বিজ্ঞান ভাবনা (১৯৭): ধর্ম ও ঈশ্বর -বিজন সাহা
সেভার সাথে আমার কথোপকথন ধীরে ধীরে ভিন্ন দিকে মোড় নিল। ও জিজ্ঞেস করল
– তাহলে তো দেখা যাচ্ছে মানব সভ্যতার পেছনে ধর্মের অবদান অনেক, বিশেষ করে সংস্কৃতিতে।
– একটা কথা প্রচলিত আছে – সংস্কৃতি হল শিক্ষিত মানুষের ধর্ম আর ধর্ম হল অশিক্ষিত মানুষর সংস্কৃতি। তারপরেও যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি দেখব ধর্ম মানব সভ্যতা গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সবচেয়ে বড় কথা এর ফলে মানুষের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান ঘটছে। কোন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ধর্মের দিকে লক্ষ্য করলে দেখব যে এদের অধিকাংশই জ্ঞানে বিজ্ঞানে খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি। তারা নিজেদের ক্ষুদ্র পরিসরে আটকে গেছে। কিন্তু খ্রিস্টান, ইসলাম, বৌদ্ধ এসব ধর্ম প্রচারের জন্য মানুষ দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, আদান প্রদান করেছে নিজেদের অভিজ্ঞতা। তাই পাইকারি ভাবে ধর্মকে সব দুর্ভোগের জন্য দায়ী করা ঠিক নয়। সমস্যা মনে হয় সেই সব ধর্মের যাদের অনুসারীর সংখ্যা কোটি কোটি। সেক্ষেত্রে এটা যতটা না ধর্মের সমস্যা তারচেয়ে বেশি মনোপলির। আসলে সব কিছুরই ভালো ও মন্দ দুটো দিকই আছে। কথা হল আমরা কোনটা গ্রহণ করব। যে কেউই বিজ্ঞানকে দোষ দিতে পারে মারণাস্ত্র তৈরি করে বিশ্বকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবার জন্য। আইনস্টাইনকে দায়ী করতে পারে পারমাণবিক বোমার ফর্মুলা আবিষ্কারের জন্য। আইনস্টাইন কিন্তু পারমানবিক বোমা আবিষ্কারের কথা ভাবেননি, তিনি চেয়েছেন প্রকৃতির রহস্য উদ্ধার করতে। শুধু যুদ্ধবাজ রাজনীতিবিদরা বিজ্ঞানের মহান আবিষ্কারকে নিজেদের স্বার্থে ভিন্ন ভাবে ব্যবহার করেছে। ধর্মের বিষয়টিও ঠিক তাই। ধর্ম কি? এটা কিছু রীতিনীতি যার ভিত্তিতে একদল মানুষ চলাফেরা করে। যখন রাষ্ট্র বলে কিছু ছিল না তখন এই রীতিনীতিই ছিল আইন। প্রাচীন কালে টিকে থাকার জন্যই ঐক্যবদ্ধভাবে চলার দরকার ছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া না থাকলে একদল লোক চলবে কীভাবে? সেগুলো ছিল প্রথমে সামাজিক আচার। পরে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ কৌশলে ওটাকে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। বিখ্যাত আফ্রিকান নেতা ডেসমন্ড টুটুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় “যখন মিশনারিরা এলো তাদের হাতে ছিল বাইবেল আর আমাদের জমি। যখন আমরা বাইবেলের শিক্ষা নিয়ে যীশুকে পেলাম দেখলাম ইতিমধ্যে আমাদের জমিজমা সব বেহাত হয়ে গেছে।” কে কী উদ্দেশ্যে কোন আদর্শ ব্যবহার করছে সেটাই আসল কথা।
– যদি ধর্মে বিশ্বাস করি বা ধর্মকে মানব সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে মানি তাহলে তো ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে হয়। ধর্ম তো ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথাই বলে, ঈশ্বরের উপাসনা ধর্মের অন্যতম প্রধান রীতিনীতির একটি।
– আচ্ছা, আলেক্সান্দর অভেচকিনের কি সুপার মার্কেট মাগনিতের প্রয়োজন আছে? ও তো এ দেশেই থাকে না, এখানে বাজার করে না? তাহলে? এটা পিওর কমার্শিয়াল ব্যাপার। বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ করে ও টাকা পায় আর এদেশের সাধারণ মানুষ ও অভেচকিনের ফ্যানরা এ কারণে হয়তো এই দোকান থেকে একটু বেশি জিনিসপত্র কেনাকাটি করে। একই ভাবে বলা যায় মেসি, রোনাল্ডো, টেন্ডুলকার, কোহলি এদের কথা। এদের জনপ্রিয়তা, এদের প্রতি মানুষের এই আবেগ ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা উপার্জন করছে। এভাবেই সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার সেলিব্রিটি বিজ্ঞাপনে অংশ নেয় যদিও তারা নিজেরা এসব জিনিস খুব কমই ব্যবহার করে। মানুষের আবেগ, মানুষের ভালোবাসা ব্যবহার করে সেলিব্রেটি ও ব্যবসায়ী দুই পক্ষই লাভবান হয়। এভাবে দেখলে ধর্মের জন্য ঈশ্বর হলেন একজন সুপার মডেল, প্রথম শ্রেণীর সেলিব্রিটি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে বেড়াতে গিয়ে অসংখ্য উপাসনালয় দেখে মনে হয়েছে ইলন মাস্ক বা বিল গেটস নয়, ঈশ্বরই সবচেয়ে বেশি সম্পদের অধিকারী। অনেক আগে, যখন সেলিব্রিটি ছিল না, ঈশ্বরকে সেই ভূমিকায় অভিনয় করতে দেয়া হয়েছে। রোবট খেতে চায় না, পরতে চায় না, বেতন চায় না, অথচ সকাল সন্ধ্যা মালিকের জন্য কাজ করে যায়। রোবটকে তবুও টেকনিক্যাল সার্ভিস দিতে হয়। ঈশ্বর কাজ করেন বিনা বেতনে, বিনা সার্ভিসে, বিনা খাবারে। এদিক থেকে বলতে গেলে ঈশ্বর মনে হয় মার্কেটিং জগতে সফলতম আবিষ্কার। খেলাধুলা, শোবিজ এসবের সেলিব্রিটিদের যেমন অতিমানবীয় ভাবে দেখানো হয় একই ঘটনা ঘটেছে ঈশ্বরের ক্ষেত্রে বা বলা চলে বর্তমানে সেলিব্রিটি বা নেতাদের চরিত্র ঐ ঈশ্বরের ধাঁচেই গড়ে তোলা হয়েছে। এই যে ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান, সর্বভূতে বিদ্যমান, পরম করুনাময়, ন্যায়বিচারক ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে এর পেছনেও রয়েছে বেশি মানুষের কাছে তাঁকে যতদূর সম্ভব বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলার ইচ্ছা। যদি ধারে না কাটে তবে ভারে কাটবে। অর্থাৎ ভালবাসায় হোক আর ভয় দেখিয়ে হোক, কোন না কোন ভাবে মানুষের কাছে ঈশ্বরকে বিক্রি করতেই হবে। তবে সর্বক্ষেত্রে অসীম ক্ষমতাই ঈশ্বরের অন্যতম প্রধান দুর্বলতা। কারণ একই সাথে পরস্পরবিরোধী দুই পক্ষকে খুশি করা যায় না, একই সাথে সবার প্রতি একই রকম দয়ালু হওয়া যায় না, সমস্ত প্রাণীর সৃষ্টিকর্তা হয়ে নিজের নামে একদলের উপর অন্য দলের অন্যায় অত্যাচার বরদাস্ত করা যায় না। যার সব করার শক্তি ও ক্ষমতা আছে তিনি সেটা না করলে তা তার দুর্বলতা হিসেবে পরিগণিত হয়। একই ভাবে কোন মানুষের উপর অতিরিক্ত বিশ্বাস রাখলে এমনকি তার ছোটখাটো ব্যর্থতাও হতাশার কারণ হতে পারে। তারপরেও সবাই নিজ নিজ নেতাদের অসীম শক্তিশালী হিসেবে দেখতে চায়, তাদের অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করে আর যখন তাদের সীমাবদ্ধতা দেখে তখন তাকে ত্যাগ করে বিরোধী শিবিরে চলে যেতে দ্বিধাবোধ করে না। কথা হল এসব জেনেও কেন ঈশ্বরকে মহাপরাক্রমশালী হিসেবে গড়ে তোলা হল? প্রাচীন কালে রাজারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে প্রচার করতেন। এটা অনেকটা মুঘল, ব্রিটিশ এসব সম্রাট বা রাজাদের প্রতিনিধির মত। সবাই বুঝত এদের সাথে ঝামেলা করলে আসলে পেছনে থাকা রাজা বাদশাহদের রোষে পড়তে হবে। বর্তমানে যেমন অনেকেই নিজেদের মন্ত্রী, এমপির প্রতিনিধি হিসেবে প্রচার করে, এটাও তাই। মন্ত্রী যত ক্ষমতাশালী তার বন্ধুর বা আত্মীয়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভয় তত বেশি। একই রীতি এখানে। ঈশ্বর যত ক্ষমতাবান তাঁর প্রতিনিধি রাজাও ততটাই শক্তিশালী। এ কারণেই প্রাচীন কালে সব রাজারা তাঁদের গৃহদেবতাকে সবচেয়ে শক্তিশালী বলে প্রচার করতেন। সেদিক থেকে দেখলে ঈশ্বরকে এভাবে অসীম করার পেছনে মানুষ নিজদের স্বার্থটাই দেখেছে। হয়তো ইতিহাসের কোন কোন মুহূর্তে ঈশ্বর সবাইকে ভালো কাজে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁকে ব্যবহার করা হয়েছে কিছু কিছু মানুষের ক্ষুদ্র স্বার্থে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে রাশিয়ায় গির্জা বা ঈশ্বরের পতাকাতলে একত্রিত হয়ে এদেশের মানুষ বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশ রক্ষা করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঈশ্বরকে ব্যবহার করে সমাজে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা, হত্যা করা হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। সেদিক থেকে ঈশ্বরকে ধর্মের প্রতীক, সাইনবোর্ড বা পতাকাও বলা চলে। কে কীভাবে ও কোন উদ্দেশ্যে তাঁকে ব্যবহার করছে তার উপর নির্ভর করে ঈশ্বর কি দিচ্ছেন মানব সমাজকে।
– তাহলে কি ঈশ্বর একান্তই আমাদের কল্পনার ফসল? কিন্তু কোন কিছু কি আপনা থেকে তৈরি হতে পারে?
– অনেকেই বলে সব কিছুর পেছনেই স্রষ্টা আছে। তাহলে ঈশ্বর ছাড়া কীভাবে মহাবিশ্ব একা একা তৈরি হল। অনেক আগে লেনিন লাইব্রেরিতে (এখন অবশ্য এর নাম রাশিয়ান স্টেট লাইব্রেরি) বসে এক বন্ধুর সাথে গল্প করছিলাম। কথায় কথায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠল। তখনও আমি বিশ্বাস ও অবিশ্বাস দুটোই যে বিশ্বাস সেটা উপলব্ধি করতে পারিনি। তাহলে হয়তো সেই বিতর্কের জন্মই নিত না। যাহোক, কথার এক পর্যায়ে সে যুক্তি দিল যে যদি কিছু লোহা লক্কর একসাথে রাখা হয় তা থেকে আপনা আপনি একটি বেন্টলি তৈরি হবে না। তাহলে সৃষ্টিকর্তা ছাড়া মহাবিশ্ব তৈরি হল কীভাবে? অথচ সে বিজ্ঞানমনস্ক, ডারউইন তত্ত্বে বিশ্বাস করে। তার মানে বিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে এটা সে মানে। এর বিপক্ষে বিবর্তন তত্ত্বের বিরোধীরা বলে এখন কেন বানর থেকে মানুষ হয় না ইত্যাদি। এরা কখনোই পরিবেশ পরিস্থিতি আমলে নিতে চায় না। মানে বিভিন্ন ক্রিটিক্যাল অবস্থায় যে প্রায় অলৌকিক কিছু ঘটতে পারে সেটা আমলে নিতে চায় না। আমাদের মনে রাখতে হবে মহাবিশ্বের সব কিছুই মৌলিক কণা দিয়ে গঠিত। আর প্রতিটি পদার্থই বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ক্ষমতা অর্জন করে। এটা আমরা ভৌত পদার্থের ক্ষেত্রে হরহামেশাই দেখি। তবে এটাও তো ঠিক হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পরে সেখানে প্রাণী জগতেও ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল যেমনটা হয়েছিল চেরনোবিলে। কয়েক কোটি বছর আগে পৃথিবীর পরিবেশ এমন ছিল না। সেসব পরিস্থিতি চাইলেই তৈরি করা যায় না। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ কোন না কোন প্রশ্নে অন্ধবিশ্বাসী থেকে যায়, যুক্তি ঠিক মেনে নিতে পারে না। যারা বলে সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কীভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হল তারা কিন্তু কখনও প্রশ্ন করে না যে ঈশ্বরকে কে তৈরি করল। আর ঈশ্বর যদি নিজেকে নিজেই সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে প্রকৃতিই বা কেন সেটা পারবে না? অর্থাৎ যে যুক্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে আমরা সন্দেহাতীত মনে করি সেই যুক্তিতেই প্রকৃতিকেও আমরা সব কিছুর স্রষ্টা বলে মেনে নিতে পারি। কিন্তু আমরা তা করি না। কেন? মনে হয় আমরা নিজেদের প্রকৃতির অংশ বলে মনে করতে পারি না। আমরা চাই প্রকৃতির মালিক হতে। ফলে আমরা প্রচার করি মানুষের সেবা করার জন্যই ঈশ্বর প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন। এটাই মনে হয় মানব প্রকৃতি। আমরা সব সময়ই নিজেদের সমস্যার সমাধনের জন্য তৃতীয় পক্ষকে ডাকি, নিজেরা কিছুতেই বসে নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে পারি না। ঈশ্বর সেই তৃতীয় পক্ষ। তাছাড়া যেসব মানুষ অন্যদের ঠকিয়ে নিজেরা ভালো থাকতে চায় তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করার এক প্রবণতা আছে। রাজার চেয়ে তাঁর উজির নাজির বেশি রাজাগিরি করে, যেমন করে মন্ত্রীর ছেলেমেয়ে বা চ্যালাচামুন্ডা। রাজা বা মন্ত্রীর তো তবুও দেখা মেলে কিন্তু ঈশ্বরের দেখা মেলে না। সেখানে জবাবদিহিতার কোন বালাই নেই। তাই যে কেউ নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি ঘোষণা করে অন্যদের উপর খবরদারি করতে পারে। আর একদল মানুষ সেটাই চায়। তাই ঈশ্বর না থাকলেও তাঁকে সৃষ্টি করা হত। কারণ তিনি এক বিশাল বাহিনীর মুখে অন্ন তুলে দিতে পারেন। তাঁর নামে যা খুশি তাই করা যায়।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো