পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস: শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন -ফজলুল কবির মিন্টু

সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি
২০১৬ সাল থেকে ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশে “জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস” পালিত হয়ে আসছে। এই দিনটি কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং শ্রমজীবী মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, ও মর্যাদাসম্পন্ন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারের প্রতিফলন। কিন্তু চলতি বছর সরকার ব্যয় সংকোচনের অজুহাতে এ দিবসটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের (১ মে) সঙ্গে একত্রে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্তে জাতীয় দিবসটির স্বতন্ত্রতা ও গুরুত্ব মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে, যা বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক বার্তা বহন করে।
বাংলাদেশের অন্যতম বিপজ্জনক শিল্প খাত হিসেবে পরিচিত জাহাজভাঙা শিল্পে শ্রমিকদের জীবন প্রতিনিয়ত ঝুঁকিতে রয়েছে। গত এক দশকে এই খাতে ১৩০ জন শ্রমিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন এবং দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতালে জাহাজভাঙা শিল্পে কর্মরত ২৫ জন শ্রমিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় দেখা গেছে—তাদের অধিকাংশই কফজনিত রোগে আক্রান্ত, অনেকেই শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা ও শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছেন। কারো শরীরে অস্বাভাবিক ফোলাভাবও লক্ষ্য করা গেছে। এমনকি, ২০২৪ সালের ৮ অক্টোবর দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, চট্টগ্রামের একটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আহত ছয় শ্রমিকের রক্তে ১৪টি ভারী ধাতুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এসব তথ্য শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির ভয়াবহতা ও অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরে।
এই বাস্তবতায়, জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবসকে গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে আলাদা করে পালন করা একান্ত প্রয়োজন। একইসঙ্গে, জাহাজভাঙা শিল্পে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। শ্রমিকদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহারে মালিকদের বাধ্য করা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, এবং স্বাস্থ্যবীমা ও চিকিৎসা সুবিধা শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। দুর্ঘটনায় আহত কিংবা নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে কেবল তাৎক্ষণিক ক্ষতির হিসাব নয়, তাদের আজীবন আয় ও শারীরিক-মানসিক দুর্ভোগের পরিমাণ বিবেচনায় নিতে হবে।
শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, পূর্বঘোষিত নিম্নতম মজুরি কার্যকর করা এবং বাজারদরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে তা পুনর্নির্ধারণ করাও এখন সময়োচিত। শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য মূল্যে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা, এবং বিএসবিএ হাসপাতালকে আধুনিক ও মানসম্মত করে একটি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রূপান্তর করাও অত্যাবশ্যক। রাতের আঁধারে জাহাজ কাটা বন্ধ করে, “জীবন রক্ষা করো—নিরাপত্তা নিশ্চিত করো” এই নীতিকে সামনে রেখে জাহাজভাঙা শিল্পে সর্বাত্মক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়াও, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র কনভেনশন ১২১ অনুযায়ী সকল শ্রমিককে “Employment Injury Scheme”-এর আওতায় আনতে হবে, যাতে কর্মস্থলের দুর্ঘটনায় তারা রাষ্ট্রীয় সহায়তা পেতে পারেন।
আমরা যদি উন্নয়নের কথা বলি, তাহলে সেই উন্নয়ন অবশ্যই মানবিক হতে হবে। শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কোনো প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবসের গুরুত্ব নতুন করে উপলব্ধি করে এটিকে পুনরায় মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন করতে হবে এবং জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের জীবনমান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে—এটি কেবল দাবি নয়, একটি ন্যায্য অধিকার।
(লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি এবং বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্পের অধীনে জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক)