আন্তর্জাতিক মা দিবস ও বাংলাদেশে মা শ্রমিকদের বাস্তবতা: সুরক্ষা, বৈষম্য ও করণীয় -ফজলুল কবির মিন্টু-

সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি
আন্তর্জাতিক মা দিবস বিশ্বব্যাপী মা এবং মাতৃত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। তবে এই দিনে শুধু আবেগ আর ফুলের উপহার নয়, দরকার বাস্তবতা ও অধিকার নিয়ে আলোচনার। বিশেষ করে বাংলাদেশে, যেখানে লাখ লাখ নারী শ্রমিক বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন—তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ মা, যাঁরা দৈনিক জীবনে অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। এই প্রবন্ধে আমরা মা শ্রমিকদের বাস্তবতা, শ্রম আইনে সুরক্ষা, সরকারি ও বেসরকারি খাতের বৈষম্য, ঘাটতি এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর করণীয় নিয়ে আলোচনা করবো।
মা শ্রমিকদের জীবনের বাস্তব চিত্র
বাংলাদেশে পোশাক খাত, কৃষি, নির্মাণ, গৃহকর্ম, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, গার্মেন্টস, হকার ইত্যাদি খাতে কাজ করা বহু নারী শ্রমিক মা হিসেবে দ্বৈত দায়িত্ব পালন করছেন—একদিকে কর্মজীবনের চাপ, অন্যদিকে সন্তানের দায়িত্ব। শহরের বস্তি বা গ্রামাঞ্চলের খণ্ডকালীন কাজে নিযুক্ত এ নারীরা মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা, ছুটি, শিশুর দেখাশোনা বা আর্থিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হন।
অনেক মা শ্রমিককে সন্তানকে বাসায় রেখে দীর্ঘ সময় কর্মস্থলে কাটাতে হয়। শিশুর দেখাশোনার দায়িত্ব না থাকায় সন্তান উপেক্ষিত থেকে বেড়ে ওঠে। একদিকে দারিদ্র্য, অন্যদিকে কর্মস্থলে সহানুভূতির অভাব—এই দুইয়ে মা শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ।
সরকারি বনাম বেসরকারি নারী শ্রমিক: এক অসম প্রতিচ্ছবি
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবী নারী ও বেসরকারি শ্রমজীবী নারীদের মধ্যে একটি স্পষ্ট বৈষম্য বিদ্যমান। এটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে মাতৃত্বকালীন সুবিধা, কর্মপরিবেশ ও চাকরি সুরক্ষায়।
সরকারি চাকরিজীবী নারীরা যেসব সুবিধা পান:
- ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি (সম্পূর্ণ বেতনসহ)
- চাকরির নিশ্চয়তা
- চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা
- শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র (Day Care) সরকারি অফিসে অনেক জায়গায় বিদ্যমান
- স্থায়ী পদ ও পদোন্নতির সুযোগ
বেসরকারি নারী শ্রমিকদের বাস্তবতা:
- শুধুমাত্র ১৬ সপ্তাহ মাতৃত্বকালীন ছুটি, সেটিও অনেকক্ষেত্রে বেতন ছাড়াই
- চাকরি হারানোর ভয় গর্ভাবস্থায় বা ছুটির আবেদনের সময়
- শিশুর দেখাশোনার কোনো ব্যবস্থা নেই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে
- প্রচণ্ড শ্রমচাপ ও সহানুভূতির অভাব
এই বৈষম্য কেবল সামাজিক নয়, এটি একটি কাঠামোগত বৈষম্য—যা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ এবং তদারকির ঘাটতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইনে মা শ্রমিকদের অধিকার
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮)-এ নারী শ্রমিকদের জন্য কিছু মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত:
- মাতৃত্বকালীন ছুটি: মোট ১৬ সপ্তাহ (৮ সপ্তাহ পূর্বে, ৮ সপ্তাহ পরে), বেতনসহ।
- নার্সারি বাধ্যতামূলক: যেখানে ৪০ বা ততোধিক নারী কাজ করেন, সেখানে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকতে হবে।
- চাকরি নিরাপত্তা: গর্ভবতী নারীকে ছাঁটাই করা অবৈধ।
তবে এই সুবিধাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ। কারখানা মালিকরা আইনকে উপেক্ষা করে চলেন, কারণ সরকারিভাবে পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োগ কার্যকর নয়।
আইনি ও নীতিগত ঘাটতি
- বেসরকারি খাতে আইনের প্রয়োগ দুর্বল: পরিদর্শক নিয়োগ ও নিয়মিত তদারকির অভাব।
- অনানুষ্ঠানিক খাতের নারী শ্রমিকরা আইনের আওতার বাইরে: গৃহকর্মী, হকার, খণ্ডকালীন কাজ ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের কোনো সুরক্ষা নেই।
- সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ নেই: সরকারি খাতে যেসব সুবিধা রয়েছে, তা বেসরকারি খাতে নেই কেন, সে বিষয়ে কোনো নীতিগত আলোচনা দেখা যায় না।
- শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের অভাব: বেসরকারি খাত বিশেষত গার্মেন্টস কারখানায় শিশুর দেখাশোনার সুযোগ অপ্রতুল বা অকার্যকর।
করণীয়: সমাধানের পথ কী?
সরকারের করণীয়:
- শ্রম আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন ও তদারকি বাড়ানো
- সরকারি ও বেসরকারি খাতে মাতৃত্বকালীন সুবিধার সমতা আনা
- অনানুষ্ঠানিক খাতে নারী শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করতে পৃথক সুরক্ষা নীতি গ্রহণ
- প্রতিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনে বাধ্য করা
বেসরকারি মালিকপক্ষের করণীয়:
- শ্রমিকদের গর্ভাবস্থা ও মাতৃত্বকালীন সময়ে মানবিক আচরণ নিশ্চিত করা
- মাতৃত্বকালীন ছুটি ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা
- কর্মস্থলে ডে-কেয়ার চালু করে নারী শ্রমিকদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা
ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠনের করণীয়:
- মা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার
- আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা ও মামলা পরিচালনায় ভূমিকা রাখা
- নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
উপসংহার
আন্তর্জাতিক মা দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি মা শ্রমিকদের মর্যাদা, অধিকার ও জীবনের মানোন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করার সময়। সরকারি চাকরিজীবী নারী ও বেসরকারি মা শ্রমিকদের মধ্যে যে স্পষ্ট বৈষম্য রয়েছে, তা রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতির প্রতিফলন। এই বৈষম্য দূর করতে হলে দরকার সমতা-ভিত্তিক আইন, কার্যকর তদারকি এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
একজন মা যখন সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে শ্রম দিচ্ছেন, তখন সমাজের দায়িত্ব তার পেছনে দাঁড়ানো। সরকার, মালিকপক্ষ এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো যদি একসঙ্গে কাজ করে, তবে বাংলাদেশে মা শ্রমিকদের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ ও সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
(লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি)
