চলমান সংবাদ

আওয়ামী লীগের পতন: ইতিহাসের পটভূমিতে নতুন বাংলাদেশ

ফজলুল কবির মিন্টু
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের মোড় ঘুরে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে ৫ আগস্ট তারিখটি চিহ্নিত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল, তা একসময় গণ অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী রিজিমের পতন ঘটে, যা নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা নিয়ে আসে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কি কারণে বাংলাদেশ ৫৩ বছরের মাথায় মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত হলো?

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার লক্ষ্য, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক এবং উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। তবে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির চেয়ে বিপক্ষের শক্তির উত্থান ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ধর্মকে আশ্রয় করে রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ তাদের শক্তি বাড়িয়েছে। এই বাস্তবতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জন্য একটি হতাশার চিত্র তুলে ধরেছে।

অন্যদিকে, বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী সরকারের ভারত নির্ভরতা, দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে জন বিক্ষোভ ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। তবে বাম শক্তির অদৃশ্যতা এবং কার্যকরী পদক্ষেপের অভাব তাদের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। এই পরিস্থিতিতে ইসলামী মৌলবাদী দলগুলো বিক্ষুব্ধ মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়েত ইসলামী। কোটা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ইসলামী দলের সক্রিয় ভূমিকা পরবর্তীতে সরকারের অবস্থানকেও প্রভাবিত করেছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনেকটা ডানদিকে ঝুঁকে পড়ার অভিযোগ উঠেছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান প্রকাশ পাচ্ছে। তারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে না এবং ৭ মার্চের ভাষণকে স্বীকার করছে না। এসব কার্যক্রম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে এবং জাতির ঐক্যকে দুর্বল করে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের দুটি শক্তির মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট। স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি যদি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তবে তাদের রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো বাস্তবায়ন ভিন্ন আলোচনা। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে আসেনি। তাদের মূল দাবি কোটা এবং বৈষম্য বিরোধী, যা জাতীয় ঐক্যকে অটুট রাখার প্রয়োজনীয়তা জাগ্রত করে।

অতএব, বর্তমান সরকারের জন্য নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং অবাধ নির্বাচন আয়োজন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা প্রয়োজন। নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশী শক্তির ব্যবহার রোধ করা এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হলে জনগণের বিশ্বাস অর্জন সম্ভব হবে।

বর্তমান সরকারের বয়স আড়াই মাস অতিক্রম করেছে। তাদের কর্মকাণ্ডের উপর জনগণের সন্তুষ্টি কম, যা নির্দেশ করে যে তারা দুঃশাসন ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতি রোধ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ না নেওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের মনে অসন্তোষ বাড়ছে।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারলে বর্তমান সরকার জনগণের হৃদয়ে একটি স্থায়ী স্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে। অন্যথা, ইতিহাসে তাদের স্থান হবে ব্যর্থতার কৌটায়। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের হাতে—তাদের কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতেই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নতুন ইতিহাস রচনা হবে।

(লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি)