un

বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস সেক্টরে রিপ্রেজেনটিভদের শোষণ: অধিকার ও মর্যাদার সংকট

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস সেক্টরে কর্মরত মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটিভদের (এমআর) অবস্থা আজকাল অত্যন্ত শোচনীয়। একদিকে, দেশের স্বাস্থ্যখাতের অগ্রগতিতে এই পেশার গুরুত্ব অপরিসীম, অন্যদিকে, তাঁদের শোষণ ও বঞ্চনা অস্বীকারযোগ্য এক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর অমানবিক আচরণ এবং কর্মী অধিকার লঙ্ঘনই এই খাতের অন্যতম সমস্যা হয়ে উঠেছে। রিপ্রেজেনটিভরা শুধু দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও শর্তের জন্য নাজেহাল হচ্ছেন না, বরং তাঁদের শারীরিক, মানসিক এবং পেশাগত মর্যাদাও লঙ্ঘিত হচ্ছে।

ফার্মাসিউটিক্যালস সেক্টরের রিপ্রেজেনটিভদের কর্মঘণ্টা অত্যন্ত কঠোর ও অবিশ্বাস্য। সাধারণত, এই পেশার কর্মীরা সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করেন, অনেক সময় তাঁদের কাজের সময়কাল আরও দীর্ঘ হয়। তাঁদেরকে প্রায়ই নির্দিষ্ট সময়ের পরেও ডাক্তারদের চেম্বারের সামনে দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, যেখানে তাঁদের জন্য কোনো নিরাপদ বা সুশৃঙ্খল পরিবেশ নিশ্চিত করা হয় না। এমনকি, রোগী দেখার পরেও ডাক্তারদের সহায়তার জন্য অপেক্ষা করা একটি চরম নির্যাতন হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে, রিপ্রেজেনটিভরা নানা ধরণের অবমাননা সহ্য করেন, যেমন অপমানজনক মন্তব্য বা শারীরিকভাবে হেনস্থা হওয়া।

ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি তাদের কর্মীদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার দিকে কোনো দৃষ্টি দেয় না। অনেক সময়ে, কোম্পানিগুলি তাদের কর্মীদের এমন পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করে, যেখানে তারা নিজেদের কোনো অধিকার বা মর্যাদা অনুভব করতে পারেন না। এমনকি কিছু প্রতিষ্ঠান রিপ্রেজেনটিভদের ক্লিনিক বা মেডিক্যালের ভিতরে প্রবেশ করতে নিষেধ করে, যেখানে তাদের মানসিক অবস্থা আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি রিপ্রেজেনটিভদের সাথে এমন শর্তে চুক্তি করে, যা এক ধরনের বাধ্য শ্রমেরই উদাহরণ। অনেক সময় কর্মীদের চাকরি দেয়ার সময় কোম্পানিগুলো তাদের কাছ থেকে ব্ল্যাঙ্ক চেক গ্রহণ করে এবং এমনসব চুক্তিতে স্বাক্ষর করায়, যেখানে তাঁদের চাকরি ছাড়ার কোন অধিকারই থাকে না। এটি একদিকে যেমন শ্রম আইনের সোজাসুজি লঙ্ঘন, তেমনি অন্যদিকে তাঁদের পেশাগত স্বাধীনতা ও মর্যাদারও অবমাননা।

বাংলাদেশে শ্রম আইনের আওতায় কর্মীদের অধিকার সুরক্ষিত হলেও, ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরে কর্মরত এমআরদের জন্য এই আইন কার্যকরী হয়নি। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (ILO) এর কনভেনশন ২৯ ও ১০৫, যা বাধ্য শ্রম নিষিদ্ধ করে, এবং বাংলাদেশের সংবিধান ৩৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কোনো নাগরিককে বাধ্যতামূলক শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না,” তা সত্ত্বেও কোম্পানিগুলি এই নিয়মগুলো উপেক্ষা করে যাচ্ছে।

ফার্মাসিউটিক্যালস সেক্টরের রিপ্রেজেনটিভদের জন্য ছুটি বা সাপ্তাহিক বিরতির ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে, সরকারি ছুটির দিনেও তাঁদের কাজ করতে হয়। এমনকি, সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা অন্য কোনো ধরনের ছুটির সুবিধা তাদের নেই। একমাত্র ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আজহার সময়  ৩ দিন করে ছুটি দেওয়া হয়, তবে সেই ছুটি পুরোপুরি তৃপ্তিদায়ক নয়। এই ধরনের পরিস্থিতি, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার কারণে, কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরে এভাবে শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিবাদে, রিপ্রেজেনটিভরা একত্রিত হতে শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা বুঝতে শুরু করেছেন যে, তাদের অধিকার রক্ষায় সংগঠিত হওয়া জরুরি। এ কারণেই, ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেনটেটিভ এসোসিয়েশন (ফারিয়া) গঠন করা হয়েছে। গত ৮ নভেম্বর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত একটি মানববন্ধন ও র‍্যালির মাধ্যমে তাদের ঐক্যের প্রকাশ ছিল, যেখানে প্রায় পাঁচ হাজার রিপ্রেজেনটিভ অংশ নিয়েছিলেন। এই ঘটনা চট্টগ্রামের শ্রমজীবীদের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি এই আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে নানা ধরনের হুমকি ও চাপ সৃষ্টি করছে। তারা দাবি করছে,  রিপ্রেজেনটিভদের শ্রমিক হিসেবে গণ্য করা হয় না।

এই অবস্থার উন্নতির জন্য সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। সরকারকে প্রথমত ফারিয়া সংগঠনকে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে এবং ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেনটিভদের শ্রম আইনের আওতায় আনতে হবে। এছাড়া, প্রয়োজনে শ্রম আইনের সংশোধন করে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার সুযোগ দিতে হবে, যাতে কোম্পানিগুলি তাদের শ্রমিকদের সঠিক অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য হয়।

শুধু আইনি পদক্ষেপই নয়, সরকারের আরও দায়িত্ব রয়েছে, যেমন সেক্টরটির টেকসই উন্নয়নের জন্য মালিকপক্ষ, কর্মী এবং রাষ্ট্রের মধ্যে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু সংলাপের পরিবেশ তৈরি করা। এটি প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সুষ্ঠু সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করবে এবং এভাবে সবার স্বার্থ রক্ষা হবে।

ফার্মাসিউটিক্যালস সেক্টরের রিপ্রেজেনটিভদের শোষণ ও বঞ্চনার অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং এটি শুধুমাত্র একটি পেশাগত সমস্যা নয়, বরং এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বড় উদাহরণ। সরকার যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং শ্রম আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করে, তাহলে এই খাতের উন্নতি ও কর্মী স্বার্থ রক্ষা সম্ভব হবে। কর্মী অধিকার সুরক্ষিত হলে, একদিকে যেমন সেক্টরের মান উন্নত হবে, অন্যদিকে দেশের স্বাস্থ্যসেবারও দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হবে।

লেখক: ফজলুল কবির মিন্টু
(সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি)