ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল থেকে আজকের বাংলাদেশি নার্স: সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও মর্যাদার লড়াই -ফজলুল কবির মিন্টু
আজ ১২ই মে, আন্তর্জাতিক নার্স দিবস। এদিন বিশ্বব্যাপী স্মরণ করা হয় আধুনিক নার্সিংয়ের অগ্রদূত ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে—যাঁর আত্মনিবেদন, সেবা ও আদর্শ বিশ্বজুড়ে নার্সদের জন্য এক প্রেরণার নাম। তাঁর দেখানো পথ ধরেই নার্সিং আজ একটি মহৎ পেশায় রূপ নিয়েছে। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই মহান পেশাটি আজও অবমূল্যায়ন, অবহেলা ও নানাবিধ নিরাপত্তাহীনতায় জর্জরিত।
নার্স মানেই শুধু সেবিকা নয়, তাঁরা মানবতার প্রহরী
বাংলাদেশের নার্সরা শুধু হাসপাতালের ‘সিস্টার’ বা চিকিৎসকের সহকারী নন—তাঁরা রোগীর পাশে থেকে মৃত্যু ও জীবনের সীমান্তে সেবা দেওয়া এক একজন মানবিক যোদ্ধা। সহানুভূতি, নিষ্ঠা ও পেশাগত দক্ষতার মাধ্যমে তাঁরা স্বাস্থ্যব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আজও নার্সদের মর্যাদা সংকুচিত ও হেয়প্রতিপন্ন।
কর্মক্ষেত্রে চাপ ও সংকট: পরিসংখ্যানই বলে বাস্তবতা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশে ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, ১ লাখ ৩৬ হাজার চিকিৎসকের বিপরীতে রেজিস্টার্ড নার্স আছেন মাত্র ৯৫ হাজার ১৬৮ জন। অর্থাৎ দেশে আরও প্রায় ৩ লাখ নার্সের ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে বিদ্যমান নার্সদের উপর পড়ে যাচ্ছে অমানবিক কাজের চাপ—যা তাদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
বেতন ও ওভারটাইম: শ্রম আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ এবং অতিরিক্ত ২ ঘণ্টা ওভারটাইম নির্ধারিত। কিন্তু বাস্তবে অনেক নার্সকেই ১২ ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় কাজ করতে হয়, কোনো অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা ছাড়াই। নিম্ন বেতন এবং সীমিত সুযোগের কারণে অনেককে একাধিক শিফটে কিংবা একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হয়—যা এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শোষণের নামান্তর।
যৌন হয়রানি: এক প্রচ্ছন্ন আতঙ্ক
নার্সদের বড় একটি অংশ নারী হওয়ায় তারা কর্মক্ষেত্রে প্রায়ই যৌন হয়রানির শিকার হন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিংবা সহকর্মীদের দ্বারা মানসিক ও শারীরিক হয়রানির অভিযোগ বহু প্রতিষ্ঠানে উঠে এসেছে। অথচ শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ৩৩২ এবং শ্রম বিধিমালার ৩৬১ক অনুযায়ী, এ ধরনের হয়রানি রোধে মালিকপক্ষ ও সরকারের নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। বাস্তবে এসব নিয়ম-কানুন কেবল কাগজে কলমে রয়ে গেছে।
সনদহীন অভিজ্ঞ নার্সদের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত
৮০ ও ৯০ দশকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে যাঁরা সেবা দিয়েছেন, সেই অভিজ্ঞ নার্সরা আজ চাকরি হারানোর আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন, শুধুমাত্র স্বীকৃত সনদ না থাকার কারণে। এই অবস্থা শুধু তাদের জীবনের প্রতি অবিচার নয়, বরং দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানবসম্পদের অপচয়।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে গুণগত ঘাটতি
বিগত এক দশকে নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে ঠিকই, তবে গুণগত মানে তেমন উন্নয়ন হয়নি। আধুনিক কারিকুলাম, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত ইন্টার্নশিপ না থাকায় পেশাগত দক্ষতা অর্জন ব্যাহত হচ্ছে।
নার্সদের মর্যাদা ও সুরক্ষায় যা করতে হবে
নার্সদের অধিকার, মর্যাদা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই একটি সুসংগঠিত নীতিগত রূপরেখা:
- উপযুক্ত বেতন ও ওভারটাইম সুবিধা নিশ্চিত করা
- কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
- সনদহীন অভিজ্ঞ নার্সদের চাকরির নিশ্চয়তা দেওয়া
- মানসম্পন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা
- নিরাপদ, সম্মানজনক কর্মপরিবেশ সৃষ্টি
- শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মঘণ্টা বাস্তবায়ন
- পেশাগত স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
উপসংহার: ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের আদর্শে নতুন পথচলা
আন্তর্জাতিক নার্স দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিক দিবস নয়—এটি হওয়া উচিত নার্সদের অধিকার ও মর্যাদার দাবিতে কণ্ঠ তুলে ধরার দিন। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ছিলেন এক কিংবদন্তি, যাঁর জীবন ও সংগ্রাম থেকে বাংলাদেশের নার্সদের শিখতে হবে কিভাবে নিজেকে শিক্ষিত, সংগঠিত এবং সচেতন করে পেশার মর্যাদা রক্ষা করতে হয়। নার্সদের নিরাপত্তা, সম্মান এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করলেই সমাজে মানবতার ভিত্তি আরও মজবুত হবে।
(লেখকঃ বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক এবং বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক)