শিরকের অভিযোগে শতবর্ষী বটগাছ কাটা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে আবারও আলোচনায় বাংলাদেশ
মাদারীপুর:
মাদারীপুরের শিড়খাড়া ইউনিয়নে শতবর্ষী একটি বটগাছ ‘শিরক ও বিদআত’-এর অভিযোগে কেটে ফেলার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, একদল ব্যক্তি ‘মুসল্লি’ পরিচয়ে বিশাল বটগাছটি করাত দিয়ে কেটে ফেলছে। তবে মূল গাছ পুরোপুরি কাটা শেষ হওয়ার আগেই স্থানীয় প্রশাসন হস্তক্ষেপ করে তা বন্ধ করে দেয়।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াদিয়া শাবাব জানান, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে এবং যদি কোনো অতিরিক্ত উদ্দেশ্য পাওয়া যায়, তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কালাম আজাদ জানান, “গাছটি অনেক পুরনো। এর ছায়ায় অনেকে বিশ্রাম নিতেন, কেউ কেউ মানত করতেন বা শিন্নি দিতেন। আগে কখনো সমস্যা হয়নি। এবার একদল ব্যক্তি এটিকে ‘শিরক’ বলেই কেটে ফেলতে আসে।”
তবে এলাকার কয়েকজন মনে করছেন, বিষয়টি শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে নয়—গাছটি বিক্রির উদ্দেশ্যে গাছের মালিককে চাপ দিতেই ধর্মীয় ইস্যু সামনে আনা হয়েছে।
ধারাবাহিক ধর্মীয় ঘটনাবলি
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে একটি পাঠাগার থেকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে পাঁচ বস্তা বই সরিয়ে নেওয়া হয়। সেগুলোর মধ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জাফর ইকবালের লেখা বইও।
এরপর কুড়িগ্রামে একটি কলেজের নারী শিক্ষককে পর্দা নিয়ে ফেসবুক পোস্টের জেরে ‘তৌহিদী জনতা’ সালিশ করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে এবং সেই ভিডিও ফেসবুকে লাইভ করে।
দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া, কিছু মাজারে হামলা চালানোর ঘটনাও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম খাদেমুল হক বলেন, “এগুলো ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার উদাহরণ। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর এই গোষ্ঠীগুলো আরও প্রকাশ্যে এসেছে। তাদের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়াও উদ্বেগজনক।”
অন্যদিকে ইসলামবিষয়ক বিশ্লেষক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, “এটি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নয়, বরং ‘অতি অধিকারবোধ’ ও তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যার সমাধান করার এক প্রবণতা।”
তিনি বলেন, “তৌহিদী জনতা হোক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অংশ—সবখানেই এখন নিজের মতো করে সমাধান করতে চাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটি রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট থেকে উৎসাহ পেয়েছে।”
সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
বিগত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে ধর্মীয় অনুভূতিকে ঘিরে নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মত বিশ্লেষকদের। নিউইয়র্ক টাইমসের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে কট্টরপন্থীদের জন্য ‘উন্মুক্ত পরিবেশ’ সৃষ্টি হয়েছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
তবে সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, ধর্মীয় উগ্রবাদের যেকোনো চেষ্টা কঠোরভাবে দমন করা হবে।
তবুও একের পর এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি এই প্রশ্নই তোলে—ধর্মের নামে ঘটা ঘটনাগুলোর পেছনে আদৌ ধর্ম, না কি অন্য উদ্দেশ্য? এবং এসব প্রতিহত করতে রাষ্ট্র কতটা প্রস্তুত?