বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৫২): সংগঠন

-বিজন সাহা

মানুষ সামাজিক জীব। বেঁচে থাকার তাগিদেই তাকে সংঘবদ্ধ হয়ে চলতে হয়। আর এ কারণেই গড়ে ওঠে বিভিন্ন রকম সংগঠন। মানুষ নিজের সুখ অন্যের সাথে ভাগ করে নিতে না চাইলেও অন্যকে নিজের সুখের বহর দেখিয়ে সমাজে বা অন্যদের চোখে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে চায়। অন্যদিকে সে চায় নিজের সমস্যা অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে, আর ভাগাভাগি করে নিতে না পারলেও সমস্যা সামাধানে অন্যদের সাথে পেতে। বেশ কিছু মানুষের সমস্যা যখন একই রকম হয়, গড়ে ওঠে সংগঠন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানুষের সমস্যা বদলায়, আসে নতুন সদস্য নতুন সমস্যা নিয়ে। সাধারণত পুরাতন যারা তারাই থাকে নেতৃত্বে, ফলে প্রায়ই সৃষ্টি হয় জেনারেশন গ্যাপ। সংগঠনে তৈরি হয় নতুন সমস্যা, প্রজন্মের সমস্যা।

সংগঠন করার অভিজ্ঞতা যে ব্যাপক সেটা বলব না, তবে যেটুকু করেছি, যেটুকু পড়েছি আর যেটুকু বুঝেছি সেটা নিয়ে আজকের এই লেখা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত থাকলেও সেসবই ছিল আগে তৈরি, আমি পরে সেসব সংগঠনে যোগ দিয়েছি। তাই অনেক কিছুই ঠিক বুঝতাম না বা কোন কিছু পছন্দ না হলেও সেটা এ ভাবেই চলা উচিৎ বলে মনে হত। তবে ২০১০ সালে মস্কোয় আমরা একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। এর ফলে এই সংগঠনের সাথে আমার সম্পৃক্ততা একেবারে প্রথম দিন থেকেই। এর গঠনতন্ত্র, ঘোষণা পত্র থেকে শুরু করে সব আমাদের নিজেদের তৈরি। স্বাভাবিক ভাবেই অনেক ভালো ভালো উদ্দেশ্য ছিল এই সংগঠন করার পেছনে। সে সময় মস্কোয় ব্যবসায়ীদের সংগঠন ছিল, গ্র্যাজুয়েটদের সংগঠন ছিল, ছাত্রদের সংগঠন ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ, যারা বিভিন্ন মার্কেটে কাজ করত, তাদের কোন সংগঠন ছিল না। তাই কয়েকজন বন্ধু জিজ্ঞেস করল এদের নিয়ে কিছু করা যায় কিনা। আমরা নিজেরা বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান করব, চেষ্টা করব এখানে যেসব বাংলাদেশী আছে তাদের ছেলেমেয়েদের বাংলা শেখানোর, যখন কেউ বিপদে পড়ে তার পাশে দাঁড়াব, চেষ্টা করব বিভিন্ন সময়ে দেশের দুর্দশা গ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে। আমিও ভাবলাম, বাইরে থাকি। একার পক্ষে তো কিছু করা সম্ভব নয়। যদি সবার সাথে মিলেমিশে কিছু করা যায়। কাজকর্ম ভালই চলছিল। কিন্তু সংগঠন একবার দাঁড়ানোর পরে দেখা গেল এখানকার পদগুলো লোভনীয়। কারণ কিন্তু এই নয় যে এটা খুব বড় সংগঠন। কিন্তু যখনই কেউ কোন সংগঠনের নেতা হয় তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে তার একটা ইমেজ তৈরি হয় ক্ষমতাশীল মানুষ হিসেবে যাকে অনেকেই বিশ্বাস করে, মানে তাকে বিশ্বাস করা যায়। ফলে সে এক ধরণের সামাজিক ম্যান্ডেট পেয়ে যায়। পরে দেখেছি এই মস্কোতেই অনেক বিদেশী একটা ভিসিট কার্ড তৈরি করে তাতে নিজেকে কোন সংগঠনের সভাপতি হিসেবে লিখে বিভিন্ন ধরণের সুবিধা নেবার চেষ্টা করছে। আমাদের সংগঠনেও সেরকম লোকের অভাব ছিল না। সেটা নিয়েই সমস্যা। এমনকি যদি কোন রকম সুবিধা নাও থাকে যারা ক্ষমতার বাইরে তারা ধরেই নেয় এখানে নিশ্চয়ই কোন মধু আছে। যে ঐক্যের জন্য সংগঠন, সেখানেই ভাঙ্গন, মনোমালিন্য। তাছাড়া অন্যান্য সংগঠনের লোকজন আমাদের সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করল। দেখা গেল কোন অনুষ্ঠানে তাদের ডাকলে কে আগে বলবে আর কে পরে, কে কোথায় বসবে সেটা নিয়ে সমস্যা। এক কথায় সমস্যা সমাধানে সংগঠন সৃষ্টি হলেও সেটাই হল এক বিশাল সমস্যা। হাজারো মানুষের মন রেখে চলতে হয়, কাজের আগে ভাবতে হয় অন্যেরা কি ভাববে সে কথা। তাছাড়া যখন লোকজন কোন সংগঠন করে তখন সেটা করে কিছু কমন সমস্যার সমাধানের জন্য। কিন্তু এরপরে দেখা যায় বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন সমস্যা। ধরুন বর্ষায় খালে জল এলো। যাদের খাল পার হতে হবে সবাই মিলে সাঁকো তৈরি করল। স্কুল জীবনে আমরা প্রতি বর্ষায় সেটা করতাম। আর এভাবেই গড়ে উঠেছিল ক্লাব। কিন্তু খাল পার হবার পর একেক জনের গন্তব্য একেক রকম হতেই পারে। তখন কিন্তু আর সাঁকো দিয়ে আগের ঐক্য ধরে রাখা যাবে না। একই ঘটনা ঘটে বিভিন্ন মাল্টি পেশাভিত্তিক সংগঠনে। দেশে থাকতে ঢাকায় এসে দেখতাম বিভিন্ন সাইনবোর্ড – মানিকগঞ্জ সমিতি, কুমিল্লা সমিতি ইত্যাদি। হয়তো এসব এলাকার যারা ঢাকায় থাকে তাদের মধ্যে যোগাযোগ, তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য এসব সমিতি কাজ করে। কিন্তু যখন এক জনের সমস্যার সমাধান হয়, আসে নতুন কেউ একই ধরণের সমস্যা নিয়ে। কিন্তু যার সমস্যার সমাধান হয়েছে তার এখন নতুন কোন সমস্যা। আর এর ফলে দেখা দেয় প্রজন্মের দ্বন্দ্ব। একদিকে সংগঠনকে টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন মানুষ দরকার, কিন্তু আজ তার যে সমস্যা সেটা অনেকের জন্য আর সমস্যা নয়। এসব কারণে প্রায়ই দেখা দেয় বোঝাপড়ার অভাব। দূরে যাব কেন। নিজেদের পরিবারেই দেখব, আজকে যে সন্তান সে যখন বাবা হয় তখন নিজের সন্তানের সমস্যা প্রায়ই বুঝতে ব্যর্থ হয়। আর এর ফলে পিতা পুত্রের সমস্যা থেকেই যায় অনন্ত কাল ধরে। এটা শুধু পেশাজীবী সংগঠনে নয় রাজনৈতিক দলেও তা দেখা যায়। ধরা যাক অবিভক্ত ভারতের মুসলিম লীগের কথা। উপমহাদেশের মুসলমানদের অধিকার আদায় করার লক্ষ্য নিয়ে তার জন্ম। আসলে সব সংগঠনের জন্ম হয় এরকম লক্ষ্য সামনে রেখে, যদিও প্রায় সব ক্ষেত্রেই সংগঠনের নেতাদের নিজ নিজ হিসাব নিকাশ থাকে, থাকে নিজেদের কায়েমি স্বার্থ। তবে একটা বিষয় দেখার মত যে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সবার উদ্দেশ্য হয় জনগণের মঙ্গল করা। সংগঠনের সভ্যদের অবস্থার পরিবর্তন করার কথাও আসে, কিন্তু দিনের শেষ উপকৃত হয় গুটিকয় মানুষ। অথবা আমাদের দেশের কথাই যদি বলি। এটা তো গোপন কিছু নয় যে আজকের আওয়ামী লীগ আর স্বাধীনতাপূর্ব আওয়ামী লীগ এক নয়। আসলে ক্ষমতা অন্বেষী আর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দল এক নয়, এক নয় দলীয় নেতৃত্ব। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সে যেমন সমস্ত ধরণের কৌশল অবলম্বন করে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যেও তাকে সেটাই করতে হয়। কিন্তু যারা ক্ষমতাসীন, ক্ষমতার কারণেই তাদের জন্য আইন মেনে চলা যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, একই ভাবে আইন না মানার বা আইন ভাঙার সুযোগও তাদের বেশি। খুব কম লোকই পারে ব্যক্তি স্বার্থে নিজের অবস্থানের সুযোগ গ্রহণ না করতে। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় অসন্তোষ – কারণ সুযোগ নিলে বিরোধীরা অসন্তুষ্ট হয়, না নিলে সমর্থকরা। এ এক ধরণের শাঁখের করাত।

তাহলে কি আমরা সংগঠন করব না? অবশ্যই করব। কিন্তু মনে রাখতে হবে সংগঠন সব সময় ইস্যুভিত্তিক, মানে সংগঠন কোন না কোন ইস্যুকে সামনে রেখে তার কাজকর্ম করে। যার ফলে আমরা বিভিন্ন পিকনিক, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক দিবস, পিঠা উৎসব এসব যত সহজে, যত ঐক্যবদ্ধ ভাবে পালন করতে পারি, সংগঠনের কোন সদস্যের বিপদে বা সাফল্য (তা সে বিয়ে হোক বা সন্তানের জন্ম হোক বা অন্য কিছু) যত সহজে এক হতে পারি, সংগঠনের দৈনন্দিন বা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালনোর ব্যাপারে ততটাই দূরে সরে যাই। কারণ আমাদের মনে হয় আমি বা আমার দল ওর চেয়ে এই কাজটি আরও ভালো করে করতে পারতাম। সেটা যেমন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ক্ষেত্রে সত্য তেমনি সত্য দেশ পরিচালনায় রাজনৈতিক শক্তির জন্য। যতক্ষণ না আমরা অন্যের জুতা জোড়া নিজের পায়ে পরছি ততদিন এই ধারণা থেকেই যাবে। তবে বর্তমানে তার সাথে যোগ হয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার, ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের ও নিজের কাছের মানুষদের ভাগ্যের পরিবর্তন করা বা করার চেষ্টা করা। নিজে না করলেও অনেক সময় আশেপাশের লোক নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে ঠিকই দু পয়সা কামাই করে। কথায় বলে, আমার চাচা চৌকিদার, থানাই আমাদের।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো