বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৫০): যুদ্ধ প্রদর্শনী

-বিজন সাহা

আমি সাধারণত রবিবার মস্কো যাই। সোমবার ক্লাস থাকে। আগে যাই যাতে ছেলেমেয়েদের সাথে সময় কাটাতে পারি। এবারও সেটাই করলাম। চেষ্টা করি সব সময় ক্যামেরা নিয়ে যেতে। তাই আগে থেকেই ওদের জিজ্ঞেস করি ক্যামেরা আনব কি না। অর্থাৎ ওরা ছবি তুলতে যাবে কি না। কারণ এর উপরে নির্ভর করে আমি কোন কোন লেন্স নিয়ে আসব। ওরা যেতে চাইলে পোরট্রেট তোলার লেন্স সাথে নিয়ে যাই, না হলে ওয়াইড এঙ্গেল আর টেলি। আবার যদি ফুলের ছবি তুলতে চাই মাক্রো লেন্স সাথে রাখি। আমার তো সরকারি পিঠ নয় যে সবকিছু সাথে নিয়ে ঘুরব! মনিকাকে জিজ্ঞেস করায় জানালো ও বিকেলে যেতে পারবে। ওরা মাত্র পিটার থেকে ঘুরে এসেছে। আজ বন্ধুদের ওখানে গেছে। ফিরবে বিকেলে। তাই আমি সেভাবেই প্রস্তুত হয়ে গেলাম, সাথে আরও নিলাম ওয়াইড এঙ্গেল। মস্কোয় পৌঁছে দেখি কড়া রোদ। একবার ভাবলাম মনিকা ফিরতে সেই ৬ টা, যাই না হয় পাক্লোন্নায়া গারায়, ওখানে ইউক্রেনের রণাঙ্গনে দখলকৃত অস্ত্রের প্রদর্শনী হচ্ছে। দেখে আসি, ছবিও তুলে নিয়ে আসি। এসব ঘটনা ঐতিহাসিক, প্রতিদিন হয় না। অন্যদিকে ভাবলাম, এত রোদ, ক্যামেরার ব্যাগের বাইরেও পিঠে আরেকটা ব্যাগ। বরং বাসায় এসব রেখে একটু রেস্ট নিয়ে যাই, তাতে ওজন, রোদ সবই কমবে। আসলে আগে আমার এসব নিয়ে খুব একটা  আগ্রহ ছিল না। তবে লেখালেখির কারণে আর অনেক বন্ধুরা এখান থেকে ফার্স্ট হ্যান্ড নিউজ পেতে চায় বিধায় আজকাল এ ধরণের কাজ করি। সেভাকে জিজ্ঞেস করলাম যাবে কি না। আগ্রহ দেখলাম না। আমি  নিজেও ওর বয়সে বা তার আগেও এমনটাই ছিলাম। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। এদেশে বাচ্চাদের যুদ্ধাস্ত্র দেখানো, যুদ্ধের উপরে বিভিন্ন মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে এরা বাচ্চাদের দেশের ইতিহাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। মনে আছে আমার বন্ধু আনাতলি একবার দুবনা থেকে মস্কোর উপকণ্ঠে টি-৩৪ ট্যাঙ্কের মিউজিয়ামে ওর ছেলে ইউরাকে নিয়ে এসেছিল। মস্কো হলে সমস্যা নেই, যাতায়াত সহজ, কিন্তু এরকম এক জায়গায় যাওয়া বেশ ঝক্কির। টি-৩৪ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ট্যাঙ্ক। যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার পেছনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এরকম এক গল্প পড়েছি যে দুটো জার্মান ট্যাঙ্ক একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া টি-৩৪ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ ভেতরের সেনারা সেটাকে স্টার্ট দিয়ে দুটো জার্মান ট্যাঙ্ক সহ নিজেদের শিবিরে চলে আসে। অতিরঞ্জিত কিনা জানি না, তবে টি-৩৪ সত্যিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অলৌকিক সব ঘটনা ঘটিয়েছে। আমার মনে আছে আমি নিজেও সেই টি-৩৪ মিউজিয়ামে গেছিলাম ১৯৮৩ সালে মস্কোয় আসার পর পর। নিয়ে গেছিল নাজিম। ও ছিল আমাদের গ্রুপের সোভিয়েত কোরডিনেটর। মস্কোয় বসবাস, যদিও কাজাখস্তানের ছেলে। ওর বাসায় বেশ কয়েকবার গেছি। ওর বাবা ডিপ্লোম্যাট বা ঐ জাতীয় কিছু, তাই বেশ প্রিভিলাইজড ফ্যামিলি। তাছাড়া ছেলেমেয়ারা ছোট থাকতে আমরা নিজেরাই ওদের নিয়ে গেছি এসব মিউজিয়ামে। খোলা আকাশের নীচে কামান, ট্যাঙ্ক, সাজোয়া গাড়ি, এরোপ্লেন এসব দেখাতে। ভারী খেলনা ট্যাঙ্কই কিনেছি অনেক। তাই এ ধরণের প্রদর্শনী আমার জন্যে নতুন কিছু নয়। তবে আগে যদি সোভিয়েত বা রুশ অস্ত্রশস্ত্র দেখতে যেতাম এবার যাচ্ছি বিদেশী অস্ত্রশস্ত্র দেখতে যাদের নাম গত দুই বছর আগে সবার মুখে মুখে, যাদের কথা ছিল রুশ অস্ত্রকে পরাজিত করে যুদ্ধে জেতা। পক্ষান্তরে এরা সব বন্দী হয়ে আজ অবনত মস্তকে পাক্লোন্নায়া গারায় দাঁড়িয়ে আছে অপরাধীর মত। পাক্লোন মানে প্রনতি জানানো। বিভিন্ন যুদ্ধে যেসব সেনারা জীবন দিয়ে রাশিয়ার জন্য বিজয় এনে দিয়েছে তাদের শ্রদ্ধা জানাতে এই কপমপ্লেক্স তৈরি করা হয়। এখনও মনে পড়ে ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে মস্কো আসার পর পর আমাদের শহর দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। বিভিন্ন যাওয়া ঘুরে আমরা এখানে আসি। তখন কিছুই ছিল না, মাত্র কাজ শুরু হয়েছে। ১৯৯৫ সালে বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এখানে বেশ ধুমধাম করে প্যারেডের আয়োজন করা হয়। ছোট্ট আন্তন আর মনিকাকে নিয়ে আমরা সেদিনও এখানে গেছিলাম। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বিজয় উপলক্ষ্যে কুতুজভ প্রস্পেক্টের যেখানে ট্রিউম্ফ আর্ক তৈরি করা হয়েছে ঠিক তার পাশেই এই বিশাল কমপ্লেক্স। যুদ্ধের মিউজিয়াম, বিভিন্ন স্ট্যাচু – সব মিলিয়ে দেখার মত জায়গা। তাই এখানেই যে এই প্রদর্শনী হবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। এখন বন্ধুরা বাইরে থেকে বেড়াতে এলে ওদের নিয়ে আমি বেশ কিছু জায়গার সাথে এখানেও আসি।

বাসায় ফিরে একটু রেস্ট নিয়ে গেলাম পার্ক পাবেদি বা বিজয় পার্কে। এখানেই আমাদের পাক্লোন্নায়া গারা। বা এই পাক্লোন্নায়া গারাতেই পার্ক পাবেদি। মেট্রো থেকে বেরুনোর আগেই দেখলাম মানুষের ভিড়। কয়েকজন দেশাত্মবোধক গানের মেলোডি বাজাচ্ছে, সবাই দাঁড়িয়ে শুনছে। আমিও সামিল হলাম ওদের সাথে। তারপর চললাম প্রদর্শনীর দিকে। মনে পড়ল নুরু, মাহবুব আর উজ্জ্বলের কথা। ওরা বিভিন্ন সময়ে এসেছিল রাশিয়ায় আর সেই সূত্রে আমিও নতুন করে মস্কো ঘুরেছিলাম ওদের নিয়ে। সামনেই লেখা এই প্রদর্শনীর কথা। ভাবলাম – এইতো, এসে গেছি, ঢুকে পড়লেই হল। আর তখনই বুঝলাম আসলে ঢোকা ঠিক ততটা সহজ নয়। সেখানে বিশাল লাইন, তবে এমন ভাবে সেটা কড়া হয়েছে যে মনেই হয়না এটা লাইন। টুকিটাকি কাজ সেরে যখন লাইনে দাঁড়ালাম সময় অনেকটা গড়িয়ে গেছে। সেচ্ছাশ্রমীরা সাহায্য করছে। অনেকেই জোড়ায় জোড়ায়। কেউবা ফ্যামিলি মানে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। বিভিন্ন বয়সী। সবার মনেই উৎসাহ, এক কথায় উৎসব উৎসব ভাব চারিদিকে। দুই  থেকে আড়াই শ মিটার লম্বা লাইন বার চারেক ঘুরে শেষ পর্যন্ত মূল গেটে পৌঁছুলাম। লাইন নয়, জনস্রোত। সেখানে সিকিউরিটি। সব মেটালিক জিনিসপত্র সরিয়ে রাখতে হয়। আলাদা ভাবে ব্যাগ চেক করে। শুধু বললেন, তাড়াহুড়ো করবেন না, ধীরে ধীরে ব্যাগ দেখান। অধিকাংশ মানুষের হাতে স্বাভাবিক ছোট ব্যাগ, মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ। আমার ক্যামেরার। এরপরে শুরু হল এক্সপোজিশন দেখার পালা। প্রচুর লোক। সবাই দেখতে চাইছে, ছবি তুলতে চাইছে। প্রতিটি অস্ত্রের সামনে তার সমস্ত ক্যারেক্টিরিস্টিক লেখা। কার তৈরি, কত সালে তৈরি, এই ধরণের অস্ত্র প্রথম কবে সেনাবিহিনীতে আসে, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, ওজন, কোন দেশ থেকে এসেছে, কোথায় বন্দী হয়েছে। এক কথায় বিস্তারিত বায়োডাটা বা সিভি। তবে এখানে এটা যতটা না বিজ্ঞাপন হিসেবে কাজ করবে তারচেয়ে বেশি অ্যান্টিঅ্যাড। সেখানেও স্বেচ্ছাসেবীরা সাহায্য করছে। আর এসব অস্ত্রের পাশে দাঁড়িয়ে আছে কোন না কোন সেনানী। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। বিভিন্ন মিউজিয়ামে গাইডরা যেভাবে উত্তর দেয়, ঠিক সেভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছে। এসব অস্ত্রের গুণাবলী সম্পর্কে জানাচ্ছে। পরাজিত হলেও এদের হেয় করে কিছু বলছে না। এত দিন যে সব অস্ত্রের নাম শুনে এসেছি টিভিতে বা পড়েছি পত্রিকার পাতায় – এখন সেসব চোখের সামনে। প্রতিটি অস্ত্রের গেয়ে সেই দেশের পতাকা, তাই সহজেই বোঝা যাচ্ছে কোথায় তাদের দেশ, তাদের কেন মলিন বেশ। ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, অ্যামেরিকান, টার্কিশ … কোন দেশের অস্ত্র নেই সেখানে। তবে অবাক হলাম সোভিয়েত ট্যাঙ্ক দেখে, মনে হয় টি ৬৪, ওটা সত্তরের দশকে চেকস্লাভাকিয়ায় ছিল, এখন রুশদের হাতে বন্দী হয়ে পাক্লোন্নায়া গারায় বিশ্রাম নিচ্ছে। অনেক আগে, ১৯৯১ সালের আগস্টে ক্যুএর সময় পার্লামেন্টের সামনে দাঁড়ানো ট্যাঙ্ক দেখে যেমন ভয় পেয়েছিলাম, এখানে সেটা ছিল না। ভয় না থাকলেও উচ্ছ্বাস ছিল না। কারণ এসব অস্ত্র সুন্দর নয়, ভয়ঙ্কর সুন্দর। দানব শক্তিশালী হয়, ভয়াবহ হয়, তার কাছে কেউ সৌন্দর্য আশা করে না। এখানেও ঠিক তাই।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৪৯): মে ২০২৪ - বিজন সাহা

একে একে দেখা হল ব্রিটেনের মাস্টিফ, জার্মানির লেপার্ড, আমেরিকার আব্রাহামস, পোলিশ, টার্কিশ, চেক, ফিন, সুইডিশ কত ধরণের অস্ত্রের সাথে। যখন আব্রাহামস কোথায় সেটা জানার জন্য এক সেনাকে প্রশ্ন করলাম, ও দেখিয়ে দিতে মুষ্টিবদ্ধ হাত বাড়িতে দিল, আমিও হাত মুষ্টিবদ্ধ করে টোকা লাগালাম। করোনা কালের এই সম্ভাষণ এখনও চালু আছে। মনে পড়ল ১৯৯১ সালের আগস্টের কথা। সেদিনও রেড স্কয়ায়ে ঠিক এভাবেই এক সৈনিকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলাম। সেবার হ্যান্ডশেস্ক, এবার হাত টোকা। তবে আন্তরিকতায় দুটোই একই রকম। সবার সাথে এক ধরণের আন্তরিক বন্ধন তৈরি হয়ে গেছিল। এখানে এসব ভারী অস্ত্রের বাইরেও ছিল ছোট অস্ত্রের প্রদর্শনী। সেটা একটি প্যাভেলিয়নে। সে জন্য আলাদা লাইন। এক মেয়েকে বলে জায়গা রেখে আমি আবার ছবি তুলতে গেলাম। এসে আর বুঝতে পারলাম না কাকে বলে গেছিলাম। তখন মনে হল মেয়েটির ছবি তুলে রাখার দরকার ছিল। আসলে আমি এভাবে সব জায়গায়ই লাইন হারাই তা সে দোকান হোক, ক্লিনিক হোক বা অন্য কোথাও। আমি অসহায়ের মত ওকে খোঁজার চেষ্টা করে না পেয়ে এক ছেলেকে বললাম আমি লাইন হারিয়ে ফেলেছি, দাঁড়াব তোমাদের সাথে? সেটা তোমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি। দাড়াও। তারপর ঢুকে গেলাম সেই প্যাভেলিয়নে। সেখানে আরও ভিড়। আসলে ছোট ছোট জিনিস, তাই হুমড়ি খেয়ে দেখতে হয়। দেখলাম ড্রোণ, গ্র্যানেট, জ্যাভেলিন আরও কত কী! শুনেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও রেড স্কয়ারে ঠিক এরকম এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। এটা একদিকে যেমন গর্ব করার সুযোগ দেয় অন্য দিকে বোঝায় যুদ্ধের ভয়াবহতা। কারণ অস্ত্র মানেই ধ্বংস, মানে মৃত্যু। যদিও এ থেকে কেউই শিক্ষা নেয় না। বরং নতুন করে অস্ত্রে সজ্জিত হয়। তবে মাঝে মধ্যে মানুষকে যুদ্ধের ভয়াবহতা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য শুধু বিজয়ী নয়, পরাজিত অস্ত্রের প্রদর্শনীর আয়োজন করাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সব যুদ্ধেই কেউ হারে, কেউ জেতে। তবে সব সময়ই হারে মানবতা।

 

সেদিনের তোলা ছবি এখানে দেখা যাবে

http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=294

 

আর ভিডিও এখানে

https://youtu.be/RHMww7J_iy8

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো