চলমান সংবাদ

বিজ্ঞান ভাবনা (১৭৭): দূর থেকে আজকের বাংলাদেশ    

– বিজন সাহা

গত সপ্তাহে কাজানে ছিলাম কনফারেন্স উপলক্ষ্যে, তাই দেশের ঘটনাবলী সেভাবে জানা হয়নি। তবে টুকিটাকি যা জেনেছি তাতে আশার আলো তেমন চোখে পড়েনি। যেটুকু জেনেছি তা মূলত ফেসবুক থেকে। আজকাল যেখানে স্মার্টফোন হাতে সবাই সাংবাদিক আর সবার লক্ষ্য যখন সমস্যার সমাধান নয়, সমস্যার মুখরোচক বয়ান তৈরি করে নিজের বিজ্ঞাপণ দেয়া সেখানে কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা, আর সবচেয়ে বড় কথা কোনটি সবার জন্য মঙ্গলজনক সেটা বুঝে ওঠা কঠিন।

যদিও বিভিন্ন ঘটনাই এর মধ্যে ঘটেছে তবে ইস্কন ইস্যুটাই বিশেষ ভাবে সামনে চলে এসেছে। শেষ পর্যন্ত কী হবে জানি না, তবে এই উপলক্ষ্যে ইস্কন সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেয়া গেল। এই আমার এক বদভ্যাস। সাধারণত নিজের প্রয়োজনের বাইরে কোন বিষয়ে তেমন একটা আগ্রহ দেখাই না, তবে এরকম কোন ঘটনা ঘটলে বসে পড়ি বই খুলে। ইস্কন সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি ১৯৭০ এর দশকে। তখন আমার দুই আত্মীয় যারা ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশুনা করত, একবার আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে ইস্কনের কিছু বই নিয়ে। তবে আমেরিকা থেকে আগত এসব সংগঠন সম্পর্কে বাড়িতে কেউ কোন আগ্রহ দেখায়নি। পরে মস্কোয় এদের দেখেছি। এক্সোটিক মনে হত। এখনও মাঝে মধ্যে মেট্রোর পাশে এদের হরিনাম করতে দেখি। আমার ভারতীয় (বাইরে এই এলাকার সবাইকে ভারতীয় বলেই মনে করে। আমাকে অবশ্য কখনও কখনও আফ্রিকান, কিউবান, এমনকি আরব বলেও মনে করে) চেহারা দেখে বেশ আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি পাশ কাটিয়ে চলে যাই। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সেক্টের কথা শুনেছি যাদের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রতারণার অভিযোগ আছে। এদের বিরুদ্ধে সেরকম কিছু শুনিনি। এরা যথেষ্ট বিনয়ী ও অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করে। যদি ট্র্যাডিশনাল হিন্দু মন্দিরে প্রবেশে বিভিন্ন বাধা নিষেধ থেকে থাকে ইস্কন এসব সংস্কার থেকে মুক্ত। যেকেউ সেখানে যেতে পারে, খেতে পারে। স্টিভ জবস এক ভাষণে বলেছিলেন তিনি সপ্তাহে একবার করে কয়েক মাইল হেঁটে যেতেন হরে কৃষ্ণ মন্দিরে (ইস্কন এই নামেও পরিচিত) পেট ভরে খেতে। সেদিক থেকে এরা একটি সামাজিক ভূমিকা পালন করে। আজ বই ঘেঁটে এদের সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানলাম। ভক্তিবেদান্ত স্বামী ১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্কে এই সংস্থা স্থাপন করেন, যার মূল কাজ ছিল পশ্চিমা বিশ্বে কৃষ্ণের বাণী প্রচার করা, আর সঠিক ভাবে বলতে গেলে শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণ প্রেম প্রচার করা। এর আগে প্রেমানন্দ ভারতী ১৯০৪ সালে পশ্চিমা বিশ্বে হিন্দু ধর্ম প্রচারের চেষ্টা করলেও খুব বেশি সফল হননি, যদিও লিও তলস্তই এই মতবাদের প্রশংসা করেছিলেন। তবে ১৯৮০ দশকে কিছু কিছু গুরুর কারণে কৃষ্ণ মুভমেন্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এক কথায় ইস্কন বিভিন্ন উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। তবে কখনোই এদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ শোনা যায়নি। ইস্কন যদি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হত তবে আমেরিকা ও রাশিয়ার মত দেশে এরা অনেক আগেই নিষিদ্ধ হত। ইস্কন রাজনৈতিক সংগঠন নয়। এক সময় আমার মনে হত নবদ্বীপের মায়াপুরে এর হেড অফিস হলেও ইস্কন বরং বিভিন্ন এনজিওর মত আমেরিকার স্বার্থ রক্ষাকারী এক সংগঠন। তবে ভারত সরকার যদি এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে তার প্রভাব বিস্তার বা স্বার্থ রক্ষা করতে চায় তাতে অবাক হবার কিছু থাকবে না। যাহোক, মূল কথা এখানে নয়। যেহেতু আমার ফেসবুক বন্ধুদের কেউ কেউ ইস্কন বেআইনি ঘোষণা করার দাবি করছে, তাই এত কথা। আমার মনে হয় এই দাবির পেছনে আবেগই বেশি। কারণ এর আগে কখনোই এ ধরণের দাবির কথা শুনিনি। যদি ভুল না করি, রোজার সময় এরা ইফতারির ব্যবস্থা করে বরং প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাহলে কেন এই পরিবর্তন? কারণ ইস্কনের এক গুরু চিন্ময় প্রভু হঠাৎ করেই হিন্দুদের আন্দোলনের নেতা হয়ে গেছেন।

এ নিয়ে দুটো কথা। আমরা মাত্র কয়েক মাস আগে দেশে সরকার পরিবর্তন দেখেছি। ইস্যু ছিল কোটা। কিন্তু কোটাই কি মূল কারণ? না। মূল কারণ কর্ম সংস্থানের অভাব, বেকারত্ব। যদি সরকার যথেষ্ট পরিমাণে কর্ম সংস্থান  করতে পারত তাহলে কোটার প্রশ্ন আসত না। একই ভাবে দেশে যদি হিন্দু তথা বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা সুরক্ষিত থাকত তাহলে আজ এই আন্দোলনের প্রশ্ন আসত না। তাই ভারতের বা বাইরের হাত খোঁজার আগে হিন্দুদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। প্রশ্ন এসেছে ইস্কনের প্রধানকে নিয়ে। তিনি ভালো না মন্দ সেই আলোচনায় যাব না। নেটে বিভিন্ন ধরণের তথ্য আছে। তবে তার সত্যতা যাচাই করার সুযোগ নেই। তাছাড়া ব্যক্তি নিয়ে এখানে আলোচনা করে লাভ নেই। সমাজে ন্যায়বিচারের ও ন্যায্যতার দাবি সবসময়ই ছিল, থাকবে। এসব চাহিদা ও সরবরাহ বাজার অর্থনীতি মেনে চলে। দেশের সমস্ত নাগরিকের মত সংখ্যালঘুদেরও সাংবিধানিক অধিকার আছে,  আছে দাবি আদায়ের জন্য লড়াই করার অধিকার। সেটা সঙ্গত। রানা দাসগুপ্ত সহ পরিচিত নেতারা তাদের চাহিদা মেটাতে যোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারেননি বলেই ইস্কনের প্রধান সামনে চলে এসেছেন। ঠিক যেমন এসেছে বর্তমানের সমন্বয়করা। ছয়মাস আগেও এদের কেউ জানত না, চিনত না। আজ তারাই দেশের হর্তাকর্তা ভাগ্য বিধাতা। তাছাড়া এটা ইস্কনের সমস্যা নয়, ইস্কন এর সংগঠক নয়। চিন্ময় প্রভু ব্যক্তিগত ভাবে এখানে অংশগ্রহন করেছেন। তার অপরাধ থাকলে বিচার হতে পারে, কিন্তু ইস্কন কেন এই দায় বহন করবে সেটাও ভেবে দেখা দরকার। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় এটা শাপে বর হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে  বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অজানাই থেকে যায়। যেহেতু ইস্কন একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন ও শতাধিক দেশে তার আশ্রম ও অনুসারী আছে, বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক রূপ পাবে। সেটা দিনের শেষে বাংলাদেশে হিন্দু সহ বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের অধিকারের ইস্যু আন্তর্জাতিক কমিউনিটির সামনে নিয়ে আসবে।

প্রায়ই শোনা যায় বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বিমাতাসুলভ আচরণ। মনে রাখতে হবে যে ভারত আমাদের মাতা নয় তাই বিমাতাসুলভ আচরণের প্রশ্ন আসে না। তাহলে ভারত আমাদের কে? প্রতিবেশী এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের মতই আরেকটি দেশ। আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন কোন দেশের বন্ধু বা শত্রু দেশ থাকে না, থাকে জাতীয় স্বার্থ। বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সম্পর্কে এই জাতীয় স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নটাই সামনে চলে আসে। আমরা যদি নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে না পারি সে ব্যর্থতা আমাদের। আমরা কেন পারি না? সেই মীর জাফরের সময় থেকেই আমরা ব্যক্তি স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের উপরে স্থান দিয়েছি। কী আওয়ামী লীগ, কী বিএনপি, কী অন্য কেউ সবাই ভারত, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, সৌদি আরব বা পাকিস্তানে ক্ষমতার চেরাগ খুঁজেছি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এখনও পর্যন্ত কোন ইস্যুতে এক হতে পারেনি, পারে না। আর জাতীয় স্বার্থের উপরে দলীয় স্বার্থকে স্থান দেবার এই সংস্কৃতি ভারত সহ অন্যান্য দেশের হাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আমাদের ঠকানোর ট্রাম্প কার্ড তুলে দেয়। আমি বলছি না যে ভারত বা অন্য কেউ আমাদের ঠকায় না বা ঠকাতে চায় না। কিন্তু আমরা নিজেরাই যদি তাদের সেই সুযোগ করে দেই তাহলে দোষ কার? এর আগে কত বার দেখেছি আমাদের নেতারা ওয়াশিংটন, দিল্লি, লন্ডন, করাচি ঘুরে বেরাচ্ছেন রাজনৈতিক সমর্থনের আশায়। বুঝতে হবে যে এরা নয়, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ দেশের জনগণই আপনাদের একমাত্র বন্ধু। তাই আগে নিজেদের প্রশ্ন করুন আপনারা কি চান? সমস্যা ইস্কনে নয়।

 

অনেকেই লিখেছেন যে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এসব দেখার সময় পাই না ও দেখি না। ঠিক যেমনটি বাংলাদেশী সংবাদ মাধ্যম। তবে আমার ধারণা বর্তমানে দেশের পত্র পত্রিকায় অনেক খবর আসছে না। এই অভিযোগ অনেকেই করছে। সেটা হতে পারে সেন্সর, হতে পারে সেলফ সেন্সর আবার হতে পারে মবের ভয়। বর্তমানে সংবাদের চাহিদা সর্বত্র। যদি দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে ব্যর্থ হয় তবে অন্যরা যে সেটাকে ব্যবহার করবে তাতে সন্দেহ নেই। আর আজকাল যখন স্মার্টফোন হাতে থাকলে যে কেউ মোবাইল রিপোর্টার হতে পারে তাই সংবাদ সেন্সর করা এখন লাভজনক নয়, উল্টো ক্ষতিকর। বিভিন্ন দেশে যখনই কোন সরকার সংবাদ সেন্সর করেছে তখনই প্রোপ্যাগান্ডার যুদ্ধে তারা হেরে গেছে। তাই অন্যেরা যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে সেজন্যে ওদের আগে নিজেরা সংবাদ সরবরাহ করুন।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৭৮): অন্তহীন যুদ্ধ -বিজন সাহা

 

হিন্দুদের অধিকারের আন্দোলন দেখে অনেকেই এতে ভারতের হাত দেখছেন, বলার চেষ্টা করছেন এভাবে হিন্দুরা ভারতকে জড়াতে চায়। আমাদের ছোটবেলায় বাংলাদেশের হিন্দুদের সরাসরিই বলা হত ভারত ওদের দেশ। অনেক হিন্দু নিজেরাও বিশ্বাস করত বাংলাদেশে তারা থাকতে পারবে না, তাই  ভারত যাওয়ার সুযোগ খুঁজত। বর্তমানে হিন্দুদের অধিকারের জন্য আন্দোলন তো উল্টো তাদের দেশপ্রেমের পরিচয়। তারা আজ আর ভারতে চলে যেতে চায় না, তারা এদেশেই থেকে যেতে চায়, এই দেশের সাথেই নিজেদের ভাগ্য জড়াতে চায়, এখানেই তাদের জন্ম, এখানেই তারা মরতে চায়। মনে রাখা দরকার হিন্দুরা এদেশের ভূমি পুত্র। উড়ে এসে জুড়ে বসা নয়। এরা যে এই এদেশে থাকার জন্য লড়াই করবে তাতে অবাক হবার কী আছে? ভারতে কি সংখ্যালঘু মুসলমানরা লড়াই করছে না সে দেশে থাকার জন্য? নিজের দেশে মাথা উঁচু করে বাঁচার ইচ্ছা কি দেশদ্রোহ? তাই এদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ না এনে বরং এদের কথা শুনুন। এদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপরাধের বিচার শুরু করুন। এরা দেশের ক্ষতি চায় না, উল্টো দেশ গঠনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে চায়। আমার ধারণা চিন্ময় প্রভুকে মুক্তি দিয়ে সরকার যদি হিন্দুদের দাবি দাওয়া শোনে, তাদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয় তাহলে কোন রক্তপাত ছাড়াই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। হ্যাঁ, রক্তপাতের কথা যখন উঠল, চট্টগ্রামে  এক আইনজীবীর মৃত্যু নিয়ে দু’টো কথা না বললেই নয়। শুনেছি সেখানে পুলিশ, ইস্কন অনুসারী ও সমন্বয়কদের সমর্থকরা উপস্থিত ছিল। তিন দলের মধ্যেই কথা চালাচালি হয়। এর মধ্যেই আইনজীবীর মৃত্যু হয়। আমরা কিছুদিন আগে দেখেছি কারো মৃত্যু বা উধাও হয়ে যাওয়া (শহীদরা ফিরে এসে সেটা প্রমাণ করেছে) কিভাবে রাজনৈতিক পট বদলে দিতে পারে। তাই এই মৃত্যুর পেছনে যে কেউই থাকতে পারে। এই ঘটনার নিশ্চয়ই ভিডিও আছে। কাউকে দোষারোপ না করে এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার উত্তেজনা ও দুই সম্প্রদায়ের ভুল বোঝাবুঝি কমাতে পারে। আচ্ছা আজ যদি চিন্ময় প্রভুর মত কেউ রিক্সা চালকদের আন্দোলনে গতি দিতে পারত তাহলে কি তাদেরও দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দেয়া হত?

ইদানিং ফেসবুক খুললে মনে হয় ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধ অনিবার্য। দেশের ছোট বড় সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবাই যুদ্ধের কথা বলছে, কিন্তু শান্তি বলে যে একটি শব্দ আছে সেটা সবাই বেমালুম ভুলে গেছে। এই দেশপ্রেম ভালো। তবে দেশপ্রেম যদি যুক্তি দিয়ে পরিচালিত না হয় সেটা বিপদ ডেকে আনতে পারে। আমি এ ব্যাপারে খুব সন্দিহান। ইউক্রেনের ঘটনা তো চোখের সামনেই ঘটে গেল। এ ছাড়া ইরাক, আরব বসন্ত, জর্জিয়া, সিরিয়া, লিবিয়া – এ সবই তো তরতাজা ঘটনা। এমনকি ইউরোপে যা ঘটছে – সেটাও কি আমেরিকার তৈরি রঙিন বিপ্লব নয়? আজ ইউরোপ কোথায়? ইউক্রেন যুদ্ধের আগে পশ্চিমা বিশ্ব যত ভাবে সম্ভব পরিস্থিতি উত্তপ্ত করেছে। তাদের ধারণা ছিল যুদ্ধ শুরু করে শুধু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাশিয়াকে শায়েস্তা করবে। এখন ইউরোপের অর্থনীতি ধ্বংসের পথে। রাশিয়ার অর্থনীতি ধীর গতিতে হলেও বাড়ছে, দেশ পশ্চিমা নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসছে। ইউক্রেন এখন ধ্বংসস্তূপ। যদি কেউ মনে করে গণতন্ত্র, মানবতা, ইউক্রেনের মানুষের মঙ্গল কামনা করে পশ্চিমা বিশ্ব এসব করেছে – সেটা হবে ভুল ধারণা। এখন তারা ইউক্রেনকে বাধ্য করছে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। সেখানে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য যুদ্ধ চলছে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে। কেন? যুদ্ধ খুব লাভজনক ব্যবসা। এতে নিজেদের সমস্ত ব্যর্থতা মাটি চাপা দেয়া যায় আর অস্ত্র বিক্রি করে কোটি কোটি ডলার উপার্জন করা যায়। আমাদের মনে রাখা দরকার – বাইরের শক্তির মদদে যুদ্ধ শুরু হলে সেটার ফলাফল আমাদেরই ভোগ করতে হবে। তারা শুধু অস্ত্র ব্যবসা করবে, নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করবে, এই যুদ্ধে কতজন বাংলাদেশী বা ভারতীয়ের প্রাণ যাবে তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই। তাছাড়া এই যুদ্ধে রাশিয়ার মত দেশ নেই যে বেসামরিক লোক মারা যেতে পারে বলে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে পিছ পা হবে। বর্তমান যুদ্ধ এই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কত প্রাণ যে নেবে সেটা কল্পনাও করা যাবে না। কে জিতবে সেটা বলতে পারব না, তবে হারবে সবাই। তাই আমাদের চেষ্টা করতে  হবে যুদ্ধের উত্তেজনা কমিয়ে আনার।

 

গণিতে আমরা যে সমস্ত ফাংশন ব্যবহার করি তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ধারাবাহিকতা। সাধারণ ভাষায় এর অর্থ হল প্রতিটি প্রতিবশী বিন্দুর পরস্পরের সাথে সদ্ভাব। আমরা যখন ঢাকায় বসে প্যালেস্টাইনের মুসলমান, দিল্লিতে বসে বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য সমবেদনা জ্ঞাপন করি ঠিক তখনই পাশের বাড়ির ভিন্নধর্মী মানুষের উপর অত্যাচার করি। এরফলে আমাদের সেই ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যায়। যে ফাংশন লোকালি ধারাবাহিক নয় তা গ্লোবালি ধারাবাহিক হতে পারে না। আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই দূরদেশে আমাদের স্বধর্মীদের মঙ্গল চাই তাহলে সবার আগে আমাদের নিজ নিজ প্রতিবেশীর প্রতি যত্নবান হতে হবে, তাদের মঙ্গল করতে হবে। আর একমাত্র তখনই আমরা মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে পারব। ঘৃণা আর প্রতিহিংসা কখনও মঙ্গল বয়ে আনে না, তারা শুধু ঘৃণার, প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। ঘৃণা আর প্রতিহিংসার ফসল ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা পেতে চাইলে ভালোবাসা দিতে হয়।

আমাদের রাজনীতির অন্যতম দুর্বল জায়গা অনৈক্য। প্রায় কোন বিষয়েই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মতৈক্যে পৌঁছুতে পারত না। এমনকি এ রকম একটি কথা চালু ছিল যে শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের জমি দখলের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত সবাই এক দল, এ ছাড়া বাংলাদেশে এমন কোন বিষয় নেই যা এদের এক করতে পারে। তাই জাতীয় ঐক্যের জন্য হলেও সাম্প্রদায়িক সমস্যা জিইয়ে রাখতে হবে। তবে এবার দেখা গেল যে সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণে ভারতের প্রতিবাদের কারণে বাম, ডান, সিপিবি, বিএনপি, জামাত সবাই প্রধান উপদেষ্টার ডাকে সাড়া দিয়ে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল ব্যাপার। তবে প্রশ্ন হল ভারতের বিরুদ্ধে এই ঐক্য কি বাংলাদেশের পক্ষে ঐক্য? কারণ বাংলাদেশ শুধু একটু ভৌগলিক ভূখণ্ড নয়, শুধু জনগণ নয়, এটা মুক্তিযুদ্ধের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া একটি সংবিধান, সব মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকার। এটা তো অজানা নয় যে বাংলাদেশ প্রশ্নে উপস্থিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন মত পোষণ করে। কোন কোন দল এমনকি একাত্তরের স্বাধীনতাকে স্বীকার পর্যন্ত করে না। তাহলে এই ঐক্য কি ভারতের প্রতি ঘৃণা থেকে? এখানে কি বাংলাদেশের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসার স্থান নেই? নাকি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী দলগুলো চব্বিশে এসে নতুন স্বাধীনতা গ্রহণ করেছে? তাই যদি হয় তবে একদিন হয়তো ইতিহাস বইয়ে লেখা হবে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবি, সাংস্কৃতিক কর্মী, বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে কমরেডরা আজ মস্কোর পথ ভুলে যে হারে মক্কার পথে হাঁটছেন তাতে সেটা হলেও অবাক হবার কিছুই থাকবে না, যদিও ব্যক্তিগত ভাবে কিছুটা কষ্ট পাব নিশ্চয়ই। শত্রুর শত্রু বন্ধু হতে পারে ইস্যু ভিত্তিক, সে বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী হয় না। আজকের ঐক্য শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষের ন্যায্য দাবীর সংগ্রাম থেকে বামপন্থীদের পথচ্যুত করবে না বলেই আশা করি। কারণ সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষায় বর্তমান সরকার যেভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন তাতে এই ভারত বিরোধী হাইপ তাদের সুক্ষ পরিকল্পনা কিনা সেটাই বা কে বলতে পারে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো