বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৭২): ব্রিকস সামিট ও অন্যান্য

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

গত সপ্তাহে কাজানে ব্রিকসের সামিট হল। দীর্ঘদিন পাঁচটি দেশ এর সদস্য ছিল – ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও সাউথ আফ্রিকা। এ থেকেই নাম ব্রিকস। এখন বেড়ে নয়। নতুন যোগদানকারী দেশগুলো হচ্ছে আরব আমিরাত, মিশর, ইরান ও ইথিওপিয়া। সৌদি আরবের যোগ দেয়াটা সময়ের ব্যাপার। এছাড়াও তুরস্ক সহ অনেক দেশ এখানে যোগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ৩৫ দেশ ও ছয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা কাজান সামিটে অংশগ্রহণ করেন। ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, আয়তন এক তৃতীয়াংশ আর জিডিপি জি-৭ এর চেয়ে বেশি। ব্রিকস নিয়ে বিভিন্ন দেশের আগ্রহ বলে যে পশ্চিমা বিশ্বের শাসনে এরা আর খুশি নয়। লেনিনের ভাষায় উপরের তলার ওরা পারে না, নীচের তলার এরা চায় না। এটাই বিপ্লবের বা পরিবর্তনের উৎকৃষ্ট সময়। এরাই তৈরি করবে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা। এরাই হবে নতুন ব্যবস্থার একেকটা ইট। তাই ব্রিকস নামটিই আপাতত থাকবে।

এই সামিট বানচাল করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেনি পশ্চিমা বিশ্ব ঠিক যেমন রাশিয়া চেষ্টা করেছে যতদূর সম্ভব সফল ভাবে এটা সম্পন্ন করতে। বিগত দুই বছর পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে যত বেশি একঘরে করার চেষ্টা করছে এরা তত বেশি শক্তিশালী হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিরে আসছে। এমনকি সামিটে উপস্থিতি কমানোর জন্য একই সময়ে ব্রিটেন কমনওয়েলথ সম্মেলন ডাকে। তাদের আশা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেখানে যোগ দেবেন। কিন্তু মোদী কাজান বেছে নেন। এটা সেই অর্থে ব্রিটেনের গালে ডিপ্লোম্যাটিক চপেটাঘাত।

কাজান সামিট মূলত অর্থনৈতিক, বলা যায় ডলারের হেঁয়ালি থেকে মুক্তি পাবার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রচেষ্টা। বিষয়টি এই নয় যে সারা বিশ্ব ডলার থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। যদি আমেরিকা ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করত, শুধু ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকেই এর প্রয়োগ করত তাহলে ডলারের বিকল্প নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। এর আগে যখন ইরান বা অন্যান্য দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে বা তাদের সম্পদ আটক করা  হয়েছে, তাদের ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটানো হয়েছে – এ নিয়ে কেউ তেমন গা করেনি। কিন্তু রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ আটক করা হলে সব দেশে টনক নড়ে কারণ এখন কোন দেশই আর নিরাপদ নয়, আমেরিকা চাইলেই যেকোনো দেশের উপর এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে, তাদের অর্থ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক রাখতে পারে। তাই রাশিয়া তো বটেই অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে তেল গ্যাসের উপর নির্ভরশীল দেশগুলো বিকল্প খুঁজতে থাকে। ব্রিক্স সেই বিকল্প। এটা শুধু অন্যান্য দেশকে আশ্রয় দেয় না, সবাইকে নিজেদের সমান ভাবার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়। পশ্চিমা বিশ্ব যদি আমেরিকার উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়, অনেক প্রশ্নে আমেরিকার তল্পিবাহক হয়, কিন্তু ব্রিক্সে সেই ধরণের কোন হেজেমন নেই।

যদিও এই সামিট মূলত অর্থনৈতিক, তবে রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারেনি। এ ধরণের যেকোনো ফোরামে চীন ও ভারতের উপস্থিতি রাজনীতি সামনে নিয়ে আসে, ঠিক যেমন ইরান ও সৌদি আরব সহ মধ্য প্রাচ্যের আরব দেশগুলোর উপস্থিতি বা আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার উপস্থিতি। তাই অর্থনীতির পাশাপাশি অনেক রাজনৈতিক প্রশ্ন এখানে আলোচনায় আসে। এছাড়া তো ইউক্রেন যুদ্ধ, আমেরিকার নির্বাচন আছেই। যদি ফোরামে আলোচনা নাও হয় এ নিয়ে প্রেস কনফারেন্সে বিভিন্ন প্রশ্ন ওঠে। বিগত সময়ে ইউক্রেনের সমস্যার সমাধান নিয়ে বিভিন্ন শান্তি প্রস্তাব এসেছে। রাশিয়া কোন প্রস্তাবে ভেটো না দিলেও বলেছে শুধু মাত্র এদের দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তার নিশ্চয়তা যে চুক্তি দেবে সেটাই তারা স্বাক্ষর করবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ইউক্রেনের সাথে ১৯৯০ এর দশকে যে চুক্তি হয়েছিল তার প্রধান বিষয় ছিল ইউক্রেনের কোন জোটে যোগ না দেয়া, নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। মৌখিক ভাবে ন্যাটো সম্প্রসারণ না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও পশ্চিমা বিশ্ব বার বার সেটা ভঙ্গ করেছে, রাশিয়ার দোরগোড়ায় ন্যাটোর ঘাঁটি স্থাপন করেছেন। বাল্টিকের দেশগুলোকে হজম করলেও রাশিয়া ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটো ভুক্ত না করার জন্য বার বার দাবি জানিয়েছে। তাই ইউক্রেন যুদ্ধের মূল কারণ সেখানকার ভূমি দখল ছিল না, ছিল রাশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন। এমনকি ২০২১ সালের শেষ দিকে রাশিয়া আমেরিকাকে এক দীর্ঘ প্রস্তাব পাঠায় যার মধ্য দিয়ে রাশিয়া সহ ইউরোপের সব দেশের নিরাপত্তার সুব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু ন্যাটো সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। রাশিয়াকে ইউক্রেন আক্রমণে বাধ্য করে। উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ আর ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করলে এদের অর্থনীতি ধ্বসে পড়বে, পুতিনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হবে, রাশিয়া আবার ১৯৯০ দশকের মত পশ্চিমা বিশ্বের করদ রাজ্যে পরিণত হবে। কিন্তু ১৯৯০ দশকের গণতন্ত্রের আসল  রূপ দেখে এদেশের মানুষ সেই পথ অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ এদের সমাজকে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ করেছে, যদিও প্রচুর পরিমাণ ভিন্নমত পোষণকারী মানুষ দেশত্যাগ করে বাইরে চলে গেছে। তবে বাস্তবতা এই যে দেশের বিপদকালে বাইরে চলে যায় শুধু সেই সব মানুষ যাদের কাছে দেশের চেয়ে নিজের ভালোমন্দ বড়। এরা কখনোই নিজের ভাগ্য কোন নির্দিষ্ট দেশের সাথে জড়ায় না, যেখানে নিজেকে বিকাশ করার সুযোগ পায় সেখানেই চলে যায়। এরা সেই অর্থে পরিবেশ তৈরি করার চেয়ে রেডিমেড পরিবেশেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাই যুদ্ধ বা শান্তি – সেটা বড় কথা নয় – এ সব অজুহাত। মূল কথা ব্যক্তি স্বার্থ। কারণ অনেকেই শুধু মাত্র রাশিয়া প্রতিবেশী দেশ মানে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে এই অজুহাতে দেশত্যাগ করে ইসরাইলে চলে গেছে, অথচ ইসরাইল যখন প্যালেস্টাইন আক্রমণ করে রাশিয়ার তুলনায় নগ্ন ভাবে বেসামরিক লোকদের হত্যা করছে তখন কিন্তু এদের কেউ ইসরাইল ত্যাগ করেনি, বরং সাহায্য করছে। তাই মানবতা নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তাদের যে ব্যক্তি সম্পত্তি গড়ে তুলতে দিয়েছে আর যার বেশির ভাগ তারা পশ্চিমা বিশ্বে নিয়োগ করেছে – সেটা রক্ষাই ছিল এদের প্রধান লক্ষ্য। যাহোক, ফিরে আসি কাজানের কথায়। শান্তি প্রস্তাব নিয়ে পুতিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সরাসরি জানিয়ে দেন যে চারটি অঞ্চল ইতিমধ্যে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে – সে ব্যাপারে কোন কম্প্রোমাইজের প্রশ্ন আসে না। আর যদি পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়াকে পরাজিত করতে চায় – রাশিয়া প্রস্তুত যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য। শুধু কথায় নয়, যাতে পশ্চিমা বিশ্ব ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারে সেজন্য এরা মিসাইল টেস্ট করেছে, ভাবা হচ্ছে পারমাণবিক বিস্ফোরণ করার। এসবই পশ্চিমা বিশ্বকে জানাতে যে আগুন নিয়ে খেলা করলে একদিন নিজেরাই পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে। প্রয়োজনে এরা ইউরোপের কোন দেশে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবে না। এ ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্ত না হলেও বিশেষজ্ঞ মহলে এই আলোচনা জোরেশোরে চলছে। এরা নিশ্চিত যদি পোল্যান্ড, জার্মানি, রুমেনিয়া বা বাল্টিকের দেশে এ ধরণের আঘাত হানা হয় আমেরিকা যুদ্ধে নামবে না, বরং ধীরে ধীরে ইউরোপ থেকে পাত্তারি গোটাবে। কারণ আমেরিকার, বিশেষ করে সেখানকার পুঁজির মোটেই ইচ্ছে নেই নিজেদের ধ্বংসের মুখোমুখি দাড় করানোর। তাদের একটাই উদ্দেশ্য ভিন দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে মুনাফা করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমেরিকার অর্থনীতিকে এমন ভাবে চাঙ্গা করেছে যে যুদ্ধকেই তারা উপার্জনের মূল খাত হিসেবে ধরে নিয়েছে। আরব বিশ্বের ও রাশিয়ার যেমন তেল গ্যাস – আমেরিকার তেমন যুদ্ধ। কাজানে প্রেস কনফারেন্স ও পরবর্তী ঘটনা এই আভাস দেয় যে রাশিয়া ব্রিক্সের দেশগুলোকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যুদ্ধের মাঠে জয়লাভ করার মধ্য দিয়েই সে ন্যাটোর আগ্রাসন থেকে শুধু নিজেকে নয়, গ্লোবাল সাউথকে রক্ষা করতে পারবে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা বিজন সাহা (১৭৩) এলোমেলো স্বপ্ন  

আমারিকার নির্বাচনও পাশ কাটিয়ে যেতে পারেনি। তবে এ ব্যাপারে রাশিয়া বরাবরই চুপ। অনেকটা ঈশ্বরের মত। আমরা যতই ডাকাডাকি করি না কেন তিনি সব সময়েই চুপচাপ বসে থাকেন আর আমরা তাঁর নামে হানাহানি করি। আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়ার অবস্থাও তাই। ওরা রাশিয়াকে নিজেদের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের জন্য অভিযুক্ত করে। ট্রাম্পকে পুতিনের এজেন্ট বলে। তবে আস্তিক বা নাস্তিক কেউই যেমন ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অস্তিত্বহীনতা প্রমাণ করতে পারে না, আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শুরু করে আদালত পর্যন্ত কেউই আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ব্যাপারে প্রমাণ হাজির করতে পারে না। এ বিষয়ে খুব ভালো বলেছেন জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট। তিনি জর্জিয়ার বর্তমান পার্লামেন্ট নির্বাচনে সরকারি দলের বিপক্ষে। সরকারি দল আবারও জিতে গেছে। তিনি অভিযোগ করেছেন রাশিয়ার হস্তক্ষেপের। প্রমাণ চাইলে তিনি বলেন আমেরিকার মত দেশ যেখানে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের কথা প্রমাণ করতে পারে না জর্জিয়ার মত ছোট দেশ কীভাবে সেটা পারবে। তবে তারা বিশ্বাস করে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে। তাই রাশিয়া এখন সব ধরণের সাক্ষ্যপ্রমাণের ঊর্ধ্বে। অনেকটা শয়তানের মত। ঈশ্বরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যেমন শয়তানের দরকার, আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বের অস্তিত্বের জন্য দরকার রাশিয়ার – দৈত্যরূপী রাশিয়ার। তবে আমেরিকা বদলাচ্ছে। এত দিন পর্যন্ত তারা বিভিন্ন দেশের ভোটারদের বলত নির্বাচনের ফলাফলে বিশ্বাস না করতে। মানে ফলাফল তাদের মনোনীত বা পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে না গেলে নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ করতে। এভাবে ইউক্রেনে ইউশেঙ্কো ক্ষমতায় এসেছে, জর্জিয়ার ফলাফল চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। কিন্তু একদিন সব কিছুই বুমেরাং হয়। এখন খোদ আমেরিকায় প্রশ্ন উঠছে আসন্ন নির্বাচনের ফলাফল পরাজিত প্রার্থী মেনে নেবে কি না। কথায় বলে অন্যের ক্ষতি চেয়ো না, তাহলে একদিন নিজেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো