সম্পাদকীয়-পোশাক নয়, খাসিলত পরিবর্তন জরুরী
সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশ, র্যাব এবং আনসারের ড্রেস বদলানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং এর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। নতুন ড্রেসের নকশা ও ডিজাইন নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। সাধারণ মানুষের অনেকেই এই সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত জানিয়ে জানিয়ে বলছেন, ‘‘বদলানোর কথা খাসিলত, আর বদলানো হচ্ছে ড্রেস। বোতল না পাল্টিয়ে লেভেল পাল্টালে লাভ কী?’’ এটি একটি যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন, কারণ বাহিনীর বাহ্যিক পোশাক পরিবর্তন অনেক সময়ই গভীর ও ব্যাপক পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ হিসেবে দেখা যায় না।
এখানে একটি বড় প্রশ্ন উঠছে—বাংলাদেশে এই বাহিনীগুলোর উপর জনগণের আস্থা কতটুকু? বিগত ৫৩ বছর ধরে, বিশেষত গত কয়েক দশক ধরে পুলিশ, র্যাব এবং আনসার বাহিনীগুলোর মধ্যে যে প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে, তা হলো—এই বাহিনীগুলোর প্রবল দলীয়করণ। বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য এই বাহিনীগুলোকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। এতে বাহিনীগুলোর সার্বিক কর্মকাণ্ড এবং তাদের পেশাদারি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। একে একে তারা হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীনদের একধরনের বাহিনী, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার বা প্রতিহত করার কাজ করা হচ্ছে। এই অবস্থা কোনোভাবেই জনগণের আস্থা লাভের জন্য সহায়ক নয়। বরং, জনগণের চোখে তাদের অবস্থান হয়ে ওঠেছে স্বার্থপর ও পক্ষপাতদুষ্ট।
এই দলীয়করণের ফলে পুলিশের মতো মৌলিক বাহিনীও হয়ে পড়েছে পক্ষপাতদুষ্ট এবং অনেক ক্ষেত্রে আইনের শাসন নিশ্চিত করার বদলে রাজনৈতিক আদেশ অনুসরণে বাধ্য হয়েছে। র্যাবের কর্মকাণ্ডও অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ, বিশেষত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম-অপহরণের অভিযোগের কারণে। আনসারের মতো বাহিনীগুলোও নানা সময়ে রাজনৈতিক দলের প্রভাবের বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই দলীয়করণের ফলশ্রুতিতে জনগণের কাছে এই বাহিনীগুলোর কোনো স্বাধীনতা বা নিরপেক্ষতা নেই, বরং তারা প্রায়শই ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে থাকে।
এখন, সরকারের পক্ষ থেকে বাহিনীর ড্রেস পরিবর্তন কোনো নেতিবাচক প্রভাব দূর করবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বাহিনীর পোশাক পরিবর্তন বাহ্যিক একটি পরিবর্তন হলেও, এর মাধ্যমে তাদের পেশাদারিত্ব এবং জনগণের প্রতি দায়িত্বশীলতার সংস্কার সম্ভব নয়। যদি বাহিনীর কার্যক্রমের মূল দিকগুলোর মধ্যে পরিবর্তন না আনা যায়, তবে পোশাক পরিবর্তন শুধুমাত্র একটি বাহ্যিক রূপ পরিবর্তন হিসেবে রয়ে যাবে, যা মানুষের আস্থা পুনঃস্থাপন করবে না।
এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দলীয়করণ দীর্ঘদিন ধরেই একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাহিনীগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রাধান্য অনেক সময় তাদের পেশাদারিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। জনগণের বিশ্বাস এবং আস্থা পুনঃস্থাপন করতে হলে, এই বাহিনীগুলোর মধ্যে কার্যকরী সংস্কার, স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতার ধারণা সৃষ্টির প্রয়োজন। পোশাক পরিবর্তন যদি আসল পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে, তবে সেটি বাহিনীর আচরণ এবং কার্যক্রমে মৌলিক পরিবর্তনের সাথে যুক্ত হতে হবে। কেবল বাহ্যিক পরিবর্তন করে আসল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
সুতরাং, সরকারকে একদিকে বাহিনীর বাহ্যিক পোশাক পরিবর্তন ও নতুন ডিজাইনকে শুধু একটি প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ না করে, বরং বাহিনীগুলোর কার্যক্রমে, প্রশিক্ষণ, আচরণ এবং জনগণের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধনেও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।