সংস্কৃতি উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জেরে তিন সাংবাদিক বরখাস্ত, দীপ্ত টিভির সংবাদ প্রচার বন্ধ
প্রতিবেদক: নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশকাল: ৩০ এপ্রিল ২০২৫
ঢাকা: সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর একটি সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে প্রশ্ন করার কারণে তিনটি প্রধান টেলিভিশন চ্যানেলের তিন সাংবাদিককে বরখাস্ত বা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। পাশাপাশি দীপ্ত টিভি অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের সংবাদ সম্প্রচার বন্ধ ঘোষণা করেছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
গত সোমবার সচিবালয়ে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে সংস্কৃতি উপদেষ্টা ফারুকী কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আলী’র প্রদর্শনী নিয়ে কথা বলছিলেন। সেখানেই চ্যানেল আইয়ের রিপোর্টার রফিকুল বাসার, দীপ্ত টিভির মিজানুর রহমান ও এটিএন বাংলার ফজলে রাব্বি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক ইস্যুতে উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করেন।
বিতর্কিত প্রশ্ন ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া
রফিকুল বাসার বৈশাখী শোভাযাত্রায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি (মোটিফ) প্রদর্শন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন—”এটা কি ঐক্যের বার্তা দিল, নাকি বিভক্তি বাড়ালো?” উত্তরে উপদেষ্টা ফারুকী বলেন, থিম নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চারুকলার সিদ্ধান্ত। তিনি এরপর বলেন, “জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনে ১৪০০ জন নিহত হয়েছেন”—এ মন্তব্য ঘিরে বিতর্কের শুরু।
দীপ্ত টিভির মিজানুর রহমান তখন প্রশ্ন তোলেন—এই তথ্য উপদেষ্টা কীভাবে বললেন, যখন আদালতের কোনো রায় নেই? উত্তরে উপদেষ্টা জাতিসংঘের রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে বলেন, “প্লিজ, আপনি নিজে রিসার্চ করুন।”
এরপর উপদেষ্টা ও সাংবাদিকদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা তীব্র হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে সাংবাদিক বলেন, “আপনি তো বললেন একজন ব্যক্তি ১৪০০ জনকে খুন করেছে, আপনি কীভাবে বুঝলেন?” উত্তরে উপদেষ্টা বলেন, “৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি এমন প্রশ্ন করতেন, আপনি তখন কেমন প্রতিক্রিয়া পেতেন?”
এই প্রশ্নোত্তর সেশনেই উঠে আসে অভিনেতা ইরেশ জাকেরের বিরুদ্ধে মামলা সংক্রান্ত প্রশ্নও, যেটি উপদেষ্টা ফারুকী সরাসরি উত্তর দেন।
ফেসবুকে আন্দোলনের হুমকি ও চাপে গণমাধ্যম
সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পরপরই ‘জুলাই রেভ্যুলুশনারি অ্যালায়েন্স (জেআরএ)’ নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে ওই তিন সাংবাদিকের ছবি দিয়ে পোস্ট করা হয়। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে দীপ্ত টিভি, চ্যানেল আই ও এটিএন বাংলাকে ঘেরাও করার হুমকি দেয়া হয়। পোস্টে বলা হয়, “২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নিন, না হলে কর্মসূচি পালিত হবে।”
এরপর এটিএন বাংলা থেকে ফজলে রাব্বিকে, দীপ্ত টিভি থেকে মিজানুর রহমানকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং চ্যানেল আই রফিকুল বাসারকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তদন্ত শুরু করে।
এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক মনিউর রহমান বলেন, “প্রেস কনফারেন্সের ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এরপর আমাদের রিপোর্টারের বিরুদ্ধে হুমকি আসে। চ্যানেল হিসেবে আমাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রশ্ন করার বিষয়ে কোনো পূর্বানুমতি ছিল না। রিপোর্টার নিজ দায়িত্বে প্রশ্ন করেছে, যা চ্যানেলের অবস্থান নয়।”
সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া ও প্রশ্নের অধিকার
এটিএন বাংলার সাংবাদিক ফজলে রাব্বি বলেন, “আমি অফিসে ফিরে চিঠি পাই যে, আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে আমি অপেশাদার আচরণ করেছি, কিন্তু কী আচরণ সেটা বলা হয়নি। সেটি জানাটা আমার অধিকার।”
চ্যানেল আইয়ের সাংবাদিক রফিকুল বাসার বলেন, “আমার প্রশ্ন ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সত্য নয়।”
দীপ্ত টিভির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্প্রচার বন্ধের বিষয়ে হেড অব নিউজ এস এম আকাশ বলেন, “ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপাতত সংবাদ প্রচার হবে না। সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে বরখাস্ত করা হয়েছে, তবে কারণ জানানো হয়নি।”
সরকার ও উপদেষ্টার বক্তব্য
এই ঘটনায় সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বিবিসিকে জানান, “আমি এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। এখন আপনার কাছ থেকেই শুনলাম। এই সিদ্ধান্ত চ্যানেলগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।”
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম বলেন, “সরকার দীপ্ত টিভির সংবাদ বন্ধ করেনি। এটি তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।”
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ
সাংবাদিকদের একাংশ এবং অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই ঘটনা শুধু কয়েকজন রিপোর্টারের নয়, এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগের ইঙ্গিত দেয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করাই যদি বরখাস্তের কারণ হয়, তবে সাংবাদিকতা পেশা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে।
বিশ্লেষকদের মতে, ‘জুলাই রেভ্যুলুশনারি অ্যালায়েন্স’ নামের একটি অনানুষ্ঠানিক গ্রুপের হুমকির মুখে গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ যে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিয়ে নতুন শঙ্কার জন্ম দিয়েছে।