বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৬৮): তিস্তা

-বিজন সাহা

গত সপ্তাহে প্রগতির যাত্রী, ত্রৈমাসিক নাগরিক ও হারুন স্মৃতি পাঠচক্রের পক্ষ থেকে তিস্তার জল বন্টনের উপর একটি অনলাইন আলোচনার আয়োজন করা হয়। এতে মূল প্রবন্ধ পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রিনি বিশ্বাস এক্সেলরড। সেখানে মূলত ভূ-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় অর্থাৎ সমস্ত সমস্যার উদ্ভব ও তার সমাধান রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। এটা ঠিক যে তিস্তা সহ ৫৪ নদীর জল বন্টন নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সমস্যা মূলত রাজনৈতিক কারণে। তবে যেহেতু তিস্তা নদীর সাথে সিকিম, ভারত ও বাংলাদেশ – এই তিনটি দেশের নাগরিক স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাই বিভিন্ন পক্ষের কাছে সমস্যার প্রকৃতি ভিন্ন, ভিন্ন এই সমস্যার সমাধান।

প্রবন্ধের বিষয় ছিল তিস্তা নদীর ভূ-রাজনীতি ও পারস্পরিক সহযোগিতামূলক জল ব্যবস্থাপনা। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে আলোচনায় রাজনৈতিক দিকটাই প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু যেহেতু আমি তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যা নিয়ে কাজ করি তাই যেকোনো সমস্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন করতে অভ্যস্ত। আর তাই যে প্রশ্নটি আমার মনে প্রথমেই জাগে তা হল নদী তো শুধু রাজনৈতিক কারণে শুকিয়ে যায় না, প্রাকৃতিক কারণেও নদী শুকায়। প্রাকৃতিক কারণেও নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এটা ঠিক প্রকৃতির কাছে আমরা প্রশ্ন করতে পারি না, সেক্ষেত্রে আমরা ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়ে তাকে তুষ্ট করতে চাই। এই তুষ্টির মানবিক রূপ ঘুষ দেয়া। কিন্তু ঈশ্বর ঘুষ খান না, তাই আমরা তাঁর পূজা দেই, তাঁর কাছে প্রার্থনা করি এবং নিজেদের কর্মের দোষ দিয়ে প্রকৃতির এসব অত্যাচার মেনে নেই। কিন্তু আমরা কেন তাঁকে প্রশ্ন করার সম্ভাবনা যাচাই করি না, যদি প্রাকৃতিক কারণে নদী শুকিয়ে যায় বা গতিপথ পরিবর্তন করে সেজন্যে আমরা কেন কোন প্ল্যান বি তৈরি করি না। শুধু মাত্র মানুষের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে মানুষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করি – সেই প্রশ্ন আমাকে প্রায়ই ভাবায়। আমার বিশ্বাস যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন তাদের এই বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার, কিভাবে প্রকৃতির মোকাবেলা করা যায় সেই পথ বের করা দরকার। সত্যি বলতে আমরা সব সময় সেটাই করি। অসুখ বিসুখের বিরুদ্ধে লড়াই করি, ঝড় বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে ঘর তৈরি করি, তবে এসব কাজ প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয়, প্রকৃতির মধ্যে আমাদের বাঁচার লড়াই। বর্তমানে পরিবেশ সংক্রান্ত যেসব সমস্যা তার বেশির ভাগই মানুষের তৈরি। তবে তৈরি যারই হোক না কেন, মানুষও এর ভুক্তভোগী। তাই মানুষকে দিয়েই শুরু করতে হবে, মানুষকেই সবার আগে প্রকৃতি বান্ধব হতে হবে। তবে একই সাথে সমস্যার অন্যান্য দিকগুলো নিয়েও ভাবতে হবে।

এই আলোচনায় সিকিম, ভারত ও বাংলাদেশের অনেকেই যারা তিস্তা সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন উপস্থিত ছিলেন, নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, বলেছেন সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য পথ। আমরা সাধারণত কারণ না খুঁজে কে দোষী সেটা খুঁজতে পছন্দ করি। অনেক ক্ষেত্রে কে দোষী সেটা জানলে কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। যাকে বলে কান টানলে মাথা আসে। কিন্তু সব সময়ই কান আর মাথা একই লোকের হবে সেটা ভাবার কারণ নেই, মানে আমরা ভুল কান টেনে ভুল মাথার খোঁজ পেতে পারি।

আমাদের এলাকার, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সব কিছুর দলীয়করণ, মানে কোন দল করল তার উপর নির্ভর করে কাজটি ভালো না মন্দ, কি করল সেটা বড় কথা নয়। সেদিক থেকে দেশের চেয়ে আমাদের দল বড়, মানুষের চেয়ে ধর্ম বড়। ঐক্য নয় বিভাজন আমাদের চালিকা শক্তি। যেহেতু তিস্তা তিন দেশের মানুষের নদী সেটার সমস্যা যদি আমরা তিন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখি তাহলে সমাধান কোন কোন ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী রূপ পাবে, যে সমাধান বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য সেটা হয়তো ভারতের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে না অথবা উল্টোটা। কিন্তু একটা কথা তো ঠিক যে এই সমস্যার মূলে রয়েছে নদীতে জলের অপ্রতুলতা। আর সেজন্যেই উজানের দেশ জল আটকে দিচ্ছে, ভাঁটির দেশ পাচ্ছেনা সঠিক হিস্যা। যদি যথেষ্ট পরিমাণ জল থাকত তাহলে হয়তো এই সমস্যা এমনিতেই নাই হয়ে যেত। যখন তিস্তায় জলের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন সেখান থেকে জল ছাড়া হয়। তাই শুরুটা হতে পারে কীভাবে তিস্তায় জলের পরিমাণ বাড়ানো যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করে।  গবেষণা হতে পারে কেন সারা বিশ্বে বিভিন্ন নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে স্তা নিয়ে। এর কোন সাধারণ সমাধান আছে কিনা তা নিয়ে কাজ করে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা(১৬৭): যুদ্ধের আগুন -বিজন সাহা

সিকিম থেকে যিনি বললেন, তিনি সেখানকার আদিবাসীদের প্রতিনিধি। তিনি বললেন সেখানে একাধিক বাঁধ তৈরি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে তার কমিউনিটি যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তার কথা। বিভিন্ন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি জড়িত এসব প্রজেক্টে যাদের মূল মন্ত্র মুনাফা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সেটা পুঁজিবাদের সাথে প্রকৃতির লড়াই। অন্যদিকে প্রকৃতি রক্ষার জন্য দুনিয়াব্যাপী যেসব আন্দোলন তাও হয় সেই  পুঁজিবাদীদের অর্থায়নে। হতে পারে এটা যত না প্রকৃতি প্রেম, তারচেয়ে বেশি পুঁজিবাদের বিভিন্ন গ্রুপের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। এখানে আরও একটা জিনিস মনে রাখা দরকার নদী বা সাগর শুকানোর পেছনে মানুষের ভূমিকা কম নয়। জানা যায় এক সময় মেসোপটেমিয়ায় প্রচুর কৃষিকাজ হত আর সেজন্যে হত সেঁচের ব্যাপক ব্যবহার। এর ফলেই সেখানে নদী শুকিয়ে মরুভূমির সৃষ্টি হয়। সে গেল প্রাচীন কালের কথা। আমাদের সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে উজবেকিস্তানে তুলা চাষের জন্য ব্যাপক ইরিগেশন করা হয়। তার ফলাফল – উজবেকিস্তান হয়ে ওঠে সোভিয়েত ইউনিয়নের কটন শিল্পের মূল কেন্দ্র। কিন্তু অচিরেই আরাল সাগর জলহীন হয়ে যায়। অনেক চেষ্টার পর এখন একটু একটু করে সেখানে জল ফিরে আসছে। তাই অনেক কিছুর পাশাপাশি চাষাবাদের ব্যাপারেও আমাদের সতর্ক হতে হবে। অন্য দিকে যদি বাঁধের কথা বলি, ভোলগার উপরে অসংখ্য বাঁধ আছে। এক সময় সেসব ব্যবহার করা হত বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এখন জল নিয়ন্ত্রণে। এখানে প্রতিবছর বসন্তে বরফ গলার পরে বন্যা হয়, তাই বাঁধ দিয়ে জলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় আর উপরের দিক যাতে শুকিয়ে না যায় সেটাও দেখা হয়। আসলে ঢালাও ভাবে কোন কিছুকে ভালো বা মন্দ বলার সুযোগ নেই। আসল কথা যেকোনো জিনিসের সঠিক ও সময়োপযোগী ব্যবহার। আর যদি এর সাথে কয়েকটি দেশের ভাগ্য জড়িত থাকে তাহলে এক্ষেত্রে দরকার পারস্পরিক বোঝাপড়া। আলোচনা সভায় বিশেষ করে ভারতীয় বক্তাদের কথা শুনে যেটা বোঝা গেল তা হল এখন জল বন্টনের চেয়েও বেশি দরকার তিস্তাকে বাঁচিয়ে রাখা। যদি তিস্তা নিজেই না বাঁচে ভাগবাটোয়ারা করার কিছুই থাকবে না ঠিক যেমনটা এই সমস্যা থাকবে না যদি তিস্তা গতিপথ পরিবর্তন করে। আর সেই সম্ভাবনাও আজ কম নয়। এ সমস্ত সমস্যা সঠিক ভাবে মোকাবেলা করার জন্য দরকার সম্মিলিত প্রয়াস। এর সাথে অনেক বড় বড় আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বার্থ জড়িত। সেটা যেমন মাথায় রাখতে হবে তেমনি মাথায় রাখতে হবে নদীর উপর অতিরিক্ত ইরিগেশনের কুপ্রভাব। ভাগের লড়াই সব সময়ই বিভাজনের। এখন তিস্তাকে বাঁচানোর জন্য দরকার ঐক্যবদ্ধ লড়াই।

দেয়া নেয়া সব সময়ই দ্বিমুখী। কেউ কিছু দিতে চাইলে সেটা নেবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বর্ষার সময় ভারত যখন জল ছাড়ে তখন আমাদের এলাকা বন্যায় ভেসে যায়। এর প্রধান কারণ আমাদের নদীগুলো প্রায় ভরাট। স্বাধীনতার পরে নদী গভীর করার কাজ হয়েছে কিনা জানি না। বিভিন্ন নদী আজ বালু ব্যবসায়ীদের দখলে। অনেক জায়গায় নদী তার নিজের স্বাভাবিক কাজ করতে পারছে না ভূমি দস্যুদের হাতে বন্দী হয়ে। তাই ভারতের সাথে নদীর জলের হিস্যা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি আমরা যদি স্থানীয় দস্যুদের হাত থেকে নদী উদ্ধার করতে না পারি এসব সমস্যার সামাধান কখনোই হবে না। সেদিক থেকে চিন্তা করলে আমাদের এই সমস্যার কমপ্লেক্স সমাধান দরকার – সেটা হল নদী বাঁচানো, জলের ন্যায্য বণ্টন আর বৃহৎ পুঁজি ও দস্যুদের হাত থেকে নদীকে মুক্ত করা।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো