বিজ্ঞান ভাবনা(১৬৭): যুদ্ধের আগুন -বিজন সাহা
দেড় মাসের বেশি হল কুরস্ক জ্বলছে। শুধু কুরস্ক নয়, রাশিয়ার অন্যান্য শহরের বেসামরিক স্থাপনাও আক্রান্ত হচ্ছে। প্রথমে ছিল শক। এমনকি পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলো প্রশ্ন তুলেছিল এই আক্রমণের যৌক্তিকতা নিয়ে। কারণ এর ফলে দানিয়েৎস্ক রণাঙ্গনে ইউক্রেন বাহিনীর একের পর এক পরাজয় আর পিছু হটা, অন্য দিকে কুরস্কে হাজার হাজার সেনাক্ষয়। তাই যুদ্ধের কৌশল অনুযায়ী সেটা প্রথম থেকেই লস লস সিচুয়েশন। তারপরেও ইউক্রেন একের পর এক প্রচেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে কুরস্ক দখলের। সেটা স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে – এটা কি জেলেনস্কির প্ল্যান নাকি পেন্টাগনের? এই আক্রমণকে ঘিরে নতুন করে মেরুকরণ হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বে। অনেক দেশই এখন রাশিয়ার ভেতরে আক্রমণের জন্য নিজের অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছে ইউক্রেনকে যদিও এখনও পর্যন্ত আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স বিভিন্ন অজুহাতে সেই অনুমতি দেয়নি, তবে দেবে যে সেটা নিয়ে কারো সন্দেহ নেই। এর পরে কি? পশ্চিমা বিশ্বের সব দেশ একযোগে বলছে ইউক্রেন যদি রাশিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমণ করে তা সে করবে নিজের দায়িত্বে। ওরা সেই আক্রমণের দায় নেবে না। যদিও সবাই বোঝে ইউক্রেন যা কিছু করছে সবই পশ্চিমের পরিকল্পনায়, তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। এটা অনেকটা মেসি বা রোনালদোর পেনাল্টি অর্জন করে অন্য কাউকে দিয়ে গোলে কিক নেয়ানোর মত। সবই ওরা করছে, শুধু ফাইনাল কিক মারছে ইউক্রেন। কিন্তু এটা বোঝা উচিৎ এভাবে বছরের পর বছর চলতে পারে না। ইতিমধ্যে রাশিয়া কোন রকম আলোচনার ব্যাপারে তার অনীহার কথা প্রকাশ করেছে। অনীহা এ কারণে নয় যে সে শান্তি চায় না, সে চায় স্থায়ী শান্তি, শান্তির নামে নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় সে দিতে চায় না। ইতিমধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বলছে ২০৩০ সালে রাশিয়ার সাথে মহাযুদ্ধের কথা। তার মানে পশ্চিমা বিশ্ব চাইছে যতদূর সম্ভব যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে আর সেই সুযোগে একদিকে রাশিয়াকে দুর্বল করতে আর নিজেদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে। একই সাথে চলছে বিভিন্ন অস্ত্রের ফিল্ড রিহার্সাল। সেটা রাশিয়া ও ন্যাটো দুই পক্ষের জন্যই সত্য। এক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব দুটো বিশ্বাসের উপর জোর দিচ্ছে। প্রথমত তারা যুদ্ধের পক্ষ না মানে এই যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার নৈতিক অধিকার নেই ন্যাটোর কোন দেশ আক্রমণ করার বা রাশিয়া সেটা করবে না। দ্বিতীয়ত রাশিয়া কোন অবস্থাতেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না। তবে রাশিয়া বার বার বুঝতে দিচ্ছে এ ব্যাপারে তারা নিজেরাই ঠিক করবে কারা যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে আর কারা নিচ্ছে না। আর এই যুদ্ধে যে পশ্চিমা শক্তি যে শুধু অস্ত্র দিয়েই নয়, বিশেষজ্ঞ দিয়ে, স্পুটনিক থেকে প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে ইউক্রেনকে লক্ষ্য ঠিক করতে সাহায্য করছে তা নিয়ে কারোই কোন সন্দেহ নেই। তাই পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধের অংশীদার নয় এটা ডাহা মিথ্যা। এখান থেকেই রাশিয়া ঠিক করবে তাদের যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি।
আমি এর আগে বিভিন্ন সময় বলেছি ইউক্রেন যুদ্ধ আমাকে প্রায়ই একাত্তরের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে অসন্তোষ শুরু হয় ভাষা নিয়ে। যদিও প্রায় ৯০% ইউক্রেনের অধিবাসী স্বচ্ছন্দ্যে রুশ বলত আর রুশ ছিল প্রায় ৪০% ইউক্রেনের মানুষের মাতৃভাষা তারপরেও বিভিন্ন অজুহাতে একে ইউক্রেনের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়নি, মূলত পশ্চিম ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদীদের আপত্তির মুখে। ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত যেকোনো নির্বাচনে খারকভ থেকে ওদেসা পর্যন্ত সমস্ত দক্ষিণ পূর্ব ইউক্রেনে রুশপন্থীরা ভোটে জয়লাভ করত, পক্ষান্তরে উত্তর পশ্চিমে জিতত ইউরোপ পন্থীরা। ১৯৯১ সালে জন্মের শুরু থেকেই দেশ ছিল আক্ষরিক অর্থেই দুই ভাগে বিভক্ত। তাই প্রয়োজন ছিল দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার পথ খোঁজার। কিন্তু পশ্চিমা উস্কানিতে শুরু হয় এক পক্ষের উপর অন্য পক্ষের মতামত চাপিয়ে দেবার রাজনীতি। এ থেকেই দনবাসে বিদ্রোহ, এ থেকেই যুদ্ধ, এ থেকেই ভাঙ্গন। পশ্চিমা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ এক্ষেত্রে দনবাস বা ইউক্রেনে বসবাসকারী রুশদের কথা ভুলে যায়। এই রুশরা কিন্তু এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসা না, এরা এখানে বাস করছে সুদূর অতীত কাল থেকেই। শুধু তাই নয়, ভেলিকি নভগোরাদে শুরু করলেও বর্তমানে আমরা যে রুশ রাষ্ট্র ও সভ্যতার দেখা পাই সেটার শুরু কিয়েভে, যখন রিউরিক নভগোরাদ থেকে কিয়েভে এসে রাজ্য স্থাপন করেন আর পরবর্তীতে তাঁর বংশধর ভ্লাদিমির খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। সেদিক থেকে কার সাথে থাকবে বা কোন পথে চলবে সেই বিষয়ে কথা বলার অধিকার আছে শুধু এই এলাকার জনগনেরই। কিন্তু স্থানীয় জনগণের স্বার্থ নয়, পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে বৃহৎ পূঁজির স্বার্থ সামনে চলে আসায় এই যুদ্ধ, এই মৃত্যু।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হল। তখন সরকারের হাতে অসংখ্য সুযোগ ছিল কোন রকম মৃত্যু ছাড়াই বিষয়টি সুরাহা করার। কিন্তু ক্ষমতার মদে মত্ত নেতারা সেটা করেনি। দীর্ঘ দিন দলীয় কর্মী ও মিডিয়ার চাটুকারিতা তাদের বিপদ সম্পর্কে উদাসীন করে তুলেছিল। ভেবেছিল সমস্যা সমাধান না করে কারো ঘাড়ে দোষ চাপিয়েই পার পেয়ে যাবে। কিন্তু জনতার বিক্ষোভের মুখের বানের জলে খড়কুটার মত উড়ে গেল সব উন্নয়ন, সব দম্ভ। এ আন্দোলন খুব পরিকল্পিত ভাবেই করা হয়েছে, কিছুই হঠাৎ করে হয়নি – ডঃ ইউনুস সাহেবের এই স্বীকারোক্তির পরে এসব সুযোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, তবে একই ভাবে এটাও বলা যায় ২০১৪ সাল থেকেই ইউক্রেনের প্রচুর সুযোগ ছিল দনবাস সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করার, এই অবস্থা থেকে সম্মানের সাথে বেরিয়ে আসার। এমনকি যুদ্ধ শুরুর পরে রাশিয়া ও ইউক্রেন ইস্তানবুলে যে চুক্তিতে উপনীত হয় সেটা বাস্তবায়িত হলেও লক্ষ প্রাণের অকাল মৃত্যু এড়ানো যেত। কিন্তু শান্তি নয়, যুদ্ধই যখন শেষ কথা তখন কোন না কোন অজুহাত ঠিকই বের করবে পশ্চিমারা এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য। আর এটাই যুদ্ধ এত দীর্ঘ হবার প্রধান কারণ। এখানেও ঠিক দেশের মতই অবস্থা, তথাকথিত উন্নত বিশ্বের নেতাদের চাটুকারিতা আর অনুগত মিডিয়া অ্যামেরিকান এস্টাব্লিশমেন্টকে অন্ধ করে রেখেছে। তারাও যে ভুল করতে পারে সেই বোধটাই তারা হারিয়ে ফেলেছে। মনে আছে ইরাক আক্রমণের সময় ফ্রান্স ও জার্মানির প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের মত নেতাদের সরিয়ে আমেরিকা শুধু অনুগত নেতাদেরই পায়নি, সেই সাথে পেয়েছে নিজের কাজের ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে অন্ধবিশ্বাস, হারিয়েছে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা। তাদের এখনও ধারণা সোভিয়েত ইউনিয়নকে যখন ঘায়েল করতে পেরেছিল, সে তুলনায় অনেক দুর্বল রাশিয়া তো কোন ব্যাপারই না। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেই ভেতর থেকে পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত ছিল। রাশিয়া এবং রাশিয়ার জনগণের সিংহভাগ এখন ঐক্যবদ্ধ। ঐক্যবদ্ধ পশ্চিমা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। দেশে দেশে মানুষ শুধুমাত্র দেশপ্রেম দিয়ে প্রায় খালি হাতে লড়াই করে জিতেছে। তারা কি প্রশ্ন করে কেন ক্রিমিয়া, দনবাস বা ইউক্রেনের অন্যান্য এলাকায় যেখানেই রুশ বাহিনী গেছে সেখানে জনগণের ভেতর থেকে প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি? এমনকি পশ্চিমা সাংবাদিকরা যখন ওদের জিজ্ঞেস করছে, ওরা বলে সবাই রাশিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। বন্দুক দিয়ে ভূমি দখল করা যায়, মানুষের মন জয় করা যায় না।
জেলেনস্কি যখন পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে রুশ ভূমিতে তাদের অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে হন্যে হয়ে ঘুরছে, রাশিয়া তখন নতুন করে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নীতিমালা পরিবর্তন করেছে। অনেক আগে আমি যখন ছোট্ট কুকুর ততিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, বড় কুকুর দেখলে ও এমনভাবে ঘেউ ঘেউ করা শুরু করত যে আমার নিজেকেই প্রাণ নিয়ে পালাতে হত। জেলেনস্কির ব্যবহার সেই ততির মতই। সে বুঝতে পারছে না যে তার এই যুদ্ধের প্রস্তুতি বিশ্বকে পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেটা হলে তার স্ত্রীর মিলিয়ন ডলারের গাড়ির, তার নিজের মিলিয়ন ডলারের বাড়ি – এসব দিয়ে আর কী হবে? অবশ্য ওকে দোষ দিয়েই বা কী লাভ? পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে তো আমেরিকার আর ইংল্যান্ড, সঠিক বললে এসব দেশের বৃহৎ পুঁজি।
পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে ইউক্রেনের হাত দিয়ে রাশিয়াকে দাবাতে চাইছে সেটা মোকাবেলার জন্য রাশিয়া নতুন করে তার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নীতিমালা পর্যালোচনা করেছে। এখন এমনকি যে দেশের পারমাণবিক অস্ত্র নেই সেও পারমাণবিক অস্ত্রধারী কোন দেশের সহযোগিতায় রাশিয়া আক্রমণ করে তাহলে দুই দেশকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িত বলে দেখা হবে আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হবে। এমনকি যদি বিশ্বাসযোগ্য এরকম খবর পাওয়া যায় যে কোন জায়গা থেকে প্রচুত সংখ্যক বিমান, ক্রুজ মিসাইল, ড্রোন এসব রাশিয়া আক্রমণ করার জন্য আসছে তাহলে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। ইউক্রেনকে রুশ দেশে ন্যাটোর অস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দেবার কারণে এই পরিবর্তন হয়েছে। যদিও পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতিবিদরা মনে করছে এটা শুধুই ভয় দেখানো, বিশেষজ্ঞরা মনে করে এই রেড লাইন যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভয়াবহ আর এটা ভাঙার ফলাফল ভয়ানক। অবশ্য বাইডেন ইউক্রেনকে নতুন অস্ত্র দেবার ঘোষণা করে মনে হয় রাশিয়ার এই হুমকিকে নাকচ করে দিয়েছেন। তাই যুদ্ধের গতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যায় বলা মুস্কিল। এখানে অধিকাংশ লোকের ধারণা যদি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়ই সেটা ইউক্রেনে করা হবে না, হবে একেবারে ভিন্ন জায়গায়, হবে অকস্মাৎ। এছাড়া লাভরভের মাধ্যমে রাশিয়া বলেছে একমাত্র এই যুদ্ধের জয়ের মাধ্য দিয়েই রাশিয়া তার লক্ষ্যে পৌঁছুবে। সেদিক থেকে নিকট ভবিষ্যতে যদি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে কিছু দেশ, এমনকি গোটা উত্তর গোলার্ধ নাই হয়ে যায় – অবাক হবার কিছুই থাকবে না। সব কিছুইতেই সময় মত থামতে জানতে হয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থা এখন লাগাম ছাড়া জনতার মত – সে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে পারমাণবিক বিপর্যয়ের দিকে। হয়তো এর সীমিত ব্যবহার সবাইকে হুঁশ ফিরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু সমস্যা হল যদি সময় মত হুঁশ ফিরে তাহলে পৃথিবীটাই মানুষের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বের এলিট শ্রেণী গোল্ডেন বিলিয়নের স্বপ্ন দেখে। পৃথিবী সেদিকেই এগুচ্ছে, শুধু এই বিলিয়ন পশ্চিমা বিশ্বের স্যুটেড বুটেড বিলিয়ন নয়, দক্ষিণের ভুখা নাঙা মানুষ।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো