চলমান সংবাদ

বাংলাদেশে নারী নির্যাতন: কক্সবাজার থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান সহিংসতা

বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি কক্সবাজার ও মুন্সিগঞ্জে ঘটে যাওয়া দুইটি ঘটনা এ চিত্রকে আরও স্পষ্ট করেছে। দুই ঘটনার মাঝখানে সময় ও স্থানগত পার্থক্য থাকলেও নিপীড়নের ধরন, প্রশাসনের ভূমিকা এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া প্রায় অভিন্ন।

মুন্সিগঞ্জে দুই তরুণীকে প্রকাশ্যে বেল্ট দিয়ে পেটানো

গত শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার দিকে মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাটে দুই তরুণীকে প্রকাশ্যে বেল্ট দিয়ে মারধরের ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। ঘটনার ভিডিওতে দেখা যায়, নেহাল আহমেদ ওরফে জিহাদ নামে এক তরুণ দুই নারীকে মারধর করছেন, আশেপাশে আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন—কেউ ভিডিও করছিলেন, কেউ আবার উৎসাহ দিচ্ছিলেন।

প্রাথমিকভাবে পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর নৌ পুলিশ নিজেরা বাদী হয়ে মামলা করে এবং নেহালকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। তবে মামলায় উল্লেখ করা ২৫ জন আসামির মধ্যে এখনো কেবল একজনই আটক হয়েছেন।

নৌ পুলিশ জানায়, ভিডিও ফুটেজে বাকিদের চেহারা থাকলেও তাদের শনাক্ত করতে সময় লাগবে। এ বিষয়ে নৌ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ইমরান আহমেদ বলেন, “আমরা ভিডিও দেখে শনাক্তের চেষ্টা করছি। ভুক্তভোগী দুই তরুণীর সঙ্গে এখনো কথা হয়নি, তবে তাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছে।”

কক্সবাজারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি

এর আগে ২০২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দুই নারীকে পোশাকের অজুহাতে একদল যুবক মারধর করে। ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও বাকিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

চলমান সহিংসতার তালিকা দীর্ঘ

সাম্প্রতিক সময়ে কুড়িগ্রাম, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা, এবং লক্ষ্মীপুরেও নারী নির্যাতনের একাধিক ঘটনা ঘটে। কোথাও নারীর চুল কেটে দেওয়া হয়েছে, কোথাও প্রকাশ্যে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। অধিকাংশ ঘটনার পর পরই ভিডিও ভাইরাল না হলে আইনি প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি।

প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও সামাজিক উদাসীনতা

এ ধরনের ঘটনার পরপরই প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া আসে ‘ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে’। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, “ভুক্তভোগী মামলা না করলে তারা ব্যবস্থা নিতে পারেন না”। বিশ্লেষকদের মতে, এটি দায়িত্ব এড়ানোর একটি কৌশল মাত্র।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, “একটি গোষ্ঠী নারীর স্বাধীন চলাফেরা চায় না। তারা রাস্তা, বাজার এমনকি ভিড়েও নারীর ওপর আক্রমণ করছে। আশ্চর্যের বিষয়, পুলিশ অনেক সময় পাশে থাকলেও ব্যবস্থা নেয় না।”

নারীবিদ্বেষের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, “সরকারি ও প্রশাসনিক কাঠামোর একাংশ এখনো নারীদের ঘরে রাখতে চায়। এমনকি হেনস্তাকারীদের জামিন দিয়ে সামাজিকভাবে পুরস্কৃতও করা হয়।”

তিনি আরও বলেন, “এখন পুলিশ অনেক সময় ইচ্ছা করেই নীরব থাকে, কারণ তারা চায় না এসব ঘটনা প্রকাশ পাক। কিন্তু যখন ভিডিও ভাইরাল হয়, তখন উপরের নির্দেশে লোক দেখানো ব্যবস্থা নেয়া হয়।”

পরিসংখ্যান যা আতঙ্কের

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) জানায়, শুধু এপ্রিল মাসেই ৩৬২টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৯৩টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ২৫টি এবং ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যাকাণ্ড ৪টি।

উপসংহার

নারীর প্রতি সহিংসতা এখন কেবল একটি আইনি সমস্যা নয়, বরং এটি একটি সামাজিক সংকট। যখন অপরাধীরা প্রকাশ্যে নারীদের মারধর করে এবং পুলিশ পাশে থেকেও কিছু করে না, তখন পুরো সমাজের দায়িত্ববোধ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শুধুমাত্র নারীরা নয়—সমাজের সব শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে নারী নিপীড়নের এ প্রবণতা শুধু বাড়বে।