মতামত

নারী কমিশনের সুপারিশ: রাষ্ট্রীয় সংস্কারের সম্ভাবনা না ধর্মীয় প্রতিক্রিয়ার ভীতিতে গুটিয়ে যাওয়া?

বাংলাদেশে নারী অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান বিতর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে নারী বিষয়ক কমিশনের সাম্প্রতিক ৪৩৩ দফা সুপারিশের মাধ্যমে। এই সুপারিশগুলো নিঃসন্দেহে সাহসী এবং আধুনিক রাষ্ট্রের কাঠামোর দিকে এক ধাপ এগোনোর প্রস্তাব, কিন্তু বাস্তবায়নের পথে চ্যালেঞ্জগুলো শুধুই ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়—এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত একটি বড় সংকটের প্রতিফলন।

ধর্মীয় প্রতিরোধ না রাজনীতির সুবিধাবাদ?

হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো গোষ্ঠীগুলোর সরব বিরোধিতা যেন অনেকটাই প্রত্যাশিত। তাদের আপত্তির কেন্দ্রে রয়েছে অভিন্ন পারিবারিক আইন এবং যৌনকর্মীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার মতো ইস্যুগুলো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দলগুলো এখনো নিরব? এখানে প্রকৃত সমস্যাটা ধর্মীয় মতবাদের নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটনির্ভর মানসিকতা এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর সামনে নিজেদের আপসহীনভাবে উপস্থাপন করতে না পারার ভয়।

সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়, বড় রাজনৈতিক দলগুলো এখনও সুপারিশগুলো খোলাখুলি মূল্যায়ন করে কোনো অবস্থান নেয়নি। এটা একদিকে যেমন সাংগঠনিক দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে জনমতের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার ভয়ে পিছিয়ে থাকার প্রমাণ।

সমাজের বাস্তবতা বনাম কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গি

সমালোচকদের একটি বড় অংশ বলছে—কমিশনের সদস্যদের মধ্যে ইসলামি মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্বকারী কেউ ছিলেন না। এটি একপেশে সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার অভিযোগকে উস্কে দেয়। বাংলাদেশের মতো বহুধারায় বিভক্ত সমাজে, বিশেষ করে যেখানে একটি বড় জনগোষ্ঠী ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত, সেখানে সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা না হলে প্রস্তাবগুলো গ্রহণযোগ্যতা পায় না। একই সঙ্গে, যৌনকর্মীদের শ্রমিক অধিকার বা বিবাহের উপর নিয়ন্ত্রণের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে হঠাৎ করে সুপারিশ দিলে তা সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।

রাষ্ট্রীয় নিরপেক্ষতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা: মূল চালিকাশক্তি

জাহাঙ্গীরনগরের অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা যেমন বলেছিলেন—রাষ্ট্রের কোনো ধর্মীয় পরিচয় থাকা উচিত নয়। এই বক্তব্য শুধু আদর্শিক নয়, বরং সাংবিধানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নারী অধিকার নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ অবস্থানে দাঁড়াতে হবে। সেই নিরপেক্ষতা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার মাধ্যমে প্রকাশ পাবে। বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি অরাজনৈতিক সরকার থাকার সুযোগে সংস্কার কার্যক্রমের বাস্তবায়ন তাত্ত্বিকভাবে সহজ হওয়ার কথা, কিন্তু সেই সদিচ্ছার প্রমাণ এখনও দৃশ্যমান নয়।

সমঝোতার রাজনীতি ও পরিবর্তনের বাস্তবতা

কোনো সমাজেই পরিবর্তন হঠাৎ করে আসে না। নারী অধিকার সংক্রান্ত সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কৌশল, যার মধ্যে থাকতে হবে:

  • অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্যালোচনা প্রক্রিয়া

  • শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি

  • ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে বিবেচনাপূর্ণ সংলাপ

  • রাজনৈতিক দলগুলোর স্পষ্ট ও সাহসী অবস্থান

উপসংহার: দ্বিধার মোড় থেকে সিদ্ধান্তের পথে

নারী কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন একটি সহজ কাজ নয়, কিন্তু এটি সম্ভব—যদি সরকার, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের সংকল্প নেয়। এ মুহূর্তে প্রশ্ন একটাই—বাংলাদেশ কি সাহস করে সেই পথে হাঁটবে, নাকি ধর্মীয় প্রতিক্রিয়ার ভয়ে আবারও পিছিয়ে যাবে