চলমান সংবাদ

জেলায় জেলায় ডেঙ্গুর আতঙ্ক, হটস্পটে বরগুনা ও দাউদকান্দি

-স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতায় বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা


বাংলাদেশে এবার রাজধানী ঢাকার গণ্ডি পেরিয়ে জেলাগুলোতেও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। এ পর্যন্ত দেশের ৫৮টি জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পূর্ব সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৬৬ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৩০ জন। সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে বরগুনা জেলায়, যেখানে এক হাজার ৮৩২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৫ জন। বরিশাল জেলায় আক্রান্ত ৫৭৫ জন, কুমিল্লায় ২০৪ জন, পটুয়াখালীতে ৩৭৯ জন এবং চট্টগ্রামে ৩১২ জন আক্রান্ত হয়েছেন।

বরগুনা: ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বরগুনাকে এ বছর ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি জরিপে দেখা গেছে, বরগুনায় এডিস মশার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি, যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। এখানে সুপেয় পানির সংকট থাকায় মানুষ প্ল্যাস্টিকের ড্রাম বা মটকায় পানি সংরক্ষণ করেন, যেগুলো এডিস মশার প্রজননের আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে।

বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আব্দুল ফাত্তাহ বলেন, “আমাদের ২৫০ বেডের হাসপাতালে চার গুণ রোগী ভর্তি আছে। রোগীর সাথে আসা স্বজনরাও আক্রান্ত হচ্ছেন, যা ডেঙ্গু ছড়ানোর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

তিনটি সংস্থা—আইইডিসিআর, সিডিসি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়—এখানে জরিপ চালিয়ে পানি জমিয়ে রাখাকেই প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এখানকার হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা না থাকায় গুরুতর রোগীদের বরিশালে পাঠাতে হচ্ছে।

দাউদকান্দি: একটি উপজেলার রোগী ৭০০ ছাড়িয়েছে

কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা এখন রীতিমতো রেডজোন। শুধু এই একটি উপজেলাতেই জানুয়ারি থেকে আক্রান্ত হয়েছেন ৭০০ জনের বেশি। স্থানীয় পৌরসভার ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডকে হটস্পট ঘোষণা করা হয়েছে। এখানেও রোগী ভর্তি নিয়ে সংকট চরমে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, “৫০ বেডের হাসপাতাল রোগীতে পরিপূর্ণ। বেড না পেয়ে অনেককে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।” তাঁর মতে, পৌর এলাকায় জমে থাকা পানির পাশাপাশি ঢাকা থেকে যাতায়াতকারী মানুষরাও ভাইরাস বহনে ভূমিকা রাখছেন।

ঢাকার বাইরেও বিপদের আশঙ্কা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২৪৪ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৩৮ জন, বরগুনা জেলাতেই ৮২ জন। মোট আক্রান্তের ৮৩ শতাংশই দেশের ১১টি জেলায়।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর তীব্রতা বাড়তে থাকবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে দ্রুত জেলা পর্যায়ের প্রস্তুতি বাড়াতে হবে।”

অতীতের সতর্কতা ছিল, বাস্তবায়ন হয়নি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, “গত বছরই বরিশাল, বরগুনা, কক্সবাজারে ডেঙ্গুর বিস্তারের আশঙ্কা জানিয়ে আমরা সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।”

কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, “২০১৯ সালের মহামারির পর এডিস মশা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কার্যকর কোনো সমন্বিত উদ্যোগ আজও নেই।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

উপসংহার

দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন আর শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়। জেলার পর জেলা আক্রান্ত হচ্ছে, আর স্থানীয় হাসপাতালগুলো চিকিৎসা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনা পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।