বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা বিজন সাহা (১৭০) বাম আন্দোলন ও রাশিয়া  

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

কয়েক সপ্তাহ আগে নরেন্দ্র মোদীর রাশিয়া ভ্রমণ প্রসঙ্গে বন্ধু ভাসিলির সাথে আমার কথাপোকথনের একাংশ লিখেছিলাম। আমার যেহেতু উপমহাদেশীয় চেহারা আর এটা বাইরে ভারতীয় বলেই মনে করে তাই বিভিন্ন সময়ে এদেশে “তুমি ভারতীয় কি?” এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি “বাংলাদেশ থেকে” বলে উত্তর দিলেও তারা “ঐ একই কথা” বলে পাশ কাটিয়ে যায়। এটা অনেকটা সোভিয়েত ইউনিয়নের সবাইকে রুশ বা রাশিয়ান বলার মত। তবে এরা কোন খারাপ উদ্দেশ্য থেকে এটা বলে না। বিভিন্ন সময়ই ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান – এসব দেশের বর্তমান রাজনীতি সম্পর্কে, বিশেষ করে রাশিয়ার প্রতি এসব দেশের মানুষের মনোভাবের কথা জানতে চায়। উল্লেখ করা যেতে পারে এদের মিডিয়ায় এসব দেশের উপস্থিতি খুব একটা থাকে না। এমনকি মোদীর রাশিয়া সফর নিয়েও যে খুব একটা হাইপ ছিল তা নয়। কিছুদিন আগে ভ্লাদিমির পুতিন দুবনা এসেছিলেন, আমাদের ইনস্টিটিউট ভিজিট করেছেন। আমি বরাবরের মত অফিসে গেছি, দোকানে কেনাকাটি করেছি, রাতে ক্লাবে গেছি। কিন্তু তাঁর ভিজিটের কথা শুনলাম রাত বারোটার দিকে বাসায় ফিরে টিভির খবর দেখে। পরে শুনেছি কলিগরা অনেকেই সেটা জানত। তবে এ নিয়ে যে উচ্ছ্বাস বা আগ্রহ প্রকাশ করতে হবে সেটা ভাবেনি। আমাদের দেশে সাধারণত নেতারা এলে এলাকায় হই হই রই রই রব পড়ে যায়। এখানে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তাই কে এল আর কে গেল – এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। তাছাড়া এই ভিজিট তো নির্বাচনী হয়, পেশাগত। এসেছেন কাজে, স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলতে। এই যে যুদ্ধ হচ্ছে এ নিয়ে যে সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব একটা কথাবার্তা হয় তা কিন্তু নয় যদিও প্রতিদিন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে অনেক অনুষ্ঠান হচ্ছে এই যুদ্ধের উপরে। কে জানে এটা আমাদের দেশের মত টি-স্টলের অনুপস্থিতির কারণে কি না! সাধারণ মানুষ এ নিয়ে খুব একটা কথা যে বলে তা নয়, অন্তত আমাদের দেশে টি-স্টলে যে ধরণের আলোচনা হয় তা তো নয়ই। যুদ্ধ হচ্ছে, সেনারা করছে। যদি দরকার হয় যাব যুদ্ধে। অনেকটা এই রকম ভাব। তবে কখনও কখনও কেউ কেউ আমাদের দেশ সম্পর্কে আনতে চায়, বিশেষ করে সোভিয়েত আমলের যারা, যাদের কাছে ইন্টারন্যাশনালিজম বা আন্তর্জাতিকতাবাদ খুবই পরিচিত একটি শব্দ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে আন্তর্জাতিকতাবাদ অনেকটাই বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে গেছে। সেই জায়গা দখল করেছে গ্লোবালাইজেশন যার সাথে আন্তর্জাতিকতাবাদের কোনই সম্পর্ক নেই। আন্তর্জাতিকতাবাদ ছিল মানব মুক্তির বিশেষ করে সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মুক্তির আন্দোলন। গ্লোবালাইজেশন আসলে নব্য উপনিবেশবাদ – শিল্পোন্নত দেশেগুলোর শিল্প বাণিজ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থানান্তরিত করার মধ্য দিয়ে সেসব দেশের অর্থনীতিকে নিজেদের হাতের মুঠোয় রাখা। এতে করে একদিকে যেমন নিজদের দেশের পরিবেশ দূষণ মুক্ত রাখা যাবে আবার একই সাথে ভিন দেশের অর্থনীতি তথা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপের মুখে ইউরোপ এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় তাদের উপনিবেশ থেকে পাত্তারি গোটাতে বাধ্য হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গ্লোবালাইজেশনের মাধ্যমে এসব দেশ তাদের হারানো উপনিবেশ ফিরে পেতে তৎপর হয়, তবে আগের মত এসব দেশ দখল করে নয়, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এনজিও ও অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে এসব দেশের অর্থনীতি ও সমাজকে অদৃশ্য সূতায় বেঁধে। এটা অনেকটা আধুনিক দাসত্বের মত। আগে এশিয়া, আফ্রিকা থেকে দাসদের টাকা দিয়ে কিনে আনত, তাদের দিয়ে কাজ করাত, বাঁচিয়ে রাখত। এখন আমরা নিজেরা নিজের খেয়ে নিজের ও দেশের মানুষের টাকায় শিক্ষিত হয়ে ওসব দেশে গিয়ে নিজেদের শ্রম ও মেধা বিক্রি করি। তাদের কোন দায়দায়িত্ব নেই, আমরা নিজেদের দায়িত্বে তাদের দাসত্ব করি, তাদের দেশ গড়ে তুলি। গ্লোবালাইজেশন এটার সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় রূপ।

যাহোক আবার ফিরে আসি মোদীর রাশিয়া সফরে, ভাসিলি আর আমার কথোপকথনে।
– আচ্ছা, সোভিয়েত আমলে না হয় রাজনৈতিক কারণে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরস্পরের বন্ধু ছিল কিন্তু এখন তো বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক সুবিধা অসুবিধা। তাছাড়া এখন বাম আন্দোলনও আগের চেয়ে দুর্বল। তাহলে রাশিয়ার সাথে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর এত ভালো সম্পর্কের কারণ কী?
– কে জানে। এখানেই মনে হয় প্যারাডক্স। এখন বিভিন্ন দেশের বাম দলগুলো রাশিয়াকে বরং আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলো থেকে অনেক বেশি পুঁজিবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী মনে করে। অথচ এক সময় এসব পার্টি মস্কোর প্রশংসায় ছিল পঞ্চমুখ। বলা হত মস্কোয় বৃষ্টি হলে এরা ঢাকা বা দিল্লিতে ছাতা ধরে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাম দলগুলোর মধ্যে রাশিয়াকে সাম্রাজ্যবাদী বলার টেন্ডেন্সি বেড়েছে। বিভিন্ন সময়ে আমার বিভিন্ন জুম মিটিং-এ উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়। তখন দেখেছি বাম দলের অনেকেই আগে যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করত, আজ তেমনি রাশিয়াকে অন্ধভাবে অবিশ্বাস করে, এমনকি ঘৃণা করে। সেদিক থেকে জাতীয়তাবাদী দলগুলো রাশিয়ার প্রতি অনেক বেশি নমনীয়। উল্টো সাধারণ মানুষ বরং সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুপস্থিতি বেশি করে অনুভব করে। কারণ তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল আরেকটা আস্থার জায়গা। এমনকি যারা সোভিয়েত বিরোধিতা করত তারাও একথা বলে। এটা অনেকটা তার কাছে যাব না জেনেও ভয় দেখানো, যদি এমন কর তাহলে কিন্তু তোমাকে ছেড়ে ওর কাছে চলে যাব। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে আমেরিকার পেষণ  নীতি এতটাই সর্বগ্রাসী যে এসব মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। বিশেষ করে «হয় তুমি আমার সাথে নয়তো তুমি আমার শত্রু» আমেরিকা এই নীতি গ্রহণের পর থেকে। তোমার সাথে না থাকলেই যে তোমার শত্রু হব – এটা অধিকাংশ মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। তাছাড়া সব দেশ বা সব দেশের মানুষই চায় নিজেদের সুবিধা মত অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ বা যাদের সাথে দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন রকমের সম্পর্ক গড়ে উঠছে তাদের সাথে যদি সম্পর্ক ছেদ করতে বলা হয় এটা খুবই বেদনাদায়ক। কিন্তু বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলি বিভিন্ন ভাবে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে জিম্মি। কথা শুনবে না, তোমাদের কাছে কিছু বিক্রি করব না, তোমাদের কাছ থেকে কিছু কিনব না। এটা প্রাচীন ভারতীয় সমাজে কাউকে একঘরে করে রাখার মত। শুনেছি সেই আমলে ভারতে কাউকে একঘরে করলে তার সাথে শুধু যে কেউ কথা বলত না তা নয়, তার কাছে কেউ কিছু বিক্রি করত না, তার কাছ থেকে কেউ কিছু কিনত না, কোন পুকুর থেকে সে জল তুলতে পারত না – এক কথায় জীবনের প্রতি পদে পদে তাকে হাজারো সমস্যার সম্মুখীন হতে হত। সেদিকে তাকালে আমেরিকা এখন দেশীয় স্তরে ব্রাহ্মণ্যবাদ চালু করছে। আর এটাই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। এক সময় মানুষ তাদের পছন্দ করত বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ইত্যাদির জন্য। এসব ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অস্ত্র। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে তাদের যা কিছু খারাপ পশ্চিমা বিশ্ব সেটাই গ্রহণ করেছে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৭১): ক্ষুদ্র ঋণ  -বিজন সাহা

সেটা বুঝলাম। তাহলে সেটা তো সবার জন্যই সত্য। এই যে বললে বামপন্থীরা এখন রাশিয়াকে পারলে ঘৃণা করে সেটা তো তোমার এই বক্তব্যের সাথে মেলে না। তাহলে?

বললাম না যে বামপন্থীরা বরাবরই আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী। অন্য দিকে আধুনিক রাশিয়ায় জাতীয়তাবাদের জোয়ার। বিশেষ করে পুতিন এই জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করেই শুধু রাশিয়া নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে পাল্টা শক্তি হিসেবে দার করাতে চেষ্টা করছেন। লেনিন সব সময় জাতীয়তাবাদের বিপরীতে আন্তর্জাতিকতাবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। বর্তমানের বিশ্বায়ন যে লেনিনের আন্তর্জাতিকতাবাদ নয়, নব্য উপনিবেশবাদ সেটা আমাদের বামপন্থীরা বোঝে না বা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যায়। আর সে কারণেই তারা এখন রাশিয়া বা চীনের বদলে আমেরিকা ও ইউরোপের লেজুড়বৃত্তি করে। ভারতবর্ষের প্রথম যুগের বিপ্লবী ছাড়া প্রায় সবাই প্রগতিশীলতাকে নিজেদের সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার উপায় হিসেবে দেখেছে বলেই আমার মনে হয়। এটা আমার নিজের ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। বিষয়টি এমন নয় যে তাদের অন্য উপায় ছিল না। তবে প্রগতিশীলতা ছিল ফ্যাশনেবল আর সেই সাথে নিজেদের ও নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে পড়াশুনা করার সুযোগ। এখন সেটা বন্ধ। না না, রাশিয়া এসব দেশে বৃত্তি দেয়া বন্ধ করেনি, তবে আগের মত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে বৃত্তি দেয় না, দেয় দেশকে। যেহেতু ক্ষমতার বাইরে তাই এই বন্টনে বামদের হাত নেই। হয়তো এটাও একটি কারণ হতে পারে তাদের রাশিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও রাশিয়া বিভিন্ন ভাবে তৃতীয় বিশ্বের স্বার্থে কথা বলছে, কাজ করছে। নিজে যুদ্ধ করছে, তারপরেও রাশিয়া প্যালেস্টাইনে সাধারণ মানুষের জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠাচ্ছে রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে। অথব অনেক মুসলিম দেশ সেটা করছে না। আফ্রিকায় বিনা পয়সায় শস্য দিয়েছে এই রাশিয়াই। কিন্তু সারা বিশ্ব আজ পশ্চিমা মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল, যদিও তথ্যের অভাব নেই। অন্যদিকে এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে দেশে দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়তায় জাতীয়তাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মোকাবেলা করতে। এই নতুন পরিস্থিতিতে পশ্চিমা বিশ্ব যদি আবারও বামপন্থী দলগুলোকে নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যবহার করে অবাক হবার কিছু থাকবে না। একটু খেয়াল করলে দেখবে আজকাল পরিবেশ রক্ষণ, নারী অধিকার, মানবতাবাদী বিভিন্ন আন্দোলন ইন্ধন পাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব থেকেই। যদিও শ্রমিক, কৃষকের পাশাপাশি নারী আন্দোলন এক সময় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছে তবে আজকাল সেটা হয় হাতছাড়া হয়ে গেছে না হয় বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে পশ্চিমাদের হাতে চলে গেছে। আর যে টাকা দেয় সেই নাচায়। তবে বামেরা যদি সত্যিকার অর্থেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হয় তবে সেই আন্দোলনে রাশিয়াই তাদের বন্ধু, কেননা এখন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে লড়াই চলছে রাশিয়া শুধু তার অগ্র সেনাই নয়, একমাত্র যোদ্ধা।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো