চা শ্রমিকদের ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলন: দুঃসহ জীবনের এক অনবদ্য দলিল -ফজলুল কবির মিন্টু
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চা বাগানগুলোতে কর্মরত চা শ্রমিকদের জীবনযাপন কখনোই সহজ ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসনামলে তাঁদের জীবন আরও করুণ ও নির্দয় শোষণের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে চা শ্রমিকদের যে আন্দোলনটি ইতিহাসে অনন্য হয়ে আছে, তা হলো “মুল্লুক চলো” আন্দোলন। এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯২১ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১০৪ বছর আগে। এটি ছিল উপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের ও তাঁদের সহযোদ্ধা জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
ব্রিটিশরা ১৮৫০-এর দশক থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের দরিদ্র মানুষদের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসে সিলেট ও আশেপাশের চা-বাগানগুলোতে। এরা অধিকাংশই ছিল বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের মানুষ। ‘চুক্তি’ নামের এক প্রহসনের মাধ্যমে তাঁদের চা বাগানে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। বাস্তবে এটি ছিল এক প্রকার দাসত্ব। শ্রমিকদের বাড়ি ফেরা নিষিদ্ধ ছিল, পারিশ্রমিক ছিল অতি নগণ্য, বসবাসের পরিবেশ ছিল অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ। চিকিৎসা ও শিক্ষার কোনও সুব্যবস্থা ছিল না।
এই অবস্থারই চূড়ান্ত প্রতিবাদ ছিল ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলন — যার মানে, “চলো, নিজ দেশে ফিরে যাই”। ১৯২১ সালে হাজার হাজার চা শ্রমিক একত্রিত হয়ে সিলেট থেকে পায়ে হেঁটে তাঁদের জন্মভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। এই আন্দোলন ছিল নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা এবং স্বাধীনতার প্রতীক।
দুঃসহ জীবনের চিত্র
চা শ্রমিকদের জীবনের প্রতিটি স্তরে ছিল নিরবচ্ছিন্ন কষ্টের চিহ্ন। তাঁরা দিনভর কষ্টকর শ্রম দিতেন, অথচ জীবিকা নির্বাহ করার মতো পর্যাপ্ত মজুরি পেতেন না। জমিদার, বাগান মালিক ও ব্রিটিশ সাহেবদের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নারী শ্রমিকরা যৌন নিপীড়নের শিকার হতেন প্রায়শই। স্বাস্থ্যসেবা, শিশুশিক্ষা, পুষ্টি— কোনও কিছুই তাঁদের ভাগ্যে জোটেনি। এই পরিস্থিতি আজও পুরোপুরি দূর হয়নি।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
আজও বাংলাদেশের বিভিন্ন চা বাগানে প্রায় ১ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন। তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার হার কম, বাসস্থান অনুন্নত, আর দৈনিক মজুরি যথেষ্ট নয় বলে বারবার তাঁরা আন্দোলনে নামেন। ২০২২ সালেও তাঁরা ন্যায্য মজুরির দাবিতে আন্দোলন করেছেন।
উপসংহার
‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলন কেবল একটি শ্রমিক বিদ্রোহ নয়, এটি ছিল এক স্বাধীনতার ডাক, এক মানবিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম। চা শ্রমিকদের দুঃসহ জীবনের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, স্বাধীনতার আসল মানে কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়; সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতাও জরুরি। এই ইতিহাসকে জানতে ও লালন করতে হবে, যেন ভবিষ্যতের প্রজন্ম শোষণের শিকল ভেঙে সামনে এগিয়ে যেতে পারে।
(লেখকঃ টিইউসি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক)