বিজ্ঞান ভাবনা (১৬৯): প্রশ্ন -বিজন সাহা

ফেসবুক ও অন্যান্য মাধ্যমে আমার লেখালেখি দেখে অনেকেই প্রশ্ন করে আমি স্বৈরাচারকে সমর্থন করি কি না। জানতে চায় বর্তমান শাসকদের সম্পর্কে আমার মতামত। আমি বলি আমি পদার্থবিদ। আমার কাজই প্রশ্ন করা। প্রশ্ন করে নতুন উত্তর খোঁজা। এখানে শেষ কথা বলে কিছুই নেই, আছে অবিরাম নিজেকে, সমাজকে, তত্ত্বকে উৎকর্ষ করার প্রয়াস। যখনই আমরা প্রশ্ন করা বাদ দেব তখনই আমরা রাস্তা হারাব। আর তাই যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন আমি প্রশ্ন করি। আমি তাদের কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করি। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চাইলে বলি না বিগত ১৫ বছরে না তার আগে – আমি কখনও আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলাম না। একটু ভাবলে বলব হয়তো একাত্তরের আগে বা একাত্তরে আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলাম, কিন্তু তখন আমার যে বয়স ছিল তাতে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে আনা যায় কিনা সেটাই প্রশ্ন। আসলে আমি বরাবরই যদি কোন সরকার ভালো কিছু করে তার সমর্থন করি, খারাপ (আমার বিবেচনায়) কিছু করলে তার সমালোচনা করি। আমার কাছে কে করল সেটা বড় কথা নয়, কি করল সেটাই বড় কথা। দুঃখজনক হলেও সত্য আজকাল আমরা কি করল সেটা না দেখে কে করল সেটা দিয়েই কোন কাজ ভালো না মন্দ সেটা বিচার করি। একই সাথে আমি যদি কোন কিছু গড়তে পারা বা মেরামত করার ব্যাপারে নিশ্চিত না হই তা সাধারণত ভাঙ্গি না, তার আগে কীভাবে মেরামত করা যায় সেটা জানার জন্য পড়াশুনা করি আর পর্যাপ্ত শক্তি ও অন্যান্য উপাদান সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। আমি আর আগের মত কোন কিছুতেই অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করি না। হ্যাঁ, এক সময় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতাম অন্ধভাবে, এখনও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস আছে তবে বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে। তত্ত্ব বলে এমনকি ব্ল্যাক হোলও বিকিরণ করে। তার মানে পরম ভালো বা চরম মন্দ বলে কিছু নেই। সব কিছুই ভালো ও মন্দের সমন্বয়ে গঠিত অনেকটা সোনার গয়নায় খাঁদের মত। সব কিছুই নির্ভর করে অনুপাতের উপর। কখনও কখনও একজন খুনিও কারো জীবন বাঁচাতে পারে আবার কখনও কখনও একজন নিষ্পাপ মানুষ কারো মৃত্যুর কারণ হতে পারে। স্থান কাল সমতল নয়, এটা বক্র। তাই আমাদের সব উত্তরও এই বক্রতার মধ্য দিয়েই পথ করে নেয়। তাই কারো অতীতের অন্যায় আজ আমাদের ভুল করার অনুমোদন পত্র দেয় না, যদি কেউ নিজেদের ভুলকে ন্যায্যতা দিতে বিগত ১৫ বছরের অন্যায়ের কথা টেনে আনে আমি সেটা সমর্থন করি না। তবে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি যে আমি কোন রকম মৌলবাদী দলকে সমর্থন করি না আর আমার কাছে মৌলবাদ হল অন্ধ বিশ্বাস – তা সে ধর্মে হোক, রাজনীতিতে হোক, বিজ্ঞানে হোক বা আর যা কিছুতেই হোক।
এটা ঠিক যে বর্তমান পরিস্থিতি অতীতের কর্মের ফল, কারণ আমাদের জীবন চলে বিবর্তনের নিয়মে যা সময়ের উপর নির্ভরশীল। সেই হিসেবে আজ না ঘটছে সেটা বিগত ৫৩ বছরের কাজের ফল। আমি তো বলব এক শ’ বছরের। কিছু কিছু লোক কর্মে বিশ্বাস করে। তাদের কাছে বর্তমান জন্ম আগের জন্মের কর্মফল। আমি সেটা বলি না, তবে আজকের আমি আমার অতীতের আমির বা অতীতের কাজের ফলাফল। দেশের ক্ষেত্রে আজকের বাংলাদেশ বিগত শত বছরের আমাদের সম্মিলিত সাফল্য ও ব্যর্থতার চিত্র। আমরা ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলকে দোষ দিতে পারি, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের দোষ দিতে পারি, কিন্তু সেটা আমাদের আজকের সমস্যার সমাধান দেবে না। দোষ দেয়া আর সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের সংশোধন করা এক কথা নয়। দোষ দেয়া দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সংশোধন করা – সেটা দায়িত্ব নেয়া। এটাই আমি দীর্ঘ দিন থেকে বলছি। আজ যদি আমি সরকারের সমালোচনা করি তার মানে এই নয় যে আমি আগের সরকারের কাজের অনুমোদন করি। আমি মনে করি আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা রাজনীতি চর্চার অভাব। এমনকি এরশাদের আমলে যেটুকু রাজনীতি করার সুযোগ ছিল পরবর্তী কখনোই সেটা ছিল না। যখন গণতন্ত্র কায়েম হল বলে মনে হল আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোই সেটা ভূলুণ্ঠিত করল। কারণ তাদের কাছে বিরোধী দলের গুরুত্ব ছিল না – না সরকারি দলের চোখে না বিরোধী দলের নিজের চোখে। সেখান থেকেই সংসদ ও পরে নির্বাচন বয়কট, এভাবেই গণতন্ত্রের কবর রচনা। মনে আছে ২০০১ সলে বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করলে আমি মস্কোর আওয়ামী লীগের কয়েক জন বন্ধুকে বলেছিলাম এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের উচিৎ হবে বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দেয়া। অন্যথায় তারা জামাতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করবে যা জামাতকে ফ্রন্ট লাইনে আনবে। কিন্তু দেশের চেয়ে যখন দল বড় হয় তখন এসব কথা মানুষ ভাবে না। শাহবাগ আন্দোলনের সময় লিখেছিলাম এখন আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির এক বিরোধী দল গড়ে তুলতে পারে। কারণ আমি সোভিয়েত ভাঙ্গন দেখেছি, দেখেছি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি না থাকলে দেশ কিভাবে অরাজকতায় ছেয়ে যায়। আজকে বাংলাদেশ যে মবের বা মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে সেটা এই রাজনীতিহীনতার কারণেই। আমরা সাধারণত সময় থাকতে প্রশ্ন করি না। ইদানিং কিছু আওয়ামী বন্ধুর সাথে কথা হল। তারা এখন শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী মনোভাব দেশ ও দলের বিপর্যয় ডেকে এনেছে বলে। কিন্তু কয়েক মাস আগে আমি যখন এটা বলতাম তারা তেড়ে আসত। আমরা আমাদের নেতাদের তোষামোদ করে এমন এক জায়গায় তুলে দেই যে তখন যে কেউ তাদের অতি সহজেই ফেলে দিতে পারে, কারণ তখন তারা বাস্তবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন। আর এ কারণেই বর্তমান সরকারের ভুল ধরিয়ে দেয়া প্রয়োজন। সেটা সমালোচনার জন্য সমালোচনা নয়, তাদের ভালো মন্দের কথা ভেবেও নয়, দেশের ভালমন্দের কথা ভেবে। এই সরকারের রাজনৈতিক ভিত্তি নেই, তাই তাদের জবাবদিহিতার পরিসর কম। তারা রাজনৈতিক দলের নয় বলে দলের কাছে দায়বদ্ধ নয়, যেমনি দায়বদ্ধ নয় জনগণের কাছে। যেহেতু এটা সেই আগস্টেই বুঝতে পেরেছিলাম, তাই বলেছিলাম, এখন উচিৎ সরকারের কাছ থেকে রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি ও নতুন নির্বাচনের দাবি তোলা, যাতে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে। সেটা না হওয়ায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা হয়েছে গল্পের ইঁদুরের মত। সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই গল্পে দাদু শালগম টেনে তুলতে ব্যর্থ হলে একে একে দাদী, নাতনি, কুকুর, বিড়াল তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। সবাই মিলে ব্যর্থ হলে ইঁদুর এতে যোগ দেয় আর এই ইঁদুরই শালগমের জন্য হয় বোঝার উপর শাঁকের আটির মত। কিন্তু এই গল্পে শালগমের পরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ ইঁদুর, কেননা শালগম দাদুর ঘরে যার ভাগ পাবে দাদী আর নাতনি। কুকুর, বিড়াল তা খায় না। আর ইঁদুরের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে না, যদিও শালগম তোলা না হলে ইঁদুর মাটি কেটে সেটা নিজের ঘরে তুলতে পারত। এই আন্দোলনে ব্যাপক জনগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল বিধায় সবার অবস্থা এখন ইঁদুরের মত। কবে তারা এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে কেউ জানে না।
বর্তমানে যে ভাবে দেশ চলছে সেটা অতীতের কোন সরকারের চেয়ে ভালো নয়। একই ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে, বরং আরও বেশি রকম অগোছালো ভাবে। দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর সরকারের কতটুকু নিয়ন্ত্রণ আছে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। যদিও প্রধান উপদেষ্টা সমালোচনার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন বাস্তবে সেটা কতটুকু সম্ভব দেখার বিষয়। তবে মুখে যতই বলি কাজের বেলায় ধর্মের বলয় থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি না। ধর্মের মূল কথা বিশ্বাস। আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা বিশ্বাসী মানে ধার্মিক, তবে যেহেতু ধর্মে যুক্তির জায়গা নেই তাই নিজের বিশ্বাস প্রমাণ করতে আগ্রহী নই। আমরা বলি যে আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, যেকোনো সমালোচনা শুনতে প্রস্তুত। আমাদের বিশ্বাস এই স্বীকারোক্তি গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের আস্থার শর্তহীন প্রমাণ। কিন্তু যখনই কেউ সমালোচনা করে আমরা সেটা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হই কারণ আমাদের বিশ্বস্ততা যুক্তি তর্কের ঊর্ধ্বে। তাই সরকারের সমালোচনা করে অনেকেই চাকরি হারায়। আসলে এই ধর্ম বিশ্বাস আমাদের সব সরকারকেই বার বার প্রভাবিত করে। প্রচলিত অর্থে যারা বিশ্বাস করে তারা ধার্মিক আর অবিশ্বাসীরা নাস্তিক। যদি এটাকে রাজনীতিতে আনা যায় তাহলে সরকারি দল সব সময়ই ধার্মিক আর বিরোধী দল নাস্তিক। এজন্যেই হয়তো দেশে সব সরকার বিরোধী দল ঠ্যাঙায়। তবে বিরোধী দলের দৃষ্টিতে তারা ধার্মিক আর সরকার নাস্তিক। তাই সুযোগ পেলে তারাও চড়াও হয় সরকারি দলের উপরে। তাই আমাদের দেশের সব সমস্যার মূলে রয়েছে বিশ্বাস – বা নিজের বিশ্বাসের প্রতি অন্ধবিশ্বাস। এ থেকেই আমাদের সাম্প্রদায়িকতা। এ থেকেই বিরোধী দলের প্রতি আমাদের যুদ্ধং দেহী মনোভাব। বিরোধী দলও যে গণতান্ত্রিক শাসনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসীরাও যে যে কোন সভ্য জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা আমরা বুঝতে বা মানতে চাই না। এটা আমাদের রক্তে। তাই জিয়া, এরশাদ, হাসিনা, খালেদা যায় কিন্তু শাসন তার নিজের নিয়মেই চলে, দিনের শেষে সবার হাতেই সে স্বৈরাচারী রূপ নেয়। কিছুদিন যাবত ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস ঘুরে বেড়াচ্ছে তুরস্কের প্রবাদ নামে “ভূমির মালিক ধনীরা আর জন্মভুমির মালিক গরীবেরা।” আসলেই তাই। সব শাসকই শুধু লাভের গুড় খায়, সব কষ্ট, সব অবিচার অত্যাচার এই গরীবদের উপর দিয়েই যায়।
এই ধর্মের বলয় থেকে আমরা কি কখনও বেরিয়ে আসতে পারব? বলা কষ্ট। এর শুরু তো আর আজ নয়। আমরা জাতি হিসেবে ধার্মিক মানে ধর্মীয় দর্শন আমাদের মনোজগতে গভীর ভাবে প্রোথিত। যদি প্রাচীন কালের দিকে তাকাই ছবিটা ভিন্ন। যদিও এসবের ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করাই যায় তারপরেও রামায়ণে আমরা দেখব ঋষিরা ধর্ম কর্ম করছেন তপোবনে, নিজেদের আশ্রমে। রাজারা রাজত্ব করছেন রাজ্য পরিচালনার নীতি মেনে। তাঁরা ধর্ম বলতে ঈশ্বরের প্রার্থনা না বুঝিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝতেন। মহাভারতের যুদ্ধকে ধর্ম যুদ্ধ বলা হয়। তবে সেটা ক্রুসেডের মত দুই ভিন্ন ধর্মের যুদ্ধ নয়, সেটা সামাজিক ন্যায় বিচার ও অন্যায়ের যুদ্ধ – যদিও দুই পক্ষই নিজেদের সঠিক মনে করতেন। সম্রাট অশোকের সময় থেকে উপমহাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মের প্রবেশ। এরপর ইসলাম। সব মিলে পরবর্তী সময়ে রাজনীতি ও ধর্ম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারত ভাগের মূলে ছিল ধর্ম। তখন থেকে মুখে যে যাই বলুক এই উপমহাদেশের রাজনীতি ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এমনকি বাস্তবে সেটা না হলেও মনোজগতে সেটা ঘটবে। এটা অনেকটা আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের মত। যদিও মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে তার প্রমাণ মেলে না তারপরেও সব সময় রাশিয়ার কার্ড খেলা হয়। কারণ সেটা জনগণ খায়। যেকোনো ষড়যন্ত্রের তত্ত্বই পাবলিক লুফে নেয়। যুদ্ধ যতদিন লাভজনক থাকবে ততদিন ঘুরে ফিরে যুদ্ধ চলবে। একই ভাবে রাজনীতিতে ধর্ম যত দিন কোন না কোন দলের জন্য মুনাফা বয়ে আনবে ততদিন তার অপব্যবহার করা হবে। দিনের শেষে সবই বাজার অর্থনীতির নিয়ম মেনে চলে। ধর্মকে অনেক আগেই বাজারজাত করা হয়েছে। তাই সামরিক বাহিনী নামিয়ে পূজা যেমন করানো হবে তেমনি সময়ে সুযোগে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে আক্রমণ চলবে। ভয়ের বিষয় হল সরকারের পায়ের নীচের কাদামাটি। শাসক যখন দুর্বল হয় তখন সে ভয়ঙ্কর হয়। আমাদের বর্তমান শাসকরা খুব বেশি রকম দুর্বল।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো