মতামত

মে-দিবসের ভাবনা

-মোঃ মহিবুল ইসলাম

কোনো সন্দেহ নেই যে, শ্রমিকদের ঘামের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে সভ্যতা। তাই দুনিয়ার সকল শ্রমজীবীদের প্রতি স্যালুট জানাতেই হয় যদিও দুর্বৃত্তায়িত শ্রমিক রাজনীতির এই দেশে ‘মে দিবস’ পালন নিছক ফ্যাশন ছাড়া কিছুই নয়! শ্রমিকদের ওপর নির্মম নির্যাতনের সেই ইতিহাস পড়লে আজও চোখে পানি আসে এবং মনের ভেতরে প্রতিবাদের লেলিহান শিখা প্রজ্বলিত হয়; শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু এই দেশে সাম্প্রতিককালে চোখের সামনে দেখছি শ্রমিক রাজনীতির ভেলায় ভেসে শ্রমিক-কল্যাণের নামে কিছু শ্রমিকনেতা /সিবিএ নেতা আঙ্গুল ফোলে কলাগাছ হচ্ছে! সাধারণ শ্রমিক আর শ্রমিক রাজনীতিকে ব্যবহার করে কিছু রাজনীতিক একের পর এক সিঁড়ি ডিঙ্গাচ্ছে। সাধারণ শ্রমিক বা কর্মচারীদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে কতিপয় শ্রমিকনেতা বা সিবিএ নেতাদের লুটেপুটে খাবার বিষয়টি এখন আর অপেন-সিক্রেট নয় বরং একেবারেই অপেন। নেতা বা নেতার কিছু চ্যালা-চামুন্ডা ছাড়া অধিকাংশ সাধারণ শ্রমিক/কর্মচারীদের ভাগ্যের তেমন কোন পরিবর্তন হচ্ছে না!
শ্রমিক/কর্মচারীদের স্বার্থের নাম করে নেতা-পতিনেতাদের আঙ্গুল ফোলে কলাগাছ হওয়ার এই সংস্কৃতি মে দিবসের চেতনার শতভাগ পরিপন্থী। সাধারণ শ্রমিক/কর্মচারীরা যতদ্রুত এই সত্য উপলব্ধি করবেন তত দ্রুতই শ্রমিক রাজনীতির ভাগ্যাকাশ থেকে কালো মেঘ বিদূরিত হবে। নচেৎ শ্রমিক রাজনীতির এই বাংলাদেশী স্টাইল সত্যিকার অর্থে শ্রমিক ভাইদের কোনো কাজেই আসবে না।
ন্যায়সঙ্গত সার্থরক্ষাসহ ৮ঘন্টার অতিরিক্ত কাজের জুলুম থেকে শ্রমিক কর্মচারীদের মুক্তির মহান চেতনা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু আজ ৮ঘন্টা দূরের কথা, কাজ না-করেই কিভাবে কেবল সুবিধা হাতিয়ে নেয়া যায় সেই ফন্দি-ফিকিরেই বেশি ব্যস্ত হতে দেখা যায় শ্রমিক রাজনীতির সাথে যুক্তদের। সরকারি অফিসের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি– সেখানে ৮ঘন্টা দূরের কথা ২ঘন্টা কাজ করতেও সিবিএ-এর সঙ্গে যুক্তদের আগ্রহ দেখা যায় না!! কাজ না করে ষোল আনা সুবিধা আদায়ই যেন তাদের ভিশন আর মিশন! আফসোস!! নৈতিকতার এই স্খলনের কারণে সিবিএ এবং শ্রমিক রাজনীতির সাথে যুক্তদের দুর্নীতির খবর সবার মুখে মুখে। অর্থাৎ মে দিবসের চেতনার পুরো উল্টো চেতনায় আজ ভাসছে বাংলাদেশের শ্রমিক ও কর্মচারীদের রাজনীতি।
তাছাড়া, বর্তমানে এদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যিনি সত্যিকার অর্থেই শ্রমিক নন্– তিনিই শ্রমিক সংগঠনের প্রধান পৃষ্টপোষক অথবা উপদেষ্টা; আর তার অঙ্গুলি-হেলনেই শ্রমিক সংগঠন, এমনকি শ্রমিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। এসব বন্ধ না হলে স্বাধীন ও কল্যাণমুখী শ্রমিক রাজনীতি আর কোনদিন মাথা ছাড়া দিতে পারবে না।
তাই বলা যায়—মে দিবসের চেতনা হারিয়ে গেছে দুর্বৃত্তায়িত শ্রমিক রাজনীতির ভাগাড়ে! রয়ে গেছে শুধু উপরের খোলসটা৷ শ্রমিক নেতারা সাধারণ খেটেখাওয়া শ্রমিকদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার ধরে, বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে যায়; ক্ষমতা কেন্দ্রের উচ্চ আসনে নিজেদের অবস্থান গড়ে নেয়। এমনকি নিজেদের আখের গোছাতে প্রয়োজনে ক্ষমতাসীনদের ক্রীড়নক হিসাবেও কাজ করে। ফলে সাধারণ শ্রমিকরা বঞ্চিতই থেকে যায়; ভাগ্য খোলে শুধুই নেতাদের ও নেতাদের চ্যালাদের!
কাজেই বাণী-বাগাড়ম্বর ছাড়া মে দিবসের আলাদা কোন তাৎপর্য আজ আর অবশিষ্ট নেই এদেশে! তাই ঘটা করে মে দিবস পালন প্রহসনেরই নামান্তর এবং চেতনার শিকড় থেকে ক্রমশ পলায়নপর। বস্তুত: এদেশে মে দিবস এখন নিছক আনুষ্টানিকতা। তাই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও বলতেই হয়— দুর্বৃত্তায়িত শ্রমিক রাজনীতির এই দেশে ‘মে দিবস’ পালন নিছক ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি, ডাকসুর সাবেক ভিপি শ্রমিক রাজনীতির সাথে দীর্ঘদিন যিনি যুক্ত জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। কয়েক বছর আগে তিঁনি তার দীর্ঘ এক লেখার একটি পর্যায়ে বলেছিলেন—
“মে দিবস পালনের ক্ষেত্রে বাধা দূর হয়ে এ দিনটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে ঠিকই এবং মে দিবস খুব জাঁকজমকের সাথে উদযাপনও হয় কিন্তু বাস্তব সত্য হলো—মে দিবসে আজকাল হৈচৈ ও আড়ম্বর এবং ঢাক-ঢোল ও প্রদর্শনবাদী নানা আয়োজন থাকলেও ম্লান হয়ে গেছে মে দিবসের সংগ্রামী মেজাজ ও আন্তর্জাতিক সংহতিবোধ তথা এর মূল স্পিরিট।”