শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা: ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস এবং ন্যায্য মজুরীর বাস্তবতা -ফজলুল কবির মিন্টু

সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি
১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস—একটি ঐতিহাসিক দিন, যা বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অধিকার, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতীক। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ‘হে মার্কেট’ চত্বরে শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন করে। সেই সময় পুলিশ হামলায় প্রাণ হারান অনেক শ্রমিক। এই ঘটনাই পরবর্তীতে ১ মে-কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পথ সুগম করে। ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালন শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের ধারণা প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান বাস্তবতা
১৮৮৬ সালের আন্দোলন শুধু একটি সময়ের প্রতিবাদ ছিল না, এটি ছিল শ্রমিকদের মানবিক জীবনযাপনের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। সে সময় শ্রমিকরা দৈনিক ১৬-১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতেন অত্যন্ত নিম্ন মজুরীতে। ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি ছিল শ্রমের মর্যাদা ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার আহ্বান।
১৯১৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) গঠিত হওয়ার পর তাদের প্রথম কনভেনশনে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এটি শিকাগোর আন্দোলনের একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কিন্তু শতবর্ষ পেরিয়েও এখনও অনেক দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল অঞ্চলে এই ন্যায্য দাবি বাস্তবে রূপ নেয়নি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার রয়েছে। তবে বাস্তবে বিভিন্ন সেক্টরে এই নিয়ম মানা হয় না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর ২০১৭ সালের একটি জরিপে দেখা যায়, পরিবহন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, নিরাপত্তা সেবা, রিরোলিং মিল, হাসপাতালসহ বিভিন্ন খাতে শ্রমিকরা নিয়মিতভাবে ৮ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করেন।
উদাহরণস্বরূপ:
-
পরিবহন ও হোটেল খাতে প্রায় ১০০% শ্রমিক ৮ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করেন।
-
নিরাপত্তা খাতে ৮০% শ্রমিক নিয়মিত ওভারটাইম করেন।
-
হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৪২% শ্রমিক অতিরিক্ত কাজ করেন।
এছাড়া সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির ক্ষেত্রেও শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। মে দিবসের ছুটি থেকে বঞ্চিত হন প্রায় ৮০%-৯০% শ্রমিক।
ন্যায্য মজুরীর সংকট
বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি শ্রমিকদের জীবিকা নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত নয়। উদাহরণস্বরূপ:
-
গার্মেন্টস খাতে: ১২,৫০০ টাকা
-
রিরোলিং মিল: ১০,৬৫০ টাকা
-
হোটেল ও রেস্টুরেন্ট: মাত্র ৩,৭১০ টাকা
-
ফার্মাসিউটিক্যালস: ৮,০৫০ টাকা
এই মজুরিগুলো বাস্তব জীবনের খরচের তুলনায় অত্যন্ত কম। বিলস-এর ২০২৩ সালের গবেষণায় দেখা যায়, একটি চার সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের মাসিক গড় ব্যয় ২৪,৬৪৪ টাকা (প্রায় ২০২ ডলার)। কিন্তু অধিকাংশ শ্রমিকের আয় এর অর্ধেকেরও কম।
মূল সমস্যা: আয় ও খরচের বৈষম্য
এই বৈষম্যের কারণে শ্রমিকরা শুধু একটি চাকরিতে নয়, একই প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত শিফট অথবা একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে বাধ্য হন। মালিক পক্ষও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে দীর্ঘ সময় কাজ আদায় করে নেন, অনেক সময় কোনো অতিরিক্ত পারিশ্রমিক ছাড়াই।
আইনি কাঠামোর সীমাবদ্ধতা
যদিও শ্রম আইনের ধারা ১৪১-এ ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের বিধান রয়েছে, বাস্তবে এই ধারা কার্যকর ও শ্রমবান্ধব নয়। একইসঙ্গে জাতীয় শ্রম নীতিমালার ৭ম অনুচ্ছেদে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতে সরকারের ভূমিকা নির্ধারণ করা হলেও, তা অধিকাংশ সময় কার্যকর হচ্ছে না। ফলে, ন্যায্য মজুরি ও ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস এখনো অনেকটা কল্পনার মতোই থেকে গেছে।
শ্রমিকের অধিকারের প্রকৃত পরিধি
শুধু কর্মঘণ্টা বা মজুরি নয়—শ্রমিকদের অধিকার বলতে বোঝায়:
-
স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা
-
সামাজিক নিরাপত্তা
-
সংগঠিত হওয়ার ও দরকষাকষির অধিকার
-
শ্রম আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার
বাংলাদেশের প্রায় ৮৫% শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। তাদের জীবনমান উন্নয়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক সময় তারা শ্রম আইন সম্পর্কেও সচেতন নন, ফলে অধিকারের দাবিও করতে পারেন না।
সম্মানজনক ও মানবিক জীবন নিশ্চিত করার আহ্বান
বাংলাদেশের শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তাদের জন্য ন্যায্য মজুরি ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা কেবল নৈতিক দায় নয়, এটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনকও। উৎপাদনশীলতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা অপরিহার্য।
উপসংহার
মে দিবস কেবল একটি দিন নয়, এটি শ্রমিকদের মর্যাদা, অধিকার ও আত্মত্যাগের চেতনার বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই চেতনা তখনই সফল হবে, যখন শ্রমিকদের জন্য একটি সুরক্ষিত, ন্যায্য ও সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত করা যাবে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের সক্রিয়তা, মালিকদের মানবিকতা এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা।
৮ ঘণ্টা কর্মদিবস এবং ন্যায্য মজুরি—এগুলো কেবল দাবির বিষয় নয়, বরং এগুলো শ্রমিকদের বেঁচে থাকার ও সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপনের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু আইন নয়, বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে। মে দিবসের চেতনা প্রতিদিনের কর্মে ও নীতিনির্ধারণে প্রতিফলিত হলেই তা সত্যিকার অর্থে সফল হবে।
(লেখকঃ বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক এবং বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক)