হাইকোর্টের রায়ে সরকারি চাকরিতে আবার ফিরল মুক্তিযোদ্ধা কোটা

বাংলাদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার রায় দিয়েছে হাইকোর্ট।
সরকারি নিয়োগের দুই শ্রেণিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, সেটি অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে উচ্চ আদালত।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ সাইফুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। তবে, ওইবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কোটা বিরোধী আন্দোলন হয়।
তার পরিপ্রেক্ষিতে নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পুরোপুরি বাতিল করে দেয় সরকার।
তার আগে এসব পদে চালু থাকা কোটার ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল।
এর বাইরে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ আর প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ আসন থাকতো।
কিন্তু, এই রায়ের ফলে শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটাই ফিরবে নাকি বাকি সব কোটাই বহাল হবে সেটি এখনো পরিষ্কার নয়।

আগের মতো কোটা ফিরে আসবে?
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস এর তথ্য, ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন।
সে রিটের শুনানি নিয়ে ওই ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।
সর্বশেষ বুধবার সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ সাইফুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, আদালত তার বক্তব্যে বলেছেন আগের মতো কোটা বহাল হবে।
“আদালতের জাজমেন্ট (পূর্ণাঙ্গ রায়) না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যায় না। এক কথায় বলা যায়, আগের মত কোটা ফিরে আসবে,” বলেন মি. সাইফুজ্জামান।
তবে বাকি কোটাগুলোর ব্যাপারে ‘প্রসিডিং’-এ কিছু উল্লেখ ছিল না বলেও জানান তিনি।
বলেন, “এখানে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার কথা বলা হয়েছে।”
বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক ড. শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যদি পুরো পরিপত্রটিই বিবেচনায় নেয়া হয়ে থাকে, তাহলে সবই বহাল হওয়ার কথা।”
“আদালত কোনো রুলের ক্ষেত্রে অংশবিশেষকে বিবেচনায় নিয়েও রায় (অ্যাবসলুট ইন পার্ট) দিতে পারেন,” যোগ করেন মি. মালিক।

কোটা ব্যবস্থা কি পুনরায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
২০১৮ সালে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে পরিপত্র জারির সময়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল সরকার চাইলে আবার কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে পারবে।
তবে সেক্ষেত্রে একই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করতে হবে বলে জানিয়েছিলেন তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
অর্থাৎ সচিব কমিটিকে পুনরায় পর্যালোচনার দায়িত্ব দিতে হবে, তাদের সুপারিশ মন্ত্রিসভা কমিটিতে উত্থাপন এবং অনুমোদন হতে হবে।
এরপর পুনরায় প্রজ্ঞাপন জারি করে কোটা ব্যবস্থা বহাল করতে হবে। অর্থাৎ পুরোটাই নির্ভর করবে সরকারের ইচ্ছার ওপরে। তবে চাইলে সরকার এই কমিটি পুনর্বিন্যাস করতে পারে।
বুধবারের রায়ের পর সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, এখন আইনানুগভাবে অগ্রসর হওয়াই ভালো হবে। আপিলের মত আইনি পদক্ষেপের ব্যাপারে ইঙ্গিত করেন তিনি।

মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার ছিল মূল দাবি
আগে থেকেই কোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও মূলত ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন জোরালো হতে শুরু করে যা এপ্রিলে এসে তীব্র হয়ে ওঠে।
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের নিয়মিত সংঘর্ষ হতে শুরু করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় উপাচার্যের বাসভবনে ভাংচুরের ঘটনাও ঘটে।
ওই ঘটনার পর ব্যাপক পুলিশ অভিযান চালানো হয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে।
কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ নামে ১৭১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
আন্দোলনের মুখেই ওই বছরের ১১ই এপ্রিল সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অবশ্য কোটার হার কমানো বা সংস্কারের দাবি ছিল আন্দোলনকারীদের।
‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’এর ব্যানারে যে পাঁচটি বিষয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলে সেগুলোর অন্যতম ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার।
আন্দোলনকারীরা চেয়েছিলেন, ৫৬ শতাংশ কোটার মধ্যে যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ সেটিকে ১০ এ নামিয়ে আনা হোক।
বাতিলের পর কোটা বহালের দাবিতে আন্দোলনে নামে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজনদের কয়েকটি সংগঠন। মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল তারা।
ছয় বছর পর আদালতের রায়ে আবার ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার পথ খুললো।