বিজ্ঞান ভাবনা (১৭৪): রাশিয়ার দিনকাল -বিজন সাহা
আমার লেখার উপাদানের মূল উৎস ফেসবুক আর মানুষ। সুযোগ পেলেই মানুষের সাথে কথা বলি, বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত জানার চেষ্টা করি। ফলে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন ধারণা সম্পর্কে উপলব্ধি আসে। আমার সাথে যারা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে তাদের একজন সেভা। আমার ছোট ছেলে। ওর এখন ২১। যদিও সাধারণত কারো সাথে তেমন একটা মেলামেশা করে না, সেই অর্থে তরুণ সমাজ কী ভাবছে সেটা সম্পর্কে ওর জানার পরিধি কম, তারপরের নিজে যেহেতু তরুণ আর সেই সূত্রে সব কিছুই নিজের মত করে ভাবে এবং প্রায়ই নিজের ভাবনাকে একমাত্র সঠিক মনে করে তাই ওর সাথে কথা বলে বেশ মজা পাই। তাছাড়া ও সব সময় মেইন স্ট্রীমের বাইরের খবর দেখে, ওগুলো আমাকে পাঠায়। তাই ওর মধ্য দিয়ে আমি এদেশের অদেখা জায়গাটি দেখতে পাই। তবে ও যে সব সময় ওর কথাবার্তা স্টেটমেন্ট হিসেবে বলে তা নয়, প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে আমার মতামত জানতে চায়। আমরা কখনও একমত হই, কখনও হই না। তবে দুজনেই মনে হয় নতুন কিছু জানি। অন্তত দুজনের ভাবনা সম্পর্কে। আর আমার লেখালেখির তো একটাই উদ্দেশ্য – অন্যকে জানানো যে বিষয়টি এভাবেও ভাবা যায়।
আমি রোববার করে মস্কো যাই। সোমবার ক্লাস। সেবার মনিকা পিটার গেছে। সেভা একা।
চল দোকানে যাই। রান্না করি কিছু একটা।
চল।
এর আগে আমরা কিছুক্ষণ হাঁটি। কখনো যাই নভদেভিচি মনাস্তিরের দিকে, কখনো ত্রুবেস্কি পার্কে, কখনো লুঝনিকি, কখনো মস্কো নদীর ধারে। গল্পে গল্পে কাটে সময়। সেদিন হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই খুব একটা হাঁটা হয়নি।
পাপ?
বল।
একটা প্রশ্ন করব?
কর।
আগে তোমাকে আমি এই প্রশ্ন করিনি। সমকামীদের তুমি কী চোখে দেখ?
কোন চোখেই না।
মানে খারাপ বা ভালো কিছুই না?
দেখ যতক্ষণ কেউ আমাকে বিরক্ত না করে ততক্ষণ আমি কাউকে নিয়ে কিছু ভাবি না।
বুঝলাম।
আমি যখন ছাত্র ছিলাম আমাদের ফ্যাকাল্টিতে একজন সমকামী ছিল। ল্যাটিন আমেরিকার। কলম্বিয়া বা কোস্টারিকা থেকে। এমনিতে দেখা হলে হাই হ্যালো বলতাম। আমাদের তখন নীচে কমন বাথরুম ছিল। ওখানে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকত। আমরা স্নান করতে গেলে হ্যাংলার মত চেয়ে থাকত। তখন মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। তবে এটা ঠিক ঐ সময় ধারণা করা হত এইডস এদের মাধ্যমে ছড়ায়। সেদিক থেকে আমরা আজকালকার মত এদের সাথে এতটা নির্ভয়ে মিশতে পারতাম না। এখন ওদের ব্যাপারে ভালো বা মন্দ কিছু ভাবি না। আর দশজনের মতই ওদের দেখি। আসলে মানুষ হয় ভালো নয়তো খারাপ। এটা তার ধর্ম, বর্ণ, সমকামিতা এসবের উপর নির্ভর করে না।
এটা তো জন্ম থেকেই।
সব সময় নয়। ইদানিং কালে যে প্রোপাগান্ডা চলছে তাকে অনেকেই এটা ফ্যাশন মনে করে।
কিন্তু এখানে অনেক সময় সমকামীদের হেনস্তা করে সেটা তুমি জান?
করে, কিন্তু সরকার করে না। এখানে সমকামীদের প্রোপ্যাগান্ডা নিষিদ্ধ। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের এ ব্যাপারে উৎসাহী করা আইনত দ্বন্দ্বনীয়। কিন্তু জানিস তো এ দেশে লোকের অভাব। সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করে। আসলে কখনোই কোন কিছু শতভাগ সঠিক ভাবে করা যায় না – অনেক ভালো কাজ যেমন কিছু লোকের বাড়া ভাতে ছাই দিতে পারে উল্টটাও সত্য। তাই নিখুঁত কিছু খোঁজা ঠিক নয় যদিও আমরা সব সময়ই নিখুঁত ভাবে সব কাজ করার চেষ্টা করেই যাব। এটাই বিজ্ঞানের কথা। প্রতি পদে আরেকটু বেশি নিখুঁত ফল পাওয়া। এখানে রেডিও টেলিভিশনে, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রচুর সমকামী কাজ করছে। এরা সমাজের অংশ, সামাজিক ভাবে তাদের শ্রম অপরিহার্য। খেয়াল করলে দেখবি এখানে সমকামিতার বিরুদ্ধেও কোন প্রোপ্যাগান্ডা নেই, শুধু আইন আছে সমকামিতার প্রোপ্যাগান্ডার বিরুদ্ধে। আমি এতে কোন সমস্যা দেখি না।
কিন্তু যখন কেউ কেউ ওদের আক্রমণ করে?
সেটা সমর্থন করার প্রশ্ন আসে না। যতদূর জানি প্রশাসন এদের সমর্থন করে না।
কিন্তু প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে খুব বেশি কিছু করে বলেও মনে হয় না।
হয়তো বা। তবে কিছু কিছু সময়ে প্রশাসনকে অনেক কিছু ম্যানেজ করে চলতে হয়। ডিপ্লোম্যাসি শুধু বিদেশের সাথেই নয়, দেশের ভেতরেও খুবই প্রয়োজনীয়। এখন দেশ একটা যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তাই অনেক কিছুই হয় লোকচক্ষুর আড়ালে, সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে। তাছাড়া যারা এলজিবিটি প্রোপ্যাগান্ডা করতে চায় তাদের বেশির ভাগ পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থ রক্ষা করে, অনেক সময় এরা ইচ্ছে করে এসব করে। তাই সব কিছু এত সরল রৈখিক নয়। আসলে আইন শুধু সংবিধানে যা লেখা আছে তাই নয়, শত শত বছর ধরে কোন এক জাতি যেসব অলিখিত নিয়ম মেনে চলছে সেটাও। এই দেখ রাশিয়া একটা দেশ। তবে এখানে বহু জাতির বসবাস, বহু ধর্মের। পরিবারে শান্তি আসে যদি সবাই সবার মতামতকে, সবার সুবিধা অসুবিধাকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে। সেটা না হলে কেউ কেউ নিজেকে শোষিত মনে করে। তখন শুরু হয় লড়াই।
আমি সেভার সাথে এসব নিয়ে যখন কথা বলছিলাম, তখন নিজের ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ছিল। আসলে ওই বয়সে আমরা রঙিন স্বপ্ন দেখলেও ভালোমন্দ দেখি সাদা কালো চোখে। মানে ভালো আর মন্দের মাঝামাঝি কিছু নেই। এটা খারাপ কিছু নয়, এটা জীবনে অভিজ্ঞতার অভাব। তখন শরীরের রক্ত গরম থাকে, টগবগ করে, মনে হয় যেকোনো সমস্যাই গায়ের জোরে সমাধান করা যায়। এর কারণ ওই বয়সে আমাদের অন্য কারো দায়িত্ব নিতে হয় না। কিছু একটা করতে গেলে যে শুধু নিজের ভালোমন্দ নয় আশেপাশের অনেকের ভালোমন্দ বিচার করতে হয় সেই বোধ আমাদের জন্মায় না। এজন্যেই ছোটবেলা থেকেই সঠিক শিক্ষা দান করা খুব জরুরি, সহমর্মিতা, সমবেদনা এসব শেখানো জরুরি। অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করতে না শিখিয়ে শুধুমাত্র নিজের মতই একমাত্র সঠিক একথা শেখালে লোকজন যে সাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী ইত্যাদি হয়ে উঠবে সেটা আর নতুন কি। তাই সেভার সাথে কথা বলতে গেলে একদিকে যেমন ওর মতামত মন দিয়ে শুনতে হয়, একই সাথে দ্বিমত এমন ভাবে প্রকাশ করতে হয় যেন ও পরে এসব নিয়ে আলাপ করতে অনাগ্রহী হয়ে না উঠে। এটা আসলে যেকোনো লোকের সাথে কথা বলতে গেলেই দরকার, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সাথে।
এরপর সেভা প্রশ্ন করল দুর্নীতি নিয়ে। বলল
এখানে তো চারিদিকে শুধু দুর্নীতি।
দুর্নীতি যে নেই তা নয়, তবে সেটা কাগজে কলমে বা লোকমুখে যতটুকু বাস্তবে কি তাই? যেমন অনেকের ধারণা এখানে লোকজন প্রচুর মদ খায়। এক বাংলাদেশী ছেলে, যে এখানে পড়াশুনা শেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে একবার লিখেছিল – সোভিয়েত ইউনিয়নের সব পুরুষ মাতাল আর মেয়েরা পতিতা। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম সব পুরুষ মাতাল আর মেয়েরা পতিতা হলে এরা কীভাবে মহাকাশ জয় করল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানের নেতৃত্বে সমগ্র ইউরোপের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করল আর আমরাই বা কীভাবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষতার সাথে কাজ করতে শিখলাম। আপনার স্ত্রীও এদেশের মানুষ। আপনার উক্তি তো তাকে আর সেই সাথে নিজেকে অবমাননা করা। রাস্তা ঘাটে মাতাল দেখা যায়, কিন্তু এর বাইরে হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে দেশ সচল রাখছে। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে পুরুষ মহিলা সবাই ছিলেন। এদেশের স্কুল শিক্ষক ও ডাক্তারদের বেশিরভাগ মহিলা। তাই এরকম ঢালাও অভিযোগ কি একজন শিক্ষিত মানুষের জন্য বেমানান নয়? সে এর উত্তর দেয়নি। ধরে নিতে পারি যুক্তিসঙ্গত উত্তর নেই। তাই সেভাকে জিজ্ঞেস করলাম
এই যে সব জায়গায় দুর্নীতি দুর্নীতি বলিস, জীবনে কয়বার ঘুষ দিয়েছিস?
একবারও না।
এই যে পড়াশুনা থেকে শুরু করে চিকিৎসা পর্যন্ত বিনা পয়সায় করাস কোথাও কোন টাকা চেয়েছে?
না।
তাহলে শুধু অন্যের মুখে শুনেই দেশটা করাপশনে ভরা বলিস সেটা কি ঠিক?
তাহলে কি দুর্নীতি নেই?
আছে। তবে যতটা ভাবিস ততটা নয়। এখানে চাকরির জন্য কাউকে ঘুষ দিতে হয় না, হাসপাতালে ভর্তির জন্য ঘুষ দিতে হয় না, স্কুলে ভর্তির জন্য ঘুষ দিতে হয় না। অনেক কিছুই কোন রকম দুর্নীতিতে না জড়িয়েও করা যায়। সোভিয়েত আমলের শেষের দিকে আমি কয়েক বার বাড়তি টাকা দিয়েছি টিকেট কিনতে বা অন্য কোন কিছু কিনতে। কারণ তখন এ সবের অপ্রতুলতা ছিল। আমার ধারণা এখনও লোকজন কালো বাজারে বলশই থিয়েটারের টিকেট কাটে। আসলে দুর্নীতি সেখানে যেখানে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। মহাসাগরের ঝড় হয়তো হরহামেশা হয় না, হলে ভয়ঙ্কর। আমরা ইউরোপ আমেরিকার দুর্নীতি তেমন দেখি না। তার মানে এই নয় সেখানে এসব নেই। আছে উঁচু স্তরে। ২০০৮ সালের তাদের দুর্নীতির জন্য সারা পৃথিবী অচল হয়ে গেছিল। দেশ যত অনুন্নত সেখানে দুর্নীতি তত বেশি। শুনেছি কোন কোন দেশে পুলিশ রাস্তা দেখিয়ে দেবার জন্যও ঘুষ চায়। কোথাও কোথাও চকিদারের চাকরির জন্যেও প্রচুর টাকা ঘুষ দিতে হয়। একবার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমেরিকায় জর্জ ওয়াশিংটনের ছবি এক ডলারের নোটে এটা কি তাকে ছোট করা নয়? ও বলেছিল সবচেয়ে বেশি নোট এক ডলারের, তাই ওটা তাকে সম্মান করা। যে দেশে দুর্নীতি জনজীবনের যত নিম্ন স্তরে নেমে আসে সে দেশ তত বেশি দুর্নীতি গ্রস্থ। দুর্নীতি এমন একটি জিনিস যা সম্পূর্ণ দূর করা সম্ভব নয়। এটা মাথায় রেখেই তার সাথে লড়াই করতে হবে। দুর্নীতি শুধু অর্থের লেনদেন নয়, এক খাতের অর্থ ভিন্ন খাঁতে ব্যয় করাও দুর্নীতি। সেদিক থেকে দেখলে পৃথিবীর অনেক আবিষ্কার হয়েছে এসব রিস্কের মধ্য দিয়ে গিয়ে। যদি সেই সময় কোন আমলা এই রিস্ক না নিত আমরা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হতাম। তাই একে ঢালাও ভাবে খারাপ বলাও কতটুকু ঠিক সেটাও ভাবতে হবে।
তার মানে কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতি ভালো, তুমি তাই বলতে চাও?
না। তবে জানিস তো কখনও কখনও মিথ্যা বলে কারো প্রাণ বাঁচানো যায়। তাই সদা সত্য কথা বলবে – এটা জানার পরেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যাও মহান হতে পারে। দুর্নীতি ব্যতিক্রম নয়। আমরা অবশ্যই দুর্নীতি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করব, তবে সব সময় মাথায় রাখতে হবে যে শত চেষ্টার পরেও সমাজে কিছু কিছু দুর্নীতি থেকেই যাবে। তবে সেটা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে যাতে সেটার কখনোই ক্রিটিক্যাল মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়। তাহলে দুর্নীতিই সমাজের নিয়ন্ত্রক হবে। পৃথিবীর অনেক দেশই সেই মাত্রা পাড় করে ফেলেছে।
রাশিয়া?
আমি যেটুকু দেখি, যেটুকু বুঝি, তাতে মনে হয় রাশিয়া এখনও নিরাপদ অবস্থানে, যদিও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে না গেলে সেই সীমা অতিক্রম করা অসম্ভব কিছু নয়।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো