল যে চীন সাইবার স্পাইয়িং বা অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। তখন উক্ত পোর্ট অব লস এঞ্জেলস পরিচালনা থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয় চীনের COSCO কোম্পানিকে, তাই COSCO তার শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হয় ২০২২ সালে। আর তাদের তাবেদার কিছু মানুষ বাংলাদেশে বলছে সমূদ্র বন্দর পরিচালনা করতে দিলে জাতীয় নীরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক উদ্বেগের কোন কারন নাই।
২০০৬ সালে আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড, যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি গুরুত্বপূর্ণ পোর্ট পরিচালনার দায়িত্ব পায়, কিন্তু তখন এই বিষয়ে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয় এবং রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক উভয় পার্টিই ডিপি ওয়ার্ল্ডকে উক্ত পোর্ট সমূহ পরিচালনা করতে দেয়ার ব্যপারে বিরোধীতা করে, তারা বলেছিল এতে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হবে। তৎকালীন বুশ সরকারের প্রশাসন বলেছিল যেহেতু ডিপি ওয়ার্ল্ড একটি আরব আমিরাতের কোম্পানি এবং যেহেতু আরব আমিরাতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ট সামরিক সম্পর্ক রয়েছে তাই ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এইসব বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দিলে কোন ভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ত ও জাতীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘন করবে না, কিন্তু তারপরও কংগ্রেসের ভোটাভুটিতে বুশের এই যুক্তি টেকেনি ও শেষ পর্যন্ত ডিপি ওয়ার্ল্ড এর সাথে এই চুক্তি বাতিল করা হয়।
ডিপি ওয়ার্ল্ড এর সাথে, তানজানিয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি পোর্ট পরিচালনার চুক্তিও বাতিল হয় সেখানকার জাতীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হওয়ার ইস্যুতে।
তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, দক্ষতা বাড়ানোর একমাত্র উপায় কি বিদেশি কোম্পানির হাতে বন্দর ব্যবস্থাপনা তুলে দেওয়া? ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশেই নবনির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল একটি সৌদি কোম্পানির অধীন পরিচালনার জন্য দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী বার্ষিক পাঁচ লাখ টিইইউ হ্যান্ডল করার কথা থাকলেও এক বছর পর গড় হ্যান্ডলিং লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৩ শতাংশ। সেখানে এখনো পর্যাপ্ত গ্যান্ট্রি ক্রেন বসানো হয়নি এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল ও টার্মিনাল অটোমেশন গড়ে তোলা হয়নি। অনেকের মতে, ২০২৩ সালে সৌদি অপারেটরের সঙ্গে করা চুক্তিটি জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এ দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে, শুধু বিদেশি অপারেটর আনলেই দক্ষতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত হয় না। অবকাঠামো, জনবল ও সুশাসনের ঘাটতি থাকলে তারাও ব্যর্থ হয়। একই অভিজ্ঞতা আফ্রিকার মোমবাসা ও লাতিন আমেরিকার গুয়ায়াকিল বন্দরে দেখা গেছে; যেখানে বিদেশি পরিচালনা সেবার মান বাড়াতে পারেনি, বরং দুর্বল চুক্তি, শ্রমিক অসন্তোষ ও অতিরিক্ত খরচের মতো সমস্যা তৈরি করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে সবচেয়ে দ্রুত, সহজ এবং স্বল্প ব্যয়ে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ হলো কাস্টমস সংস্কার। বর্তমানে একটি কনটেইনার ক্লিয়ারেন্সে গড়ে সাত দিন লাগে, অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এটি এক–দুই দিনে সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিকস পারফরম্যান্স সূচক অনুযায়ী, কাস্টমস দক্ষতায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩২ দেশের মধ্যে ১০০তম; যা আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আধুনিক স্ক্যানার, স্বয়ংক্রিয় রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, ২৪/৭ অপারেশন ও দক্ষ জনবল নিশ্চিত করা গেলে বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়া ছাড়াই বন্দরের সামগ্রিক স্থবিরতা অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
এনসিটি পরিচালনা বিষয়ে দুবাইভিত্তিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে ইজারার শর্তাবলি এখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এর ফলে চুক্তির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি কিংবা কৌশলগত ঝুঁকি সম্পর্কে স্বচ্ছ ও বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন করা দুরূহ। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বলছে, বিদেশি অপারেটর নিয়োগে বন্দরের দক্ষতা বাড়লেও কনটেইনার চার্জ বৃদ্ধি, শ্রমিক অধিকার সংকোচন, কৌশলগত তথ্যঝুঁকি এবং আন্তর্জাতিক বিরোধের আশঙ্কা বাড়ে।
বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা অনুযায়ী, বেসরকারীকরণে বন্দর পরিচালনার ব্যয় ২০–৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতায়ও দেখা গেছে, বিদেশি অপারেটরের নিয়ন্ত্রণে বন্দরের পরিচালনা সরাসরি স্থানীয় অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলে। ভারতের মুন্দ্রা ও শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বন্দরে বিদেশি অপারেশনের অধীন কনটেইনার চার্জ ২০–৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ব্যবসায়িক ব্যয় ও প্রতিযোগিতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্য দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে আর এই প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। তবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সমাধান শুধু বিদেশি অপারেটরের ওপর নির্ভর করে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন একটি সুসমন্বিত বহুমাত্রিক রোডম্যাপ; যেখানে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তির আধুনিকায়ন, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার একসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কাস্টমস প্রক্রিয়া, অপারেশনাল ব্যবস্থাপনা, শ্রমিক ব্যবস্থাপনা এবং পণ্য পরিবহন ও গুদামজাতকরণসহ সমগ্র লজিস্টিকস শৃঙ্খলকে আধুনিক ও কার্যকর করতে হবে একটি সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে।
চট্টগ্রাম বন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ নিয়ে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিদেশি অপারেটর নিয়োগ–সংক্রান্ত চুক্তির শর্তাবলি, সম্ভাব্য লাভ-ক্ষতি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মূল্যায়ন করা আবশ্যক। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া হতে হবে খোলামেলা, অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের ভিত্তিতে; যাতে দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সমভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। একই সঙ্গে এ রকম একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ ও আলোচনার ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
খ) মায়ানমারের রাখাইন সীমান্তে মানবিক সহায়তা চ্যানেল দেয়ার পরিকল্পনার ব্যপারে সরকার ও জাতিসংঘ যা বলছেঃ
অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রাহমান, গত ৮ই এপ্রিল ‘২৫ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন “আরাকানে যাতে শান্তি এবং স্থিতি দ্রুত ফিরে আসে…সেখানটাই অত্যন্ত কঠিন.. একটা মানবিক পরিস্থিতি যাচ্ছে। সেটা নিরসনের জন্য আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে, বিভিন্ন দেশের সাথে কাজ করছি এবং আমরা যত দ্রুত সম্ভব চেষ্টা করছি, সেখানকার মানবিক পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিরসন করতে পারি। সেজন্য দরকার হচ্ছে বিবদমান দুপক্ষের যুদ্ধের বিরতি। আমি আপনাদের বলতে পারি, আমাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে, মানবিক সহায়তা জাতিসংঘ যখন দেবে, যেটাতে আমরা সাহায্য করব, সেটাতে দুপক্ষই যুদ্ধাবস্থা পরিহার করবে।” এর মাধ্যমে একটা স্থিতির সূচনা হবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তটার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এবং খুব বেশি দেরি নেই সেটা, এবং সেই সময় থেকে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে একটা বাস্তব আলোচনা আমরা শুরু করতে পারব।” রাখাইনে মানবিক পরিস্থিতিতে যুক্ত হওয়াটা বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হিসাবে অভিহিত করে খলিলুর রহমান বলেন, “এই জায়গা থেকে আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি। আমি এটুকু বলতে পারি, আমাদের চেষ্টায় কোনো ঘাটতি থাকবে না। আমরা চেষ্টা করব, যাতে মানবিক সাহায্য প্রদান প্রক্রিয়াতে আরাকানে একটা স্থিতির অবস্থা আসে, শান্তির অবস্থা আসে এবং সেখান থেকে আরাকান তার নবসূচনা করতে পারে।” “সেটাই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে একটা বড় প্রয়োজনীয় বিষয়। তাদেরকে (রোহিঙ্গা শরণার্থী) আমরা একটা অনিরাপদ অবস্থায় ফেলে দিতে পারি না।”
গত ৭ ফেব্রুয়ারি ’২৫ তারিখ নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে আলোচনায় ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেল’ এর ব্যপারে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয় প্রথম আসার কথা তুলে ধরে খলিলুর রহমান বলেন, আরাকান আর্মি, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মিয়ানমার সরকার- সবার সঙ্গে আলোচনা করেই জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে গিয়েছিলেন তিনি। “তাকে আমরা বলেছি, রাখাইনে যে মানবিক সমস্যা, যে সংকট সেটা মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের বিকল্প নাই। সেই কাজটি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেই হবে।” মানবিক সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিকল্প না থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র চ্যানেল, যার মাধ্যমে এটা করা সম্ভব। কারণ, রাখাইনের উপকূল এখনও তাতমাদোর দখলে এবং অন্যান্য জায়গা দিয়ে সহজে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব নয়।”
মানবিক চ্যানেল তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মিকে জাতিসংঘই আলোচনায় বসাচ্ছে তথ্য দিয়ে খলিলুর রহমান বলেন, আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনায় জাতিসংঘকে মাঝামাঝি রাখা হয়েছে।
“এ কারণে যে, আমরা আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনে আবদ্ধ একটি রাষ্ট্র। আরাকান আর্মি বা ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান, তারা নন-স্টেট অ্যাক্টর, এ ধরনের কোনো চুক্তি বা আন্তর্জাতিক নর্মস তাদের জন্য বাধ্যবাধকতা নেই, কারণ তারা এর পক্ষ নয়। এজন্য তারা যাতে জবাবদিহির মধ্যে থাকে, এই আলোচনাটা যাতে চলে, সেজন্য আমরা জাতিসংঘকে মাঝামাঝিতে রেখেছি।”
“তারা (জাতিসংঘ) আমাদের দুপক্ষকে এক টেবিলে বসাচ্ছে। আমাদের মনে হয়, এটা সর্বোত্তম উপায় এই কারণে, আরাকানে যে মানবিক সাহায্যের কথা আমরা ভাবছি, এটা কিন্তু জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন একটি প্রক্রিয়া, জাতিসংঘ নেতৃত্ব দেবে। সুতরাং তাদের মাধ্যমে কথাবার্তাটা বলাই উত্তম। কারণ, তারা একটা নিরপেক্ষ পক্ষ।”
গত ২৭/০৪/২৫ তারিখ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘মানবিক প্যাসেজ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘আমি এটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এটাতে সম্মত। কারণ, মানবিক প্যাসেজ হবে। কিন্তু এটাতে আমাদের কিছু শর্ত আছে, সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা এটাতে অবশ্যই সহযোগিতা করব, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অবশ্যই।’
এর পর গত ২৯/০৪/২৫ তারিখ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ বা মানবিক করিডোর দেওয়া নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে সরকারের কোনো আলোচনা হয়নি।’ এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ যৌক্তিক ও পরিকাঠামোগত সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকবে।’
এমন প্রেক্ষাপটে গত ৩০শে এপ্রিল ‘২৫ তারিখ ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় থেকে দেওয়া এক বার্তায় আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায় জাতিসংঘ। এক বার্তায় ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আন্তঃসীমান্ত সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর অনুমোদন নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা জাতিসংঘের রয়েছে। এটা ছাড়া জাতিসংঘের সরাসরি সম্পৃক্ততা সীমিত।’ ‘জাতিসংঘ বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা কার্যক্রম এবং রাখাইনের বাজে পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ অব্যাহত রাখছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে বাংলাদেশ যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পেতে থাকে, সে লক্ষ্যে মানবিক সহযোগীদের নিয়ে কাজ অব্যাহত রাখবে জাতিসংঘ।’
আসুন এই মানবিক করিডোর কিংবা ত্রান চ্যানেল নিয়ে ভুরাজনীতিটা আসলে কি তা বোঝার চেষ্টা করিঃ
আমাদের রাঙ্গামাটি, বান্দরবনের এর একটি সশস্ত্র গ্রুপ হল কুকিচিন, ভারতের মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও মনিপুরেও কুকিচিনরা আছে, একই ভাবে মায়ানমারের চিন রাজ্যেও কুকিচিনরা আছে। এই পুরো জনগোষ্ঠী এখন স্বায়ত্বশাসন চাইছে। তাদের ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে সংঘাত আছে, যেমন কুকিচিনদের সাথে নাগাদের। মনিপুরে মেইতেইদের সংগেও কুকিচিনদের সংঘাত চলছে। এই কুকিচিনদেরকে সহায়তা করছে ভারত।
এদিকে মায়ানমারে সামরিক জান্তা সরকার এখন ক্ষমতায়, তাই এই জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সে দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সংগ্রাম করছে। সেই সূত্রেই মায়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি সেই দেশের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে রাখাইনন রাজ্য দখলে আছে। আরাকান আর্মি (যা মূলত মায়ানমারের সশস্ত্র এক্ট বিদ্রোহী গোষ্ঠী) বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্স তৈরী করে। এরপর আরাকান আর্মি কায়িন, শান, কাচিন, সাগাইং ও মাগওয়ে অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রন উত্তর রাখাইনের আরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন আরাকান আর্মির স্বায়ত্বশাসনের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হলে শুধু মায়ানমার নয়, পুরো দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এর বড় প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে আরাকান আর্মি স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবহার করছে।
মায়ানমারের জান্তা সরকার, রাখাইনে কুখ্যাত “ফোর ক্যাটস” কৌশল অবলম্বন করছে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে আরাকান আর্মির অধিকৃত অঞ্চলে খাদ্য, অর্থ, তথ্য ও জনসমর্থন বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। ভারত তার মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে রাখাইনে প্রতি বছর কয়েক শত কোটি টাকার পণ্য আদান প্রদান করছে। বাংলাদেশের রাখাইন সীমান্ত বানিজ্য পুনরায় শুরু হয়েছে, যার ফলে রাখাইনে ঔষধ ও খাদ্য সংকট অনেকটা প্রশমিত হয়েছে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের জন্য “সেফ জোন” তৈরীর প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন রোহিঙ্গা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। ২০২৪ সালে আরাকানে কিছু মুসলিম সশস্ত্র সংগঠন যেমন আর্সা, এআরএ, আরএসও, মায়ানমারের সামরিক জানন্তার পক্ষ নিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এদের অবস্থান এখনো আরাকান সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে অস্ত্র পাচার, মাদক ব্যবসা চালাচ্ছে।
বাংলাদেশ সেখানে একটা মানবিক চ্যানেল করার চিন্তা ভাবনা করলেও বাংলাদেশের সেনা প্রধান উক্ত চ্যানেল কে “ব্লাডি চ্যানেল” বলেছেন।
কেননা আরাকানে ভারতের ২.৫ কোটি বিলিয়নের ইনভেস্টমেন্ট আছে, কালাদান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট আছে। সেখানে ৩০০ কি মি রোড হচ্ছে, ভারতের একটি সমুদ্র বন্দর টার্মিনাল আরাকানে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। সেখানে আরাকান থেকে চীনের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত চীনের তেলের ও গ্যাসের পাইপ লাইন আছে, গভীর সমূদ্রে চীনের নৌ ফ্লিট আছে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রজেক্ট আছে।
তাই ভারত ও চীন আরাকানে বাংলাদেশের কোন করিডোর বা চ্যানেল চায়না। মার্কিনিদের ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কারণে তারা চীনকে ব্যবসায়ীক যায়গায় আটকাতে চায়। মার্কিনরা চায় বাংলাদেশকে চীনের বিরুদ্ধে দাড় করাতে।
গ) কাতারের ও তুরস্কের বিনিয়োগকারীদেরকে বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরির কারখানা স্থাপন করতে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশঃ
গত ২৩শে এপ্রিল ‘২৫ দোহায় প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরির কারখানা গড়ে তুলতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে কাতারকে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মূহাম্মদ ইউনূস কাতারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিনি কাতারি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল উৎসর্গ করার প্রস্তাব দিয়েছেন, যেখানে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরির কারখানাও স্থাপন করা যেতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, কাতারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ড. সাওদ বিন আবদুলরহমান আল থানির আমন্ত্রণে আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ও প্রীতিভোজে অংশ নেন তিনি। সেখানে তিনি কাতারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ সহজতর করার এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদানের প্রস্তুতির কথা জানান।
প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা ফৌজুল কবির খান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খালিলুর রহমান, বিডা নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এবং সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ।
বিডা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল সম্প্রতি তুরস্ক সফর করেন। সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল, তুরস্কের সঙ্গে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনে যৌথ সহযোগিতার পথ খুঁজে বের করা এবং বাংলাদেশে গোলাবারুদ ও সামরিক যান তৈরির একটি নতুন কারখানা স্থাপনের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা। এই সফরের অংশ হিসেবে প্রতিনিধি দলটি তুরস্কের শীর্ষ প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান মেকানিক্যাল অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন (MKE) পরিদর্শন করেন। বিডা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী প্রতিষ্ঠানটির তৈরি অস্ত্র, গোলাবারুদ, সামরিক যানবাহন এবং বিভিন্ন আধুনিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ঘুরে দেখেন।
সফরে উভয় দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে বাংলাদেশে নতুন গোলাবারুদ ও সমরযান তৈরির কারখানা স্থাপন, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং যৌথ শিল্প সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়। বিডা চেয়ারম্যান জানান, “আমরা তুর্কি বিশেষজ্ঞদের টেকনিক্যাল এক্সপার্টিজ গ্রহণ করে বাংলাদেশে নিজস্ব সামরিক কারখানা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা তাদেরকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনার একটি পূর্ণাঙ্গ ‘৩৬০ ডিগ্রি ভিউ’ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।”
প্রায় সাত দশক আগে আঙ্কারায় প্রতিষ্ঠিত MKE বর্তমানে তুরস্কের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শীর্ষ প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি অ্যাসল্ট রাইফেল, গোলাবারুদ, আর্টিলারি সিস্টেম, এরিয়াল বোমা, ল্যান্ডমাইন, বিস্ফোরক, হাউইথজার, আর্টিলারি রকেট এবং মিজাইল নির্মাণে বিশেষজ্ঞ। বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে তাদের অস্ত্র রপ্তানি করা হয়।
MKE-এর তৈরি ১০৫ মিলিমিটারের হাউইথজার আর্টিলারি সিস্টেম ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর বহরে যুক্ত রয়েছে। তুরস্ক বাংলাদেশে Bayraktar TB2 ড্রোন, MLRS সিস্টেম সরবরাহ করেছে, যা সামরিক শক্তির একটা নতুন স্তর যোগ করে।
ঘ) স্যাটেলাইটভিত্তিক বানিজ্যিক ইন্টারনেট পরিষেবা দেয়ার জন্য আমেরিকান কোম্পানি স্টার লিংক কে অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশঃ
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবার কোম্পানি স্টারলিংক বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সেবা শুরু করেছে ২০শে মে ’২৫ থেকে। প্রধান উপদেষ্টার প্রধান উপদেষ্টার ডাক টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, বাংলাদেশের গ্রাহকরা ২০শে মে ’২৫ মঙ্গলবার থেকেই স্টারলিংক ইন্টারনেট সংযোগের অর্ডার করতে পারবেন।
গত ৯ মার্চ ’২৫ ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানিয়ে ছিলেন, বাংলাদেশে ‘গ্রাউন্ড আর্থ স্টেশন’ স্থাপনের ব্যাপারে স্টারলিংকের হয়ে কয়েকটি স্থানীয় কোম্পানি কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে ভূমি বরাদ্দ, নির্মাণ সহায়তা ও অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের মত কার্যক্রম পরিচালনায় স্টারলিংকের সঙ্গে কয়েকটি সহযোগিতা চুক্তি করে সরকার।
বিনিয়োগ সম্মেলনের তৃতীয় দিন ৯ এপ্রিল সম্মেলনের ভেন্যু হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পরীক্ষামূলকভাবে স্টারলিংকের সেবা চালিয়ে দেখানো হয়। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক কাযক্রম শুরুর জন্য ২৮ এপ্রিল স্টারলিংকের লাইসেন্সে অনুমোদন দেন প্রধান উপদেষ্টা।
বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার জন্য ১০ বছর মেয়াদী দুটি লাইসেন্স পেয়েছে স্টারলিংক। এর একটি হচ্ছে ‘ননজিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট অরবিট অপারেটর লাইসেন্স’; অন্যটি ‘রেডিও কমিউনিকেশন অ্যাপারেটার্স লাইসেন্স’। লাইসেন্স পাওয়ার এক মাসের মধ্যে তারা বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করল। বাংলাদেশে ব্যবসা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদানকারী স্টারলিংক-কে অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা)।
ঙ) অগ্নি নিরাপত্তা প্রশিক্ষনের নামে কক্সবাজারে মার্কিন সৈন্য বাহিনীর উপস্থিতিঃ
আমেরিকান সেনাবাহিনী হঠাৎ করেই বাংলাদেশের কক্সবাজারে “অগ্নি নিরাপত্তা” প্রশিক্ষণের বিষয়টির অন্য কোন কারনও আছে বলে মনে হচ্ছে।
উপরোক্ত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় যদি একই সুতোয় বাধি তাহলে বোঝা যায় এই প্রত্যেকটা বিষয় একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং এর পেছনে বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্তে মার্কিন ছায়া যুদ্ধের প্রস্তুতি বা এই উপমহাদেশে মার্কিন আধিপত্যবাদী নয়া-সাম্রাজ্যবাদী নীল নকশা।
কারণ স্টারলিংক হলো মার্কিন আধুনিক স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট জোট, যা রাজনৈতিক বা সামরিক পর্যবেক্ষণের জন্য অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। এটি ইউক্রেনে ডিজিটাল যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রে পরিণত হয়েছে যা রাশিয়ার অনেক ক্ষতি করেছে। তাই বাংলাদেশে স্টার লিংককে অনুমোদন দেয়ার মাধ্যমে এই উপমহাদেশে মার্কিন মার্কিন প্রক্সি যুদ্ধেরই প্রস্তুতি বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে সামরিক শিল্পে যৌথ উদ্যোগ শুরু হয়েছে, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে অস্ত্র ও মেশিনারির উৎপাদন কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। তুরস্ক বাংলাদেশে Bayraktar TB2 ড্রোন, MLRS সিস্টেম সরবরাহ করেছে, যা সামরিক শক্তির একটা নতুন স্তর যোগ করে। বিনিয়োগ আমাদের প্রয়োজন। যদি সামরিক উৎপাদন সাধারণত আমাদের প্রতিরক্ষা স্বনির্ভরতা বাড়ানোর জন্য হয়ে থাকে বা উৎপাদনের পর তাদের দেশে নিয়ে যায় তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে এমন স্পর্শকাতর খাতে কারখানা স্থাপন একটা “মাল্টি-স্টেট ইনফ্লুয়েন্স অপারেশন” হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে এর বিপদ অনেক। বিশেষ করে তুরস্কের সাথে পাকিস্তান এবং চীন এই তিন দেশের একটি ভিন্ন সামরিক ব্লক তৈরি হচ্ছে বলে ধারণা আছে। এটা নিঃসন্দেহে সামরিক, অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা।
চীন মিয়ানমার হয়ে বঙ্গোপসাগরে করিডোর চায় (BCIM corridor বা CMEC) যার জন্য বাংলাদেশে রাখাইন অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ যদি চীনের এই করিডোর পরিকল্পনাকে থামিয়ে রাখে, তাহলে তা মার্কিন-বাংলাদেশ কৌশলগত ঐক্যের ইঙ্গিত হতে পারে। অর্থাৎ চীনের প্রভাব ঠেকাতে বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে এক প্রকার ব্লকের অংশ হতে চলেছে।
কক্সবাজারে আমেরিকান সেনাবাহিনী এসে প্রশিক্ষণের বিষয়টি “অগ্নি নিরাপত্তা” হলেও, বাস্তবিকভাবে এটি একটি সামরিক লজিস্টিক প্রস্তুতির সূচনা হতে পারে। কক্সবাজারের ভৌগোলিক অবস্থান, মিয়ানমার সীমান্ত, বঙ্গোপসাগর ও চীনা-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক কৌশলগত স্থান। মার্কিন সেনাবাহিনী যদি সরাসরি বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে, তা ছায়া যুদ্ধের কাঠামো তৈরির সম্ভাবনা বাড়ায়।
এতসব ঘটনাকে একত্রে বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে একধরনের ছায়া যুদ্ধের প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই গোপনে শুরু হয়ে গেছে। সেই লক্ষ্যে মার্কিনিদের পক্ষ থেকে ভূ-রাজনৈতিক ঘুঁটি চালানো, সামরিক প্রভাব তৈরি, এবং তথ্য-নজরদারি কাঠামো গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় চলছে বলেই মনে হচ্ছে।
(লেখকঃ সিপিবি চট্টগ্রাম জেলা নেতা)