বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৫১): বই পড়া

-বিজন সাহা

আজ আমরা কথা বলব বই পড়া নিয়ে। প্রায়ই বই পড়া নিয়ে বিভিন্ন লেখা দেখা যায় বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। সেখানে বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে রশিয়ায় বই পড়ার আগ্রহের কথা বলা হয়, ছবি দেখানো হয়। আমার অনেক বন্ধুও এর উপর ভিডিও করে, মানুষকে বই পড়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে। তবে আমি আজ একটু ভিন্ন দিক থেকে এ বিষয়ে আলোচনা করব।

কেন আমরা বই পড়ি? সব সময়ই কি বই ছিল? যখন বই ছিল না তখন মানুষ কী করত? আসলে এই প্রশ্নগুলো আমার মনে এলো আজ এক বন্ধুর সাথে কথা বলতে গিয়ে। ওর ছেলের সম্পর্কে জানতে চাইলে বলল, পড়াশুনা ঠিক মত করে না। আজকাল ভালো মার্কস না পেলে ভর্তি হওয়া যায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। ওর সাথে কথা বলতে বলতে এই কথাগুলো মনে হল। অনেক আগে মানুষ তাদের কথা লিখত পাথরে আর সেটাও সবাই পড়তে পারত না। এমনকি প্রায় সমস্ত ধর্মগ্রন্থই আমাদের কাছে এসেছে কবিতায় বা গানে। আসলে ছন্দবদ্ধ টেক্সট মনে রাখা সহজ বলেই আগে গদ্যের প্রচলন তেমন ছিল না, কবিতায় বা গানে গানে কবিরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দেবদেবীদের কথা, রাজা মহারাজাদের কথা বলে যেতেন, রেখে যেতেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। তখন কেউ বইয়ের কথা ভাবত না। আসল কাজ ছিল এক প্রজন্মের জ্ঞান আরেক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়া। মূল উদ্দেশ্য ছিল এটাই – তথ্যের আদান প্রদান। আর এই আদান প্রদানের মাধ্যম কি হবে সেটা মুখ্য ছিল না। অনেক আগে শুনেছি মানুষ কড়ি দিয়ে বেচা কেনা করত, এর আগে জিনিস বদলাত, ঠিক যেমন এখনও আমাদের দেশের গ্রামে পুরানো জামা কাপড় দিয়ে হাড়ি পাতিল কেনা যায়। তবে সেক্ষেত্রে শুধু সেই দু’জনই আদানপ্রদান করতে পারত যাদের চাওয়া পাওয়া কমন পড়ত। সেটাকে এড়ানোর জন্যই টাকার আবিষ্কার। টাকা এখানে ঘটক, মিডিল ম্যান বা দালাল। আজকাল অবশ্য সেই টাকার প্রয়োজনও কমে যাচ্ছে, আমরা কেনাকাটি করছি অনলাইনে বা কার্ড দিয়ে – ব্যাংক সেই ঘটকের কাজ করছে। মানে আমরা অনবরত নতুন নতুন মাধ্যম আবিষ্কার করছি জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে। যাহোক, বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল আমার মামাকে নিয়ে। উনি এখন নব্বুইয়ের দশকে পা রেখেছেন। ফোন করলে বলেন আর ভালো লাগে না বাঁচতে। পড়তে পারেন না, লিখতে পারেন না। অথচ এসব করেই জীবন কেটে গেছে। আমি বললাম, তুমি অডিও বুক শোন, স্মার্টফোনে যা লেখার সেটা রেকর্ড করে কাউকে দাও টাইপ করতে। সেটা মানতে আমার মামা নারাজ। কিন্তু সময় তো বসে থাকে না। মানুষ বৃদ্ধ হয়, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও স্বাভাবিক কাজগুলো করতে পারে না, তবে প্রযুক্তি মানুষের সামনে নতুন দুয়ার খুলে দেয়, তার অবসরকে আনন্দময় করে তোলে। সেটাকে আমরা গ্রহণ করব না কেন?

তাছাড়া বই তো শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম নয়। আমরা যখন রাশিয়ায় পড়তে আসি তখন প্রায়ই রুশ ভাষার শিক্ষক আমাদের নিয়ে যেতেন সিনেমা, থিয়েটার, মিউজিয়ামে। দা ভিঞ্চির মোনালিসা, মুঙ্কের চিৎকার, রেপিনের ইভান দ্য টেরিবল বা আইভাজোভস্কির নাইন্থ ওয়েভ – এসব ছবি একেক ধরণের অনুভূতির জন্ম দেয়। সিরিয়ার শিশু বা রানা প্লাজার স্বামীর কোলে মৃত স্ত্রীর ছবি সারা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। তেমনি দস্তইয়েফস্কি বা তলস্তোই পড়ে আমরা ভিন্ন ধরণের আবেগে ভাসি। এখানে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্রায়ই চিরিয়াখানায় নিয়ে যায় অথবা যায় প্রকৃতিতে ঘুরতে। কেন? শেখানোর জন্য। কারণ সমস্ত পৃথিবীটাই এক বিশাল পাঠশালা। একদিন পাখি উড়তে দেখেই তো মানুষ উড়োজাহাজ বানানোর স্বপ্ন দেখেছিল।

একটি বিষয় খেয়াল করে দেখবেন যে আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষ তা তিনি যে দেশেই বসবাস করুন না কেন, বইয়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে ছবি তুলতে পছন্দ করেন। লাইব্রেরী, ড্রয়িং রুম বা নিদেনপক্ষে টেবিলের উপর বই রেখে। বাইরে এটা খুব একটা দেখা যায় না। অন্তত রাশিয়ায় আমি দেখিনি বিজ্ঞানীরা বইয়ের শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। আমাদের দেশে বইকে মনে করা হয় বিদ্যার প্রতীক। ইলিশ মাছ কেনার মত বইমেলায় গিয়ে বই কিনে ফেসবুকে তার ছবি দেয়া আজকাল ধর্মীয় কানুনের মত হয়ে গেছে। আমাদের সব দেশে এখনও বই মানেই যেন দেবদেবী। হঠাৎ করে বইয়ে পা লাগলে মনে হয় মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল। বই মাত্রই যে জ্ঞানের ভাণ্ডার নয় বা বইয়ে লেখা থাকলেই যে সেটা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয় সেটা আমাদের শেখানো হয় না। যদিও এই আমরাই অপছন্দের বই, বিধর্মীদের বই অনায়াসে পুড়িয়ে ফেলতে পারি। সব কিছুরই সীমাবদ্ধতা আছে। কোন কিছুকেই যেমন খাটো করে দেখার কিছু নেই, তেমনি কোন কিছুকেই অতিমানবিক করে দেখারও সুযোগ নেই। বই নয়, বইয়ে কী লেখা আছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের পরিচয় যেমন তার শিক্ষা দীক্ষায়, তার আচার ব্যবহারে, বইয়ের পরিচয়ও তেমনি সে কী শিক্ষা দেয় তাতে। তবে সেই সাথে এ কথাও মনে রাখা দরকার যে একই লেখা বিভিন্ন পাঠক বিভিন্ন ভাবে অনুধাবন করতে পারে আর নিজের বোঝার জায়গা থেকে সেটা ব্যবহার করতে পারে। আসল কথা সেই বোঝাটা যেন সমাজের বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক কালের একটি উদাহরণ দেয়া যায়। কয়েক দিন আগে দেশে রেমালের তাণ্ডব বয়ে গেল। এ নিয়ে কোন এক ভার্সিটির পক্ষ থেকে – «পরীক্ষার কারণে ঝড় স্থগিত রাখা হয়েছে» লিখে কে যেন একটি পোস্ট দিয়েছে। এটা একটা ফান পোস্ট। এটা নিয়ে হাসাহাসি করা যায়। কিন্তু অনেকেই দেখলাম এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে, এমনকি লেখককে আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে। এসব হয় যখন মানুষের সেন্স অব হিউমারের অভাব থাকে। এটাও শেখাতে হয়। আবার রেমালের তাণ্ডবের পরে এরকম অনেক স্ট্যাটাস দেখলাম সুন্দরবন আবারও দেশকে রক্ষা করল বা এই জাতীয় কিছু। মনে পড়ল স্কুলে সুন্দরবন সম্পর্কে গল্পের কথা। সেখানে সুন্দরী গাছ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বানর আর হরিণের কথা আছে, কীভাবে সংকেত দিয়ে বাঘের হাত থেকে হরিণকে বাঁচায় বানর সেটাও লেখা আছে। কিন্তু গাছের কথা নেই। যে গাছ শত শত বছর ধরে উপকুল রক্ষা করে আসছে সে সম্পর্কে কোন কথা নেই। আমাদের ছোটবেলায় গরুর রচনা থাকত, থাকত জীবনের লক্ষ্য, ছাত্রজীবন এসব বিষয়ে বিষয়ে রচনা। এগুলো খারাপ কিছু নয়, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে, সেই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা যদি আমাদের পাঠ্য বিষয় বদলাতে না পারি ও জানার মধ্যমে পরিবর্তন আনতে না পারি তাহলে সমস্যা। সেদিন সেভাকে জিজ্ঞেস করলাম ও এখন কী বই পড়ছে। আসলে কয়েকদিন আগে ও আমার কাছে কান্টের বিশুদ্ধ কারণের সমালোচনা বইটি চেয়েছিল, আমি ওকে নেট থেকে নামিয়ে পড়তে বলেছিলাম। এ কারণেই জিজ্ঞেস করা। ও জানালো কিছু পড়ছে না, ভিডিও দেখছে। আসলে এখন ভিডিওতে অনেক ভালো ভালো লেকচার পাওয়া যায়। আমি অনেক সময় ছাত্রদের বলি সেসব দেখতে। কিছুদিন আগে তো এক ছাত্রী অবাক করল। করোনার সময় অনলাইনে ক্লাস নিতাম। সেই লেকচারগুলো রেকর্ড করে ইউটিউবে আপলোড করেছিলাম সে সময়। যদিও আমি প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরার ভিডিও করে আপলোড করি, তবে লেকচারের কথা ভুলেই গেছিলাম। ঐ ছাত্রী মনে করিয়ে দিল যে ক্লাসে যদি বুঝতে অসুবিধা হয় তাহলে ও ইউটিউবে আমার লেকচার দেখে। এটা বলার একটাই মানে – জানার মাধ্যম শুধু বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আসল কথা আগ্রহ, জানার আগ্রহ। আর সেই আগ্রহকে বাস্তবায়িত করার জন্য যেকোনো মাধ্যমই ভালো।
রিচার্ড ফাইনম্যান পল ডাইরাকের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁদের মনে হয় জীবনে দুবারই দেখা হয়েছে। ফাইনম্যান ডাইরাকের সাথে পদার্থবিদ্যার সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, তোমার কাছে সমীকরণ আছে? ফাইনম্যান উত্তর দিয়েছেন, না। ফলে আলোচনা এগোয়নি। আসলে প্রতি বিষয়ের নিজস্ব ভাষা থাকে। ফিজিক্সেরও নিজস্ব ভাষা আছে। আমরা যদি আমাদের ভাবনা অন্যের কাছে তুলে ধরতে চাই ভাষার আশ্রয় নিতে হবে, বিষয় অনুযায়ী উপযুক্ত ভাষায় সেটা প্রকাশ করতে হবে। বই পড়ে আমরা বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস, বিভিন্ন দেশের ভৌগলিক, আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা যেমন জানতে পারি তেমনি শিখতে পারি ভাষার শৈল্পিক ব্যবহার সম্পর্কে। বিভিন্ন ধরনের বই আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেয়। তাই বই কোন একমুখী ব্যাপার নয়, সে নানা ধরণের শিক্ষা দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে একটি ধারণা খুব গভীর ভাবে প্রোথিত যে পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই মানেই বিনোদন বা সময়ের অপচয়। রাশিয়ায় স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ গল্পের বই পড়তে হয় যা রুশ ও অন্যান্য দেশের লেখকদের রচিত বিশ্ব সাহিত্যের ক্ল্যাসিক। বই পড়তে বললেই হবে না বইয়ের বহ্যমুখী ব্যবহারের কথাও বলতে হবে। তবে আমাদের পড়তে হবে সেই সব বই যা প্রশ্ন করতে শেখায়, যা ভাবতে শেখায়, নিজের স্বপ্নকে ছবির মত করে লেখায় প্রকাশ করতে শেখায়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নোট বইয়ের ব্যপক উপস্থিতির কারণেই হয়তো আমরা প্রশ্ন না করে শুধু উত্তর খুঁজি আর সেজন্য হাজারো বইয়ের ভেতরে ডুবে না থেকে দু একটা বইকে সম্বল করেই জীবনের পথে হাঁটি প্রশ্ন না করে, সেসবের ভেতরে লেখা উত্তর মুখস্ত করে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের বইয়ের বাইরে অন্যান্য মাধ্যমকেও গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে বই মানুষেরই লেখা, মানুষের চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন, ফসল। সব চিন্তা যে সব সময় কল্যাণকর তা নয়। সব কিছুর মত ভালো মন্দ বিচার করে যদি বই পড়া যায়, বই পড়ে প্রশ্ন করতে শেখা যায় আর লব্ধ জ্ঞান যদি সমাজ ও প্রকৃতির মঙ্গলে ব্যবহার করা যায় তবেই বই পড়া সার্থক হয়।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৫০): যুদ্ধ প্রদর্শনী -বিজন সাহা

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো