বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৭৫): রাশিয়ার নিউক্লিয়ার ডক্ট্রিন  

-বিজন সাহা

সব কিছুর মত দেশপ্রেমও আপেক্ষিক, শর্তসাপেক্ষ। অন্তত ইদানিং তাই মনে হয়। আমি অবশ্য সাধারণ মানুষের কথা বলছি না, বলছি সমাজের হর্তাকর্তাদের কথা। কারণ – বড়লোকরা ভূমির মালিক আর গবীবেরা জন্মভূমির। তাই গরীব বা সাধারণ মানুষ সব অবস্থাতেই তার দেশকে, জন্মভূমিকে ভালবাসে, সব সময়ই চায় সে সুখে থাক। কিন্তু একই কথা যাদের হাতে দেশের ভালোমন্দ নির্ভর করে তাদের সম্বন্ধে বলা যাবে না। তাদের কাছে দেশ তখনই প্রিয় যখন সে তাদের অধীনে। অন্যের কাছে ক্ষমতা চলে গেলে দেশ তখন আর প্রিয় থাকে না। দেশ তখন বারঙ্গনা নারী। আগে এসব পিছিয়ে পড়া দেশে দেখা যেত, এখন উন্নত বিশ্বেও। এ এক নতুন বাস্তবতা। অনেক আগে যখন কেউ কিছু বিক্রি করত বা কেউ যখন দেশত্যাগ করে চলে যেত তখন নতুন বাসিন্দাদের অনুরোধ করত তারা যেন বাড়িটার যত্ন নেয়, গাছপালার যত্ন নেয়। এসব কথায় ফেলে যাওয়া দেশ বা স্মৃতির প্রতি তার গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পেত। তাই তো এসব মানুষ অনেক বছর পরেও এলাকার কারো দেখা পেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফেলে যাওয়া বাড়ির খোঁজ খবর নেয়। এটা শুধু ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, দেশের ক্ষেত্রেও ঘটত। নির্বাচনে পরাজিত হলে যতদূর সম্ভব সাজানো গোছানো ভাবে নতুন নেতৃত্বের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিত। কিন্তু ইদানিং কালে মনে হয় সবাই ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত বা দলগত সম্পদ বলে মনে করে। তাই ক্ষমতা ত্যাগের আগে যতদূর সম্ভব দেশের ক্ষতি করে যায় যাতে পরবর্তী নেতৃত্ব সফল হতে না পারে। মনে আছে ২০১৬ সালে ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ী হলে ওবামা রাশিয়ার বিপুল সংখ্যক কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেন যাতে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতেও বেশ খানিকটা সময় কেটে যায়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখি এবারও। ট্রাম্প যখন ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের কথা বলছেন বাইডেন তখন শেষ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছেন ইউক্রেনের যুদ্ধের আগুনে বেশি বেশি খড়কুটো ফেলতে। ফলে দেখা দিয়েছে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা। রাশিয়ার ব্রিয়ানস্কে আমেরিকার আটাকামস আঘাত হানার পরে ভ্লাদিমির পুতিন নতুন পারমাণবিক ডক্ট্রিনে সই করেছেন। এবং তাতে বলা হয়েছে রাশিয়া শুধু পারমাণবিক শক্তির অধিকারী দেশেই নয়, এমনকি অন্যান্য দেশেও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে, যদি সেই দেশের পেছনে পারমাণবিক অস্ত্রধারী কোন দেশ থাকে। ডক্ট্রিনে বলা হয়েছে যদি কোন দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে আগ্রাসনের জন্য তার ভূমি, আকাশ বা সাগরসীমা তৃতীয় কোন দেশকে ব্যবহার করতে দেয়, সেক্ষেত্রেও তারা পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। শুধু তাই নয় যদি কোন দেশ বা জোট রাশিয়ার কোন অংশ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে সেক্ষেত্রেও সে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। এটা বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য ক্রিমিয়া আর কালিনিনগ্রাদের জন্য। কারণ বাল্টিকের দেশগুলো ও ফিনল্যান্ড কালিনিনগ্রাদ অবরোধ করার জন্য প্রকাশ্যে ডাক দিয়েছে। শুধু তাই নয়, আগে যদি যুদ্ধের সময় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা বলা হত এখন বলা হচ্ছে এমনকি শান্তির সময়েও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে। যে সমস্ত পরিস্থিতিতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হবে তার মধ্যে রয়েছে যদি নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে কোন দেশ রাশিয়া ও তার বন্ধুদেশের (এক্ষেত্রে বেলারুশ) বিরুদ্ধে ব্যালিস্টিক রকেট ছুঁড়ছে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও সামরিক ভবন আক্রমণ করেছে, যা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি সাধারণ অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ যা দেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ – সেক্ষেত্রেও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হবে। এমনকি ব্যাপক ড্রোন হামলাও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে বাধ্য করতে পারে। এক কথায় রাশিয়ার পারমাণবিক ডক্ট্রিন এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি খোলামেলা, অনেক বেশি যদি, কিন্তু ছাড়া।

ইতিমধ্যে ইউক্রেন ইংল্যান্ডের স্টর্ম শ্যাডো দিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেছে। দিন দিন উত্তেজনা বাড়ছে। বিশেষ করে ইউক্রেন ডার্টি পারমাণবিক বোমা তৈরির হুমকি দেবার পর থেকে। এ জন্যেই মনে হয় বানরকে লাই দিতে নেই। একবার মাথায় বসলে তাকে নামানো মুস্কিল। জেলেনস্কির হারানোর কিছু নেই, তবে সে পৃথিবী ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই তো এখন বলছে – হয় আমাকে ন্যাটোর সদস্য কর, নাহলে আমি পারমাণবিক বোমা তৈরি করব। বোঝ ঠেলা। দুর্বল যখন অন্যের শক্তিতে খেলতে শুরু করে, একসময় সে নিজেকে অসীম শক্তিশালী মনে করে। তখন থেকে শুরু হয় সাবোটাজ। এখন সেটাই চলছে। সেই সাথে পশ্চিমা বিশ্বের নেতাদের অদূরদর্শিতা। গতকাল থেকে অনেকেই ফোন করছে, জানতে চাইছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগবে কি না?

কী উত্তর দেব? বলি সেটা নির্ভর করে আমেরিকার উপরে। বিদায়ী প্রশাসন কতদূর যাবে রাশিয়ার সাথে আমেরিকার সম্পর্ক তিক্ত করতে তার উপর। এখন তো সম্পর্ক শূন্য নয়, মাইনাসে নেমে গেছে। ইউরোপের মানুষ যদি শান্তি চাইত এতদিন যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন করত। করে না। কেন? কারণ যুদ্ধের ফলে যে ব্যবসা হচ্ছে তার ভাগ তারাও পায়। অথবা হতে পারে এই যুদ্ধ যে তাদের রক্ত, মাংস আর ঘামের বিনিময়ে হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে না। আর যুদ্ধ লাগবে কি লাগবে না সেটা জেনে কী লাভ? যদি আমরা নিজেদের মৃত্যুর সঠিক সময় জানতাম তাহলে কি বেশি সুখী বা খুশী হতাম? মনে হয় না। অনেকেই বলতে পারেন তাহলে আগে থেকে সব কাজ শেষ করতে পারতাম। আমার মনে হয় ওই দিন মৃত্যু এটা জেনে বরং আরও বেশি মনঃক্ষুণ্ণ হতাম, কাজের প্রতি অনীহা জাগত এই ভেবে যে কী হবে কাজ করে যদি এই দিন মরে যাই। মৃত্যু নিশ্চিত, তবে কবে সে আসবে সেটা আমাদের অজানা। তাই তো আমরা বাঁচার জন্য লড়াই করি, এই অনিশ্চয়তাই আমাদের সাহস যোগায়, শক্তি যোগায়, স্বপ্ন দেখায়। তাই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে লাগবে সেটা নিয়ে না ভেবে জীবনকে উপভোগ করুন। হতে পারে শেষ বারের মত।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৭৬): অবিশ্বাসীর বিশ্বাস - বিজন সাহা

 

ইতিমধ্যে নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে জার্মানি এক বিশাল সেনাবাহিনী ইউক্রেনে মোতায়েন করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভুলে গেলে চলবে না যে গত শতাব্দীতে এই জার্মানি দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়েছে যা মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের পর মিত্র শক্তি যে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয় তার অন্যতম ছিল জার্মানি ও জাপান সামরিক শক্তি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারবে না। তাই জার্মানির এই পদক্ষেপ ভাবনার বিষয়। জাপানও পিছিয়ে নেই। এই দুটো দেশ চাইলেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে। যেহেতু এই দুটো দেশই খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী তাই এরা যদি সামরিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সেটা বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। অন্য দিকে পোল্যান্ড, বাল্টিকের দেশগুলো আর ইউক্রেন তিন দিক থেকে বেলারুশ আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে রাশিয়া বসে থাকবে বলে মনে হয় না। অর্থাৎ পৃথিবী দ্রুত গতিতে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছুচ্ছে। এই সব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে ভ্লাদিমির পুতিন জাতির উদ্দেশ্যে আজ ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন আমেরিকার আটাকামস ব্রিয়ানস্ক আক্রমণ করার পর থেকে ইউক্রেনের যুদ্ধ আঞ্চলিক চরিত্র হারিয়ে গ্লোবাল আঁকার ধারণ করেছে। এখন থেকে যে সব দেশের অস্ত্র ব্যবহার করে ইউক্রেন রুশ ভূমি আক্রমণ করবে রাশিয়া সেই সব দেশের সামরিক স্থাপনা আক্রমণ করার অধিকার রাখে। তা সে আমেরিকাই হোক, ইংল্যান্ড বা অন্য যেকোনো দেশই হোক। মানবিক দিক থেকে তারা প্রথমে স্থানীয় লোকজনদের শহর ছাড়ার সময় দেবে যাতে বেসামরিক লোকক্ষয় যতদূর সম্ভব কমানো যায়। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়া আজ ইউক্রেনে আরেশ্নিক নামে এক নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এটা এই নতুন অস্ত্রের প্রথম ব্যবহার। হাইপারসনিক এই অস্ত্রের সাহায্যে সোভিয়েত আমলে তৈরি ইউঝমাস নামক এক বিখ্যাত কারখানা আজ ধ্বংস করা হয়। পুতিন আরও বলেন যে রাশিয়া কূটনৈতিক ভাবে যেকোনো সমস্যার সমাধানে প্রস্তুত, কিন্তু কেউ যদি সামরিক উপায়ে সেটা করতে চায় রাশিয়া সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তবে পশ্চিমা বিশ্বের অনেক নেতাই এটাকে ব্লাফ বলে মনে করছে। এমনকি আমেরিকার অনেকের ধারণা সীমিত আঁকারে রাশিয়া ও আমেরিকা পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সেটা বিশ্বের জন্য তেমন ক্ষতিকর কিছু হবে না। এটা অনেকটা ঘুমন্ত দৈত্যকে খোঁচানোর মত। যারা খোঁচায় তারা ভাবে ওর ঘুম ভাঙবে না বা ঘুম ভাঙলেও ওরা দৌড়ে পালাতে পারবে। কিন্তু সময় মত থামতে না পারলে মানব সভ্যতা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। এতদিন পর্যন্ত এ দেশে খুব কম লোকই বিশ্বাস করত যে রাশিয়া ইউক্রেনের উপর এমন ভাবে আক্রমণ করবে যেমনটা ইসরাইল করছে প্যালেস্টাইনের উপর। শত হলেও ভ্রাতৃপ্রতিম জাতি। কিন্তু ইউক্রেনের কুরস্ক আক্রমণের পরে এখানে জনমত বদলাতে শুরু করেছে। তাই এখন যদি কিয়েভকে মাটির সাথে মিশিয়েও দেয়া হয় এদেশের মানুষ সেটাকে মেনে নেবে। সব দেখে মনে হয় ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণ না করা পর্যন্ত বিশ্ব এক অনশ্চিত সময় কাটাবে। ক্ষমতা ছাড়ার আগে বাইডেনকে দিয়ে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানো হয় তাতেও অবাক হবার কিছু থাকবে না, কেউ থাকবে না। এখানে আইনস্টাইনের কথাটি মনে রখা খুব দরকার। তিনি বলেছিলেন – তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষ কোন অস্ত্র ব্যবহার করবে সেটা বলতে পারি না, তবে  চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ মানুষ করবে পাথর আর লাঠিসোঁটা দিয়ে। তাই যদি শান্তি চান তাহলে ন্যাটো হটান। কারণ শান্তি এমনি এমনি আসে না, শান্তির জন্য যুদ্ধ করতে হয়।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো